আগনুকালী গ্রাম এখন বন্যপাখির অভয়াশ্রম
শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি : সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার বেলতৈল ইউনিয়নের সর্ব উওরের গ্রাম আগনুকালী। ৩৫শ’ লোকের বসবাসকৃত ছোট এই গ্রামটিকে মাত্র সাড়ে ৩ মাসের প্রচেষ্টায় মামুন বিশ্বাস ও ইমন সরকার নামের দুই যুবক বন্য পাখির অভয়াশ্রমে পরিণত করেছে।
দিন-রাতের অক্লান্ত পরিশ্রমে তাদের এই সাফল্যে গ্রাম বাসীসহ আশপাশের লোকজন মুগ্ধ হয়ে পড়েছে । ফলে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে গ্রামবাসীরাও তাদের এই কাজে সহয়োগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে । এ পর্যন্ত এ গ্রামের ১০৫ টি বৃক্ষে বিশেষ ভাবে তৈরি পাখির বাসযোগ্য ১০৫ টি মাটির কলস বেঁধে দিয়ে বন্য পাখির বসবাস নিশ্চিত করা হয়েছে।
ফলে এ গ্রামটি এখন পাখিদের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয় আশপাশের লিছিমপুর, রায়পাড়া, সিকদার পাড়া, মধ্যপাড়া, সাতবাড়ীয়া, ভেন্নাগাছি, লক্ষ্মীপুরসহ ১০টি গ্রামকেও এর আওতায় এনে বৃক্ষে কলস সেট করার কাজ চলছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী ২ মাসের মধ্যে এই গ্রামগুলিও বন্য পাখির অভয়াশ্রমে পরিণত হবে।
বাসযোগ্য বৃক্ষ নিধন, উপযুক্ত খ্যাদ্য সংকট, ক্ষেতে খামারে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক স্যার ও কীটনাশক ব্যবহার, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অপরিকল্পিত পাকা দালান কোঠা নির্মাণ ও শিকারীদের তান্ডবে এ অঞ্চলে দেশীয় প্রজাতির বন্য পাখির সংখ্যা দিন দিন আশংকাজনক হারে হ্রাস পাওয়ায় এ দু’যুবক বিষয়টি দৃষ্টিগোচরে এনে নিজ উদ্যোগে বন্য পাখির অভয়াশ্রম গড়ে তোলার ব্যতিক্রমী এ কার্যক্রম শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই এ কাজে তারা বেশ সফলতাও অর্জন করেছে ।
মঙ্গলবার সরেজমিন আগনুকালী গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, রাস্তার ধারে, পুকুরের পাড়ে, জমির পাশে, বিভিন্ন বাসা বাড়ীর গাছের ডালে ডালে মাটির কলস বাঁধা হয়েছে। এ গ্রামের সবুজ, নবী, শাহীন, কামরুল জানান, প্রথম দিকে এদেরকে সবাই পাগল বললেও এখন এ কাজে তারা উৎসাহ দিয়ে নানা ভাবে সহযোগিতা করছে । এছাড়া গ্রামের ছোট বড় সবাই এখন পাখি শিকার বাদ দিয়ে পাখির বাসযোগ্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে সহযোগিতা করছে । ফলে সকলের সহযোগিতায় গ্রামটি এখন পাখিদের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে ।
এ ব্যাপারে মামুন বিশ্বাসের সাথে কথা বলে জানা যায়, ইতিমধ্যেই তারা বন্য পাখি সংরক্ষণ, প্রজনন ও নিরাপদ বাসস্থান গড়ে তোলার লক্ষ্যে ’দি বার্ড সেফটি হাউজ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছে। এ সংগঠনের সদস্য ও কর্মী কামরুল, নবী, শাহীন, সবুজ সহ অনেকই জানান, তারা এ কাজে এলাকাবাসীর ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন। ফলে তাদের এ কাজে আরো উৎসাহ উদ্দীপনা বেড়ে গেছে। তারা আরো বলেন, এখন থেকেই বন্যপাখিদের প্রতি যত্নবান না হলে ভবিষ্যতে পরিবেশবান্ধব দেশীয় অনেক প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই আমাদের দেশ থেকে ৪১ প্রজাতির দেশীয় পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী বিলুপ্ত পাখি গুলো হলো- বাদা তিতির, মেটে তিতির, দেশি ময়ুর, সবুজ ময়ুর, বাদি হাঁস, গোলাপি হাঁস, ছোট নাটাবটের, দেশি মেটে ধনেশ, মেটে মালকোআ, মেটেমাথা টিয়া, বাংলা ডাহর,পাতি ডাহর, দেশি সারস,পাতি সারস, ডেমোজিল সারস, খয়রা ঝিলিন্ট, ধলা শকুন, হিমালয়ী গৃধিনী, সরুঠুঁটি শকুন, কালা শকুন, রাজ শকুন,ধলাপেট বক, কালা কাস্তেচরা, বড়ধলা গগণবেড়, চিতিঠুঁটি গগণবেড়, রাঙা মানিকজোড়,ধলাগলা মানিকজোড়,কালাগলা মানিকজোড়, বড় মদনটাক, ল্যাঞ্জা মোটাঠুটি, দাগিলেজ গাছআঁচড়া, লালতলা প্রিনা,শতদাগি ঘাসপাখি, বাদা ছাতারে, লালমুখ দাগিডানা, কালাবুক টিয়াঠুঁটি, তিলাবুক টিয়াঠুঁটি, লাললেজ মৌটুসি, লম্বাঠোঁট তুলিকা,গেছো তুলিকা । কালো তিতর, জলার তিতর, কাটময়ূও, বোচাহাঁস সহ ৪৭ প্রজাতির দেশীয় পাখি ইতিমধ্যেই হারিয়ে যেতে বসেছে। এখনই সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা না হলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে তা হারিয়ে যাবে।
’দি বার্ড সেফটি হাউজ’ এর উদ্যোক্তা মামুন বিশ্বাস বলেন, শুধুমাত্র আমরা পাখি শিকার থেকে অন্যকে বিরত থাকলে অসংখ্যা বন্যপাখি রক্ষা পাবে । এতে পরিবেশ ও প্রকৃতির ভারসম্য রক্ষা পাবে ।যেমন বিভিন্ন ধরনের পাখি বিভিন্ন পোকা মাকড় খায়, কোন কোন পাখি সাপ ধরে খায়, কোন পাখি ইঁদুর ধরে খায়, কোন কোন পাখি উইপোকা ধরে খায়, কেউ মশা ধরে খায় ।এতে পরিবেশ ও প্রকৃতির ভারসম্য রক্ষা পায় ।তা না হলে একদিন আমরা অথবা আমাদের প্রজন্মরাই পাবে তার বিরূপ প্রতিদান। পাখিরাই হল আমাদের প্রকৃত বন্ধু। এরাই আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ বেঁচে থাকলে আমরাও বেঁচে থাকবো।
পৃথিবীও বেঁচে থাকবে দীর্ঘ যুগ পর্যন্ত ।এ ভাবনা থেকেই বৃক্ষে কলসি স্থাপন প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রথমে মামুন তার নিজ বাড়ির গাছে পাচটি কলস বাঁধেন। কিছু দিন যেতেই এসব কলসে আশ্রয় নেয় শালিক পাখি। মামুন আর ইমন অবাক হয়ে দেখতে থাকেন পাখিদের ঘর-সংসার, বংশবৃদ্ধি। নিজেদের সাফল্যে মুগ্ধ হন এ দুইজন। এর শুরু হয় গ্রামে কলস লাগানোর কাজ ।এছাড়া গ্রামের বিভিন্ন স্থানে জনসচেতনতামূলক পোষ্টার ও ব্যানার টানানো হয় ।তারা আরো বলেন, সরকারি-বেসরকারি সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলাকে পাখির অভয়াশ্রম গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন ।
(এআরপি/এএস/জুন ২৪, ২০১৫)