যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করতে কেন এই নির্লিপ্ততা !
।।পুলক ঘটক।।
প্রবীর সিকদারের একটি পা নেই। এই পা তিনি হারিয়েছেন সাংবাদিকতা করতে গিয়ে। বোমার আঘাতে তার ডান পাটি ঝাঁঝড়া হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তাররা কেটে বাদ দিতে বাধ্য হন।
গত ১৯ জুলাই প্রবীরদা ফেসবুকে লিখেছেন, 'ফজরের আজান চলছে। সমাগত সকাল। সারারাত ঘুম হয়নি অসহ্য যন্ত্রণা/ব্যথায়। রাজাকারের বোমায় আমার যে পাটি উড়ে যায়, সেই অস্তিত্ববিহীন পায়ে এক রহস্যের যন্ত্রনা! মেডিকেলের পরিভাষায় যাকে বলা হয় 'ফ্যানটম পেইন'। রহস্যের এই ব্যথা বড় যন্ত্রনাদায়ক। পেইন কিলারে কিছু হয় না, কিছু হয় না ঘুমের ওষুধেও। এই ব্যথাটি নিরন্তর থাকলেও সেটি বেশির ভাগ সময়েই সহনীয় থাকে। প্রতি মাসে ৪/৫ বার তা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। এই ব্যথা ৩/৪ ঘণ্টা থেকে টানা ৩/৪ দিনও আমাকে ভোগায়। সেই সাথে যোগ দেয় বোমার স্প্লিনটারের ব্যথাও। একসময় এই রহস্যের ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে দিতে হতো প্যাথিডিনও। এই ভোগান্তি চলছে ১৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে । ব্যথার ওপরে ব্যথা ! আমার সাথে যন্ত্রণা পোহায় আমার স্ত্রী-সন্তানরাও। কি আর করা ! যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন থাকবে এই দুর্বিষহ যন্ত্রণা। সেই সঙ্গে আমার নিত্য সঙ্গী হয়েই বহাল থাকবে রাজাকার আর প্রভাবশালীদের জারি করা মৃত্যু পরোয়ানার আতংক !'
হ্যা, পা হাড়ানো প্রবীরদা এখন 'মৃত্যু পরোয়ানার আতংক' নিয়ে বেঁচে আছেন। ২০ জুলাই তিনি লিখেছেন, 'আবার শুরু হুমকি! কয়েকবার তো মরতে মরতে বেঁচেছি, এবার বুঝি রক্ষা নেই! কার কাছে যাবো! কে আমার নিরাপত্তা দিবে! কে আমার নিরাপত্তা নিয়ে ভাববে!' ঐদিন তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এভাবে, 'আমি ১৫ দিনেরও বেশি সময় ধরে নিজের জীবন নিয়ে শংকিত। পুলিশ খোঁজ নেয়নি। সরকারের কেউ জিজ্ঞেস করেনি। এমনকি আমার সাংবাদিক বন্ধুরাও খোঁজ নেয়নি। ব্যতিক্রম শুধু ঢাকার বাইরের তিন সাংবাদিক, যারা প্রতিদিন বেশ কয়েকবার করে ফোন করে আমার কুশলাদি জানছেন, সাহস দিচ্ছেন।'
তবে ২১ জুলাই সন্ধা ৬টায় তিনি লিখেছেন, 'আজ আর শুধু সেই তিন জন নয়; আজ আমার খোঁজ নিয়েছেন অন্তত ১০০ সাংবাদিক। তারা আমাকে শুধু সাহসই দেননি, লড়াইয়ের ময়দানে পাশে থাকারও প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। স্যালুট আমার সকল সাংবাদিক বন্ধুকে।'
আসলে প্রবীর সিকদারের স্যালুট পাওয়ার মত আমরা (সাংবাদিকরা) কিছুই করিনি। আমাদের সংগঠনগুলোও কিছু করেনি। প্রবীরদাকে হত্যার হুমকির প্রতিবাদে আমাদের কোনও কর্মসূচী নেই। অথচ এই প্রবীরদাদের নিয়ে আমরা অতীতে রাজনীতি একেবারে কম করিনি। আততায়ীর হাতে নিহত সাংবাদিক শামসুর রহমান, মানিক সাহা, দিপঙ্কর চক্রবর্তী, গৌতম দাস, হুমায়ুন কবীর বালু... এদের প্রত্যেককে নিয়ে আমরা কেবল রাজনীতি করেছি এবং রাজনীতির বেনিফিসিয়ারী হওয়ার চেষ্টা করেছি। সামনে আমি বা আপনি মারা গেলে তা নিয়ে যদি রাজনৈতিক সুবিধা করার সুযোগ থাকে তবে তা করতে কেউ পিছপা হবে না। যেসব হত্যাকাণ্ড ও নৃশংসতার ব্যপারে র্নিলিপ্ততা ও প্রতিকারহীনতা অতীতে জামায়াত-বিএনপি সরকারকে অজনপ্রিয় করেছে এবং যা থেকে বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল সুবিধা পেয়েছে এই প্রবীরদার ঘটনাটিও সেগুলোর একটি। ভবিষ্যতেও এর পুনরাবৃত্তি হবে। কথাগুলো ক্ষোভ ও দু:খ থেকে বলছি। কিন্তু এই কথাকে মিথ্যা প্রমাণ করতে হবেনা ? মিথ্যা প্রমাণ করতে হবে যে আমরা কেবল রাজনীতি করার জন্য নয়, ন্যায্যতার প্রয়োজনেই আন্দোলন করি, প্রতিবাদ করি। আমার কথাকে মিথ্যা প্রমাণ করার দায়িত্ব রাষ্ট্র ও সমাজের। সাংবাদিক সমাজের উপরও দায়িত্বটি অনেকখানি বর্তায়-যদি না আমরা এ ব্যাপারে সোচ্চার হই।
মুসার বিরুদ্ধে থানায় জিডি করেতে থানায় গিয়েছেন প্রবীর সিকদার। কিন্তু সেই জিডি এন্ট্রি হয়নি। পা হারানোর পরও এই মুসাকে আসামী করে মামলা দিয়েছিলেন প্রবীরদা। বিচার পাননি। টাকার কাছে বিচার ব্যবস্থাপনা কি অসহায়? রাষ্ট্রের কাছে বিচার না পেয়ে জনতার আদালতে বিচার চেয়েছেন প্রবীর সিকদার। গতকাল তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, 'রাজাকার নুলা মুসা ওরফে প্রিন্স ড. মুসা বিন শমসেরের একাত্তরের কুকীর্তি ফাঁস করেছিলাম আমি ২০০১ সালের ২৪ মার্চ দৈনিক জনকণ্ঠে। তারপর আমি নৃশংস হামলার শিকার হই। অতি সম্প্রতি এক দালাল নুলা মুসাকে বঙ্গবন্ধুর সাথে তুলনা করে নিবন্ধ লিখেছে। অবশ্য এই দালালি নতুন নয়। এক সময় রাহাত খানও নুলা মুসার জুতা কীর্তন করেছে। ক্ষোভে-বিক্ষোভে আমি অনলাইন নিউজ পোর্টাল উত্তরাধিকার ৭১ নিউজে দৈনিক জনকণ্ঠে ২০০১ সালে প্রকাশিত নুলা মুসা সম্পর্কিত লেখাটি আবার প্রকাশ করি। উত্তাল হয়ে ওঠে ফেসবুক টুঁইটারসহ অনলাইন মিডিয়া। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে আমার জীবন শংকা। আমার ও আমার পরিবারের সদস্যদের জীবন শংকার কথা জানিয়ে গত ২২ জুলাই ২০১৫ সকালে ঢাকার শেরে বাংলা নগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করতে যাই। পুলিশ কর্মকর্তাদের আচরণে আমি মুগ্ধ হই। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহনের আশ্বাস দিয়ে থানার ইন্সপেক্টর তদন্ত সাব্বির আহমেদ রাতে অনুলিপি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমার কাছ থেকে সাধারণ ডায়েরির কাগজপত্র রেখে দেন। ওই দিনই বিকেলে জলিল নামের একজন এসআই আমার সাথে দেখা করে বিস্তারিত জেনে যান। তারপর তিন দিন পেরিয়ে গেলেও থানায় আমার সাধারণ ডায়েরি এন্ট্রি হয়নি। আজ দুপুরে আমি টেলিফোনে কথা বলি থানার অফিসার ইনচার্জের সাথে । তিনি বেশ আন্তরিক। আমার নিরাপত্তা বিধানেও নানা তৎপরতার কথা বললেন। কিন্তু সাধারণ ডায়েরি এন্ট্রি করার ব্যাপারে অনাগ্রহ দেখালেন। আমি এখন বাধ্য হয়ে আমার ও আমার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা শংকার সেই সাধারণ ডায়েরিটি জনতার আদালতে পেশ করলাম।'
কে প্রবীর সিকদারকে হত্যার হুমকী দিচ্ছে ? কোটিপতি মুসা বিন শমসের। এ পর্যন্ত প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ যিনি বিদেশে পাচার করেছেন। দুদকের অনুসন্ধানে আপাতত তাই বেরিয়ে এসেছে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিল কুখ্যাত রাজাকার। বহুমানুষকে হত্যা করেছেন, বহু নারীর সম্ভ্রম পাকিস্তানিদের কাছে তুলে দিয়েছেন। তার ব্যাপারে প্রথম অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন প্রবীর সিকদার। এজন্য তাকে পা হারাতে হয়েছিল। জীবনটা বাকি আছে। এবারে জীবন কেড়ে নেওয়ার উদ্যোগ। মুসা বিন শমসের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী। এই যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করতে যুদ্ধাপরাধের তদন্তকারী দল এবং প্রসিকিউসন কেন এখন পর্যন্ত নির্লিপ্ত রয়েছে তা বোধগম্য নয়।
প্রবীরদা লিখেছেন, 'আমি লক্ষ্য করছি, আমার ফেসবুক বন্ধুরাও রাজাকারের ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার হতে সংগঠিত হচ্ছেন। স্যালুট ফেসবুক বন্ধুদেরও। লড়াই আমার একার নয়। লড়াই পুরো বাংলাদেশের।'
লেখক : সাংবাদিক।
(এসএস/অ/জুলাই ২৬, ২০১৫)