সাজ্জাতুল ইসলাম সাজ্জাত : ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে গড়ে ওঠা দক্ষিণ এশিয়ার কৃষিশিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)। এখানে গত ৪১ বছরে ছাত্রজনীতির নামে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঝরে গেছে ১৬টি তাজা প্রাণ। যা কোনটিরও বিচার হয়নি। তারা সবাই একজন দক্ষ কৃষিবিদ হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই এ সবুজ ক্যাম্পাসে পা রেখেছিলেন। সেই সাথে মা-বাবাও স্বপ্ন দেখতেন, ছেলেকে নিয়ে আগামী সোনালি দিনের আশায় বুক বাঁধতেন।

শুধু ১৬ জন শিক্ষার্থীরই নয়, ১৬টি পরিবারের সেই স্বপ্ন আজ মলিন। মায়ের চোখের পানি হয়তো শুকিয়ে গেছে কিন্তু হৃদয়ের রক্তক্ষরণ আজো অঝোর ধারায় বইছে। শেষ সান্তনা ছেলের হত্যাকারীদের সুষ্ঠু বিচারও পায়নি কোনো পরিবার। অনেক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আজো আলোর মুখ দেখেনি। তাহলে কি বিশ্ববিদ্যালয়ে খুনিদের কোনো বিচার নেই ? তারা কি ধরাছোঁয়ার বাইরে ? আইনের ঊর্ধ্বে ? এমন প্রশ্ন আজ সুধি সমাজের।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে ছাত্ররাজনীতির জের ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ হয়েছে শতাধিকবার। আহত হন প্রায় সহস্রাধিক এবং নিহত হন ১৬ জন।
প্রথম খুনটি হয় ১৯৭৩ সালে। কর্মচারী-শিকক্ষ-ছাত্র সংঘর্ষে প্রথম নিহত হন রঞ্জিত। এরপর থেকে শুরু হয় হত্যার রাজনীতি। টানা ১০ বছরের শান্ত ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয় ১৯৮৩ সালে। ওই বছরে ছাত্রদলের নেতা এ টি এম খালেদ নিহত হওয়ার জের ধরে প্রতিপক্ষের বুলেটে নিহত হন ছাত্রলীগ ও বাকসুর নেতা শওকত, ওয়ালী ও মহসিন।
অতঃপর টেন্ডারবাজি, সিট দখল, বাজেট বণ্টন ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ১৯৯৩ সালে খুন হন রেজাউর রহমান সবুজ।
একে একে ১৯৯৪ সালে কর্মচারীর কলেজপড়ুয়া ছেলে, ১৯৯৫ সালে আলাউদ্দিন, শওকত, কবির ও হাসান নামে চার শিবিরকর্মী এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে খুন হন কামাল ও রণজিত নামে দুই ছাত্রলীগ কর্মী।
বাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৯৯৫ সালে হল দখল, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, বোমাবাজি ও সংঘর্ষের কারণে সে সময় খুন হন চার শিবিরকর্মী।
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এলে ছাত্রদল চার গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায়, যার ফলে ২০০১ সালে খুন হন ছাত্রদল নেতা হাসু।
এরূপ অতীত ইতিহাস নিয়ে বর্তমানে মহাজোট সরকার মতায় এলে যথারীতি ক্যাম্পাস ছেড়ে দেয় ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির। গুরুতর জখম হন ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাওন। গ্রুপিংসহ বিভিন্ন কারণে আহত হন প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী।
গত বছরের ১৯ জানুয়ারি নিয়োগবাণিজ্য, অর্থভাগ-বাটোয়ারা ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বাকৃবি ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে নিহত হয় পাশের গ্রামের ১০ বছরের ছোট শিশু রাব্বী। ছাত্রলীগের আন্তঃকোন্দল, গ্রুপিং, নিয়োগবাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাদকসহ বিভিন্ন কারণে সভাপতি ও সম্পাদক গ্রুপের সংঘর্ষের জেরেই এ হত্যাকান্ড ঘটে। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি। চার মাস পরই মুর্শেদুজ্জামান খান বাবুকে সভাপতি ও সাইফুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি গঠিত হয়।
সর্বশেষ চলতি বছরের গত ১ এপ্রিল মাসে ছাত্রলীগের দ্বন্দ্বে প্রতিপক্ষের পিটুনিতে মারা গেছেন মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের শেষবর্ষের ক্লাস প্রতিনিধি ও আশরাফুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সায়াদ ইবনে মোমতাজ (সা’দ)। সায়াদের হত্যাকরীদের বিচারের দাবিতে এখন উত্তাল ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ, প্রশাসন ভবন ঘেরাও ও গণস্বাক্ষর, প্রতিবাদী পথচিত্র অঙ্কন, স্মৃতিচারণ, গণজমায়েত, প্রতীকী অনশন প্রভৃতি কর্মসূচি পালন করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাদের সাথে একাত্মতা প্রকাাশ করেছেন শিক্ষক সমিতির নেতাকর্মীরাও। তাদের দাবি অবিলম্বে হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে নাম প্রকাশ করতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করতে হবে ও ফাঁসি দিতে হবে। তবে আদৌ হত্যাকারীদের বিচার হবে কি না এ নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। সায়াদের বাবা ছেলে হত্যার বিচারের জন্য কোনো মামলা করেননি। তিনি অভিযোগ করে বলেছেন, মামলা করে লাভ নেই। বিচার পাওয়া যাবে না। এ দিকে এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মামলা করলেও তাতে কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি। অভিযুক্ত দুই ছাত্রলীগ নেতা সুজয় কুমার কুন্ডুও রোকনুজ্জামানকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। গঠিত হয়েছে ছয় সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি। তার পরও সবার মনে প্রশ্ন আদৌ কি এ হত্যার বিচার হবে ? কেননা গত ৪১ বছরে বাকৃবি ক্যাম্পাসে ১৬টি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। সব হত্যাকান্ডের তদন্ত রিপোর্ট হিমাগারে জমাটবদ্ধ, বিচার হয়নি কোনোটির। সর্বশেষ সায়াদ হত্যার বিচার নিয়েও প্রশাসনে চলছে নানা তালবাহানা।
বাকৃবি ভিসি অধ্যাপক ড. মো: রফিকুল হক বলেন, ‘সায়াদ হত্যার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা আছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের পর দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতোমধ্যেই আমি ছয় শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করেছি, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে নজিরবিহীন। আরো একটি সম্পূরক তদন্ত কমিটির কাজ চলছে। দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।’
(এএস/মে ০৮, ২০১৪)