রূপক মুখার্জি, লোহাগড়া(নড়াইল) থেকে : এই উপমহাদেশে যখন কোন সংবাদপত্র ছিল না, ছিল না আজকের মতো স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলসহ মোবাইল নির্ভর বিনোদন সাধারনের দোরগোড়ায় পৌঁছে নাই; তখন বিশেষ বিশেষ  জনপদে গণসংস্কৃতি চালু ছিল। আর এই গণসংস্কৃতির জীবন্ত অংশ বা উপাদান হলো যাত্রা।

সাধারণ মানুষের মানস-জয়ী সেই যাত্রাশিল্প কালের পরিক্রমায় ধবংস হতে বসেছে। চলতি ধারার অপসংস্কৃতির স্রোতের ঘোলায় পতিত হয়ে ইনটেন্সিভ কেয়ারে বিভূমুখী হয়ে পড়েছে যাত্রাশিল্প। আর সেই সাথে এর সংশ্লিষ্ট সকল শ্রেণির কুশিলবরা ভালো নেই। এ শিল্পের সাথে জড়িত কুশিলবরা নিদারুন কষ্টে বেঁচে আছেন।

এরকমই একজন যাত্রাশিল্পের কুশিলব নট সম্রাট অনন্ত দাস। নড়াইলের নিকটবর্তী বাঘারপাড়া উপজেলার দোগাছি গ্রামে বসবাস করছেন নটরাজ আটাশি বছর বয়স্ক অনন্ত দাস। ১৯২৭ সালের ১২ জুন তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার স্ত্রীর নাম কবিতা দাস (৭০)। প্রচার বিমুখ এই মানুষটি তিন মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে সংসার করছেন।

অশিতিপর বৃদ্ধ অনন্ত দাস যাত্রাশিল্পের উত্থান ও পতনের জীবন্ত স্বাক্ষী। নাট্য শিল্পী হিসেবে বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ও র্স্বনালী অধ্যায় সৃষ্টিকারী এই গুণী শিল্পী অভিনয় জীবনে বাংলাদেশ-ভারতে অসংখ্য যাত্রা পালা, নাটকে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। কুঁড়িয়েছেন সুনাম। পেয়েছেন বিভিন্ন পুরস্কার।

অনন্ত দাস বাংলাদেশ ও ভারতের বিখ্যাত সব যাত্রা অপেরায় অভিনয় করে জীবন কাটিয়েছেন। এর মধ্যে আর্য অপেরা, অম্বিকা অপেরা, নটো অপেরা, সত্যম্বর অপেরা, গীতশ্রী অপেরা, নবদ্বীপ অপেরা, ভোলানাথ অপেরা, দীপালী অপেরা, জয়দুর্গা অপেরা, নাথ এন্ড কোং অপেরা, ভাগ্যলক্ষী অপেরা, রাজলক্ষী অপেরা, জয়লক্ষী অপেরা, গনেশ অপেরা, বিজন অপেরা ইত্যাদি যাত্রা অপেরায় অভিনয় নৈপূণ্য প্রদর্শন করে তিনি যাত্রামোদি দর্শকের হৃদয় জয় করেছেন। অনন্ত দাস
‘সোহরাব রুস্তম’ যাত্রাপালায় রুস্তম, ‘সিরাজুদ্দৌলা”য় নবাব, ‘নাদীর শাহ’য় নাদির শাহের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। এতে দর্শক শ্রোতা মুগ্ধ হয়ে তাকে ‘নটসম্রাট’ উপাধিতে ভূষিত করেন। যাত্রাপালায় অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি সুন্দর বাঁশি বাঁজাতেন। যাত্রা শিল্পের জন্য নিবেদিত প্রাণ অভিনেতা অনন্ত দাস। এ অঞ্চলে তিনি কীর্তিমান পুরুষ হিসেবে স্বীকৃত।
বাংলাদেশ-ভারতের লক্ষ কোটি জনতার মনোরঞ্জনের জন্য তিনি মানুষের সুখ দুঃখ, হাসি, কান্না ও জটিল ঘটনায় রসবোধ যুগিয়ে যাত্রাপালা উপস্থাপন করেছেন। তাই যাত্রা শিল্পের সাম্প্রতিক দৈন্যদশা, তাঁর মনকে ক্ষত-বিক্ষত করে। বার্ধক্যে উপনীত হয়ে যার পর নাই দুঃখ ক্লেশ, বঞ্চনা আর অবহেলায় ধুঁকে ধুঁকে মরছেন তিনি। আজ তাঁকে দেখার কেউ নেই। এককালের মঞ্চ কাঁপানো যাত্রাশিল্পী অনন্ত দাস নিদারুন কষ্টে বেঁচে আছেন। কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, পৃষ্ঠপোষক এমনকি সরকারও সুনজর দেয়নি অনন্ত দাসের প্রতি। একান্ত আলাপকালে অনন্ত দাস বলেন,সরকারের কাছে আমি আমার কাজের স্বীকৃতি চাই।


(আরএম/অ/মে ০৭, ২০১৪)