মুসার ‘যুদ্ধাপরাধ’: সাক্ষীরা ‘প্রস্তুত’, ‘পাচ্ছে না’ তদন্তকারীরা
উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ ডেস্ক : বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরের একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগগুলোর তদন্ত মুখের কথাতেই আটকে আছে কয়েক বছর ধরে। তার যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ দিতে ফরিদপুরের মুক্তিযোদ্ধারা ‘তৈরি আছেন’ বলে জানালেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা বলছে, এখনও ‘পর্যাপ্ত প্রমাণ’ তারা পায়নি।
ফরিদপুরের মুক্তিযোদ্ধারা মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রীর ফুপাত ভাইয়ের বেয়াই হওয়ায় পার পেয়ে যাচ্ছেন মুসা বিন শমসের; যদিও রাজনৈতিক পরিচয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না বলে দাবি তদন্ত কর্মকর্তাদের।
জাঁকজমকপূর্ণ চলাফেরার জন্য বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে ‘বাংলাদেশের প্রিন্স’ হিসেবে পরিচয় পাওয়া মুসার কোনো বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে না এই অভিযোগের বিষয়ে; তার নাগালই পাওয়াই দুস্কর।
তবে তার ছেলে ববি হাজ্জাজ এক সময় বলেছিলেন, তার বাবার বিরুদ্ধে আনা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ পুরোপুরি ‘ভিত্তিহীন’।
ফরিদপুর শহরের সাধারণ একটি পরিবার থেকে রহস্যময়ভাবে ধনকুবের হয়ে ওঠা মুসাকে তার এলাকার মানুষ ‘নুলা মুসা’ নামেই চেনে।
২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর বিভিন্ন পর্যায় থেকে মুসা বিন শমসেরের বিচারের দাবি উঠে। তার পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তের কথা বলা হলেও তাতে কোনো অগ্রগতির খবর দিতে পারেননি তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তা সানাউল হক।
মুসার যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি করে আসা সাংবাদিক প্রবীর সিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি খুব স্পষ্ট করেই বলেছি, নুলা মুসার ব্যাপারে তদন্ত সংস্থা আগ্রহী নয়।”
জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা, আলী আহসান মো. মুজাহিদসহ অন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে ফরিদপুরে যাওয়া প্রসিকিউটর ও তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছেও মুসার বিষয়ে বলা হয়েছিল।
মুসার ‘যুদ্ধাপরাধের’ প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন অভিযোগ করেন, তাদের কথা আমলেই নেওয়া হয়নি, উল্টো ‘চেপে’ যেতেও বলা হয়। সাক্ষী হওয়ার পর তাদের উপযুক্ত নিরাপত্তাও দেওয়া হচ্ছে না।
মুসার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের আত্মীয়তার সম্পর্কই তদন্ত আটকে রেখেছে বলে মনে করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম আবু ইউসুফ সিদ্দিকী পাখী।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ও (মুসা) হইতাছে শেখ হাসিনার আত্মীয়। প্রবীরদার (সাংবাদিক প্রবীর সিকদার) তো পাও গেল। এখন এইটা আগাবে, আমার বিশ্বাস হয় না।
“এর আগে যখন আমি বলতে গেছি, তখন তারা (প্রসিকিউটর, তদন্ত কর্মকর্তা) বলল, এটা নিয়ে কথা বলার দরকার নেই, চাইপা যান। এরা চাইপা যায়, আর আগায় না।”
মুসার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে তৈরি থাকার কথা জানিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “যেটুকু আমি দেখছি, আমি আপনাকে বলি। মরার আগ পর্যন্ত ওর (মুসা) সামনে দাঁড়ায়া আমি কইতে পারব। সার্কিট হাউজে আমি তারে দেখছি পাকিস্তানি মেজর আকরাম কোরায়েশীর সঙ্গে। আমার মামাত ভাইরেও ধইরা নিয়া গেছিল এই নুলা মুসা।”
আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের যুদ্ধাপরাধের রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী ইউসুফের মতো মুজাহিদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়ে যাওয়া ফরিদপুরের রথখোলার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা বাবুনাথও বলছেন, তিনিও মুসার ‘যুদ্ধাপরাধের’ সাক্ষী।
“ওই মুসারে আমি বুকে লাত্থি দিয়া গর্তের মধ্যে ফেলায় দিছিলাম স্বাধীনতার পরের দিন। ফরিদপুরে মুসার বাড়ির লগে সেই গর্তটা এখনও আছে,” বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন তিনি।
তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তাদের কাছে মুসার যুদ্ধাপরাধের তদন্ত দাবি করেছিলেন জানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বাবুনাথ বলেন, “কাছের বেশ কয়েকজন আমাকে নিষেধ করত, যেন মুসার বিরুদ্ধে কথা না বলি। তারা বলত, ‘মুসা প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়, প্রবীর সিকদার লিইখ্যা পাও (পা) খুয়াইছে’। তবে আমি জীবনের ভয় করি না। যারা জানতে চায় তাদের আমি সবসময় বলি, বলব।”
ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মাসুদ হোসেনও বলেন, তদন্ত বা বিচারের প্রয়োজনে সাক্ষ্য দিতে তিনিও ‘প্রস্তুত’।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুসা বিন শমসের সরাসরি যুদ্ধাপরাধী। যুদ্ধাপরাধী হিসেবেই সে চিহ্নিত। সত্যি কথা বলতে কি, এটা আমাদের ব্যর্থতা যে, তাকে আমাদের যেভাবে চিহ্নিত বা উপস্থাপন করার দরকার ছিল, আমরা সেটা করিনি।”
প্রসিকিউটর ও তদন্ত কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময় ফরিদপুরে তদন্তকাজে গেলেও কখনও মুসার বিষয়ে কিছু জানতে চায়নি বলে জানান ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় এই নেতা।
প্রধানমন্ত্রীর ফুপাত ভাইয়ের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্কের সঙ্গে তদন্তের কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেন তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল হক।
একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাজনৈতিক কিংবা পারিবারিক সম্পর্ক বিবেচনা করলে সৈয়দ কায়সারের বিচার হত না (অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বেয়াই হন কায়সার)। আমরা তো তাকে বিচারের মুখোমুখি করেছি।”
মুসার বিষয়ে তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মুসা বিন শমসের খুবই ক্লেভার। শুনেছি সে একটি মেয়েকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল। কিন্তু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না পেলে কীভাবে তদন্ত করব?
“সাফিসিয়েন্ট এভিডেন্স নাই। তাছাড়া সুনির্দিষ্ট ইনসিডেন্ট তো থাকতে হবে।”
“মুসা বিন শমসেরের বিরুদ্ধে তদন্ত অব্যাহত আছে, এর বেশি কিছু বলতে পারব না,” বলেন সানাউল হক।
তদন্ত কী পর্যায়ে আছে, তার কোনো ভাষ্য পাওয়া যায়নি তার কাছে; তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তদন্ত শুরুই হয়নি।
‘এভিডেন্স নেই’ বলে তদন্ত কর্মকর্তার বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে একাত্তরে স্বজন হারানো প্রবীর সিকদার বলেন, “আমি নিজে গিয়েছিলাম। তারা তো অভিযোগ আমলেই নিচ্ছে না। তাই দায় এড়াতে ওইসব বলছে।
“আমি বলেছিলাম, অন্যদের যেমন আগে গ্রেপ্তার করে তদন্তে নেমেছিলেন, নুলা মুসার ক্ষেত্রে সেটা করুন, দেখবেন কত মানুষ মুখ খোলে।”
“ঘটনা যে সত্য তার বড় প্রমাণ তো আমিই। ১৫ বছরেরও বেশি সময় আগে আমি তার বিরুদ্ধে লিখলাম, সে তো আমার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারত। কিন্তু মামলা না করে আমাকে খুন করতে চাইল কেন?” বলেন এই সাংবাদিক।
দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সেই রাজাকার’ কলামে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুসা বিন শমসেরের বিতর্কিত ভূমিকার বিবরণ তুলে ধরেছিলেন সাংবাদিক প্রবীর সিকদার।
দুই দশক আগে ওই ঘটনার কিছুদিন পর এক হামলায় প্রবীর সিকদার একটি পা হারিয়ে পঙ্গু হয়ে যান। ওই হামলার মামলায় মুসাকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন জানিয়েছিলেন প্রবীর, কিন্তু তা হয়নি।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রবীর বলেন, “দেড় বছর ধরে এই নিউজটি আমার নিউজপোর্টালের (উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ) প্রচ্ছদেই দেখা যাচ্ছে। ওর বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমার নিউজ পোর্টালে ওই রাজাকার ঝুলতেই থাকবে।”
‘মুক্তিযুদ্ধে ফরিদপুর’ বইয়ের লেখক, সাংবাদিক আবু সাঈদ খানও একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুসা বিন শমসেরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথা উল্লেখ করেছেন।
তদন্ত সংস্থার বক্তব্যে অসস্তুষ্ট আবু সাঈদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অন্যদের বিষয়ে তথ্যের জন্য যোগাযোগ করলেও মুসার বিষয়ে কেউ কোনো কথা বলেনি।
তিনি বলেন, “মুসার যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি ফরিদপুরে ওপেন সিক্রেট, রাখঢাকের কোনো বিষয় না। এটা নিয়ে সংশয়ের কোনো সুযোগ নেই। বিশেষ করে যারা সে সময় শহরে অবরুদ্ধ ছিল, তারা সবাই জানে।”
“তার (মুসা) সম্পর্কে আমার বইয়ে যা আছে, মনে হয় তাই যথেষ্ট (বিচারের জন্য),” বলেন এই সাংবাদিক।
মুসার বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যথার্থভাবে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আছে।
“ফরিদপুর অঞ্চলে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশে সশস্ত্র অবস্থা তার ছিল। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। আজ হোক কাল হোক, তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।”
মুসার যত কাণ্ড-কীর্তি
অভিযোগ আছে, একাত্তরের ২১ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যদের ফরিদপুরে ঢোকার ক্ষেত্রে মানচিত্র ও পথ নির্দেশনা দিয়ে নেপথ্যে সহযোগিতা করেন মুসা বিন শমসের।
ফরিদপুরে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢোকার পরদিন অর্থাৎ একাত্তরের ২২ এপ্রিল ফরিদপুর সার্কিট হাউসে পাকিস্তানি মেজর আকরাম কোরায়েশী ও মুসাকে অন্তরঙ্গ পরিবেশে দেখার দাবি করেন মুক্তিযোদ্ধা আবু ইউসুফ পাখী।
দুই বছর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ইউসুফ বলেছিলেন, একাত্তরের এপ্রিলে যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা আসি আসি করছে, তখন পুরনো পেট্রোল পাম্পের কাছে মুসা বিন শমসেরকে কিছু বাঙালি যুবককে নিয়ে বিরাট এক পাকিস্তানি পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন তিনি।
একটি চাইনিজ রাইফেল নিয়ে ফরিদপুর শহরের আলীমুজ্জামান ব্রিজের ওপর দিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে তখন যাচ্ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ।
“আমি রাইফেল উঠিয়ে তাক করে বলি, শালার দালাল, শেষ করে দেব। ওরা দৌড় দেয়। কিন্তু পরিস্থিতির কথা ভেবে গুলি না করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করি।”
পরে মুক্তিযুদ্ধের একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে সার্কিট হাউসে মুসাকেও দেখেন বলে জানান ইউসুফ।
ওই ঘটনার বর্ণনায় আবু ইউসুফ সিদ্দিকী পাখী বলেন, “আমাকে সার্কিট হাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন দেখলাম, মেজর কোরায়েশীর সঙ্গে মুসা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। তখন আমি বুঝতে পারি আমার গ্রেপ্তারের পেছনে কাদের হাত রয়েছে।”
মুক্তিযোদ্ধা বাবুনাথ একাত্তরে কয়েকটি ঘটনায় মুসার জড়িত থাকার তথ্য জানান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে।
একটি ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, “১৯৭১ সালে ২১ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী ফরিদপুরে প্রবেশ করে। এর ছয় কি সাত দিন পরে মুসার নেতৃত্বে স্থানীয় দালাল ও পাকিস্তানি আর্মিরা সদর থানার কানাইপুর গ্রামে হামলা চালায়। সেদিন কানাইপুর গ্রামের সিকদার বাড়ির ১৩-১৪ জনকে হত্যা করা হয়। মুসার সহযোগী লালমিয়া (বর্তমানে এলাকায় পীর হিসেবে পরিচিত) সেদিন এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়।”
আরেকটি ঘটনা বর্ণনা দিয়ে বাবুনাথ বলেন, “পাকিস্তানি মেজর কোরায়েশী একটি মেয়েকে ধর্ষণ করেছিল। স্বাধীনতার পরদিন আমি এ ঘটনা শুনি। ফরিদপুরের ‘সারদা সুন্দরী মহিলা বিদ্যালয়’র প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রকান্ত নাথের বাসার ভাড়াটিয়া ছিল মেয়েটির পরিবার। ওই বাসাতেই ধর্ষণ করে মেজর আকরাম। সেদিন মুসাও মেজর আকরামের সঙ্গে ছিল।”
এছাড়া মুসার নেতৃত্বে ফরিদপুর সদর উপজেলার শিবরামপুরে বাবু বাড়ির ১৪-১৫ জনকে হত্যা এবং নগরকান্দা উপজেলার তালমা বাজারের রবী ত্রিবেদীর বাড়ির পেছনে কুণ্ডুবাড়ি থেকে ৮ মন স্বর্ণালঙ্কার লুট করা হয় বলে দাবি করেন মুক্তিযোদ্ধা বাবুনাথ।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তখনকার (একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়) ফরিদপুরে মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর পাঞ্জাবি অফিসার মেজর আকরাম কোরায়েশীর সঙ্গে মুসার খুব নিবিড় সম্পর্ক ছিল।”
১৬ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া মাসুদ বলেন, “এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধা এবং লোকজন আছে, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় মুসার অপরাধের শিকার।”
একাত্তর সাল পর্যন্ত মুসা ছাত্রলীগে যুক্ত থাকলেও ইংরেজি ও উর্দুতে অনর্গল কথা বলার সুবিধা নিয়ে পাকিস্তানি আর্মির সঙ্গে মুসা ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন বলে মন্তব্য করেন মাসুদ।
ফরিদপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আবুল ফয়েজ শাহ নেওয়াজ এর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুসার ভূমিকা পাকিস্তানিদের পক্ষে ছিল।
“৭১ সালের পাক সেনারা ফরিদপুর স্টেডিয়ামের ভেতরে টর্চার সেল তৈরি করেছিল। সেখানে মুসার বেশ যাতায়াত ছিল। সে সময় ফরিদপুরে প্রচার ছিল, মুসা পাক সেনাদের নারীসহ বিভিন্ন কিছু সরবরাহের কাজ করত।”
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরদিন ১৭ ডিসেম্বর মুসাকে ধরার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বাবুনাথ বলেন, “সকাল সাড়ে ৯টা কি ১০টার দিকের ঘটনা। ফরিদপুর শহরের হাজি বাজারের (হাজি শরীয়তুল্লাহ বাজার) জোনাকি হোটেলের সামনে ঘটনাটি ঘটেছিল।
“ওই যে, ওই সমস্ত শুনছি, শুনে মাথা গরম হইয়া আছিল। ওরে মাইরাই ফালাব আমি, কিন্তু চিত্ত মাস্টার বইলা একটা লোক সেদিন হাতে ধইরা নুলারে বাঁচাইলো। পরে একটা গালি দিয়া লাত্থি মাইরা ফেলাই দিলাম। বলছিলাম, তোরে যেন আর না দেখি।”
এরপর মুসা কী করেছিলেন, সেই তথ্য খুব একটা পাওয়া যায় না। কিছুকাল পর জন শক্তি রপ্তানির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। তবে তার পরিচিতি তুলে ধরতে গিয়ে অস্ত্র ব্যবসার কথাই বেশি আসে গণমাধ্যমে।
নাগাল মেলে না মুসার
ব্যাপক ঠাটবাট ও দেহরক্ষী নিয়ে চলা মুসা বিন শমসেরের বক্তব্যের জন্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে নানাভাবে চেষ্টা করা হলেও তার নাগাল পাওয়া যায়নি।
গত ডিসেম্বর মাস থেকে অনেক চেষ্টার পর মোবাইল ফোনে কথা হয় মুসার ‘আইটি এক্সিকিউটিভ’ মোহাম্মদ আসিফের সঙ্গে। মুসার ‘ব্যক্তিগত বিষয়গুলো’ তিনি দেখেন বলে জানান।
আসিফ প্রথমে বলেন, “এগুলো (যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ) অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। উনি এ বিষয়ে কথা বলবেন না।”
তারপরও সরাসরি কথা বলতে চাইলে আসিফ বলেন, “দেখি, উনি যদি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়। তাহলে আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।”
কয়েক দিন পর আবার ফোন করলে আসিফ বলেন, “উনি অসুস্থ, উনি অফিসে আসেন না। উনি রেস্টে আছেন। উনার সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে এখন কথা বলা যাবে না। একজন অসুস্থ মানুষকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না।”
এর আগে ২০১৪ সালের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রতিবেদনে বক্তব্য নেওয়ার জন্য চেষ্টা করেও মুসাকে পাওয়া যায়নি। তবে কথা হয়েছিল তার ছেলে ববি হাজ্জাজের সঙ্গে।
তখন এইচ এম এরশাদের দলে থাকা ববি তার বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, “এটা ডাঁহা মিথ্যা কথা। বাংলাদেশে একটি রীতি দাঁড়িয়ে গেছে যে মানি লোকের সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া। এ ধরনের কোনো ঘটনা (পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে আঁতাত) ঘটেনি।”
“আপনারা যদি চান তাহলে ইনভেস্টিগেট করে দেখতে পারেন,” বলেছিলেন ববি।
মুসা বিন শমসের নামে এখন পরিচিত হলেও তার নাম এ ডি এম (আবু দাউদ মোহাম্মদ) মুসা। গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার কাজিকান্দা গ্রামে।
মুসার বাবা শমসের মোল্লা পাকিস্তান আমলে চাকরি করতেন পাট বিভাগের মাঠকর্মী হিসেবে পিএলএ পদে। ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামটের ট্রাকস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকায় বাড়ি করেন তার বাবা। সেখানেই বেড়ে ওঠেন মুসা।
মুসা পড়াশোনা করেছেন ফরিদপুর ঈশান স্কুলে। ১৯৬৮ সালে ওই স্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে। তবে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা তার দেওয়া হয়নি বলে স্থানীয়রা জানায়। ১৯৮৬ সালে নিজের নামের আগে ‘ডক্টর’ যুক্ত করলেও তার কোনো রেকর্ডপত্র পাওয়া যায়নি।
জনকণ্ঠে প্রকাশিত প্রবীর সিকদারের প্রতিবেদনে মুসা বিন শমসেরের পরিচয় তুলে ধরে বলা হয়েছে, “এখন তার নাম প্রিন্স ড. মুসা-বিন-শমসের হলেও সার্টিফিকেটে নাম এডিএম মুসা। মুসা-বিন-শমসের কিংবা এডিএম মুসা- কোনো নামেই ফরিদপুরের মানুষ তাকে চেনে না।”
স্থানীয়রা বলেন, বাকপটু মুসার ছিল ইংরেজি ও উর্দু কথোপকথনে পারদর্শিতা। তাকে পুঁজি করেই পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়েন তিনি।
জিয়াউর রহমানের আমলে জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসা শুরু করে মুসা। প্রথমে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল শাহবাজ ইন্টারন্যাশনাল, পরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম হয় ড্যাটকো।
তবে মুসার পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম অস্ত্র ব্যবসার কথাই আগে বলে।বিদেশি গণমাধ্যমে তার পরিচয় তুলে ধরা হয় ‘প্রিন্স অব বাংলাদেশ’,আসে তার জাঁকালো জীবন-যাপন, সোনার জুতার কথা।
১৯৯৭ সালে যুক্তরাজ্যে নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী টনি ব্লেয়ারের নির্বাচনী প্রচারের জন্য ৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে আলোচনায় আসেন মুসা। একটি দৈনিকে সুইস ব্যাংকে মুসা বিন শমসেরের ৫১ হাজার কোটি টাকা থাকার খবর ছাপা হয়েছিল।
তবে দুদকে জিজ্ঞাসাবাদের পর গত বছর মুসা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাংলাদেশে বসে কেউ এত অর্থ উপার্জন করতে পারবে না।
শুল্ক ফাঁকি দিয়ে তার চালানো একটি গাড়ি জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ বলেছে, এই ঘটনায় তাকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
খবর : বিডি নিউজের সৌজন্যে।
(ওএস/এএস/মার্চ ২২, ২০১৭)