জীবনযুদ্ধে লড়ছেন মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল হক ননী
কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি : ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের অপরাজিত বীরসেনানী আজিজুল হক ননী এখনও জীবনযুদ্ধে লড়ছেন। গত ৪ বছর যাবত বিছানায় শয্যাশায়ী রয়েছেন। যে টগবগে যুবক যৌবনে দেশ মাতৃকার টানে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে স্বপ্ন বাস্তবতায় রূপ নিলেও ফেরাতে পারেননি নিজের ভাগ্য। অভাব অনটন আর দারিদ্রতাকে সঙ্গী করে বর্তমানে চরম মানবেতর জীবন যাপন করছেন আজিজুল হক ননী। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি পাক-বাহিনী কর্তৃক ধৃত হন। এরপর তার জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। পাকবাহিনীর সেলে নির্মম টর্চারিং এর মাধ্যমে রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে তার পায়ের হাড়গুলি ভেঙ্গে দেওয়া হয় এবং বেয়নেট দিয়ে সারা শরীরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পরিণত করা হয় পঙ্গু মানবে।
পঙ্গুত্ব নিয়ে এক সময় মুক্তি পেলেও দেশ নিয়ে তার চোখে ছিল অনেক স্বপ্ন। তিনি ভাবতেন দেশ স্বাধীন হয়েছে, দেশের মানুষ মুক্তি পেয়েছে এর চাইতে বড় চাওয়া একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনে আর কি থাকতে পারে। এবার নিশ্চয়ই পাক আমলে নির্যাতিত, নিপিড়ীত, বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। স্বাধীনতার পর তিনি কৃষি মন্ত্রণালয়ে চাকুরীতে যোগদান করেন। পরবর্তীতে দীর্ঘ সাড়ে সাত বৎসর কর্মসূত্রে ইটালির রোমে বাংলাদেশের দুতাবাসে চাকুরী করেন। ১৯৮০ সনে তিনি পুনরায় দেশে ফিরে কৃষি মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ঢাকার নিউ ইস্কাটনে একটি বাড়ীও বরাদ্দ পান। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হয়নি। উক্ত বাড়ীতে বসবাসরত থাকাবস্থায় একটি প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসীরা পেশী শক্তি বলে উক্ত বাড়ী জবর দখল করে। জীবনের সমস্ত উপার্জন এই বাড়ীতে রেখেই তাকে পরিবার-পরিজন নিয়ে চোখের জলে রাস্তায় নামতে হলো। এ ঘটনায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে গেলে তিনি চাকুরীচ্যুত হন। স্ত্রী ও ৩ সন্তান নিয়ে নিঃস্ব অবস্থায় পথে পথে জীবনের প্রায় ২৫টি বছর অতিবাহিত করেন। ২০০৬ সালে কিশোরগঞ্জের একজন স্থায়ী বাসিন্দা হিসাবে অনেক চেষ্টা তদবিরের পর কিশোরগঞ্জ রেলষ্টেশন সংলগ্ন গণপূর্ত অধিদপ্তরের একটি পরিত্যক্ত বাড়ী অস্থায়ীভাবে বরাদ্দ পান। দরজা জানালা বিহীন জরাজীর্ণ এই বাড়ীটিতে সামান্য বৃষ্টিতেই ছাদ থেকে পানি পড়ে। আয় উপার্জনহীন সংসারে একবেলা আধাপেটা খেয়ে কোন মতে দিন অতিবাহিত করছেন। বাড়িটি স্থায়ীভাবে বরাদ্দের জন্য ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী , ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করীম হীরা বরাবরে আবেদন করলে ভূমিমন্ত্রী বাড়িটিকে স্থায়ীভাবে বরাদ্দের জন্য তৎকালীন জেলা প্রশাসককে লিখিতভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এদিকে ২০১০ সালে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো.হেমায়েত হোসেন স্বাক্ষরিত এক পত্রে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল হক ননীকে কিভাবে পুনর্বাসিত করা যায় সে বিষয়ে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এখনও পর্যন্ত তার বাড়িটি স্থায়ী বরাদ্দপত্র না পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে থাকতে পারছেন না। সবসময় মৃত্যুর চিন্তায় ও বাড়ি হারানোর শংকায় দিনাতিপাত করছেন। বাড়ির বরাদ্দ পাওয়ার বিষয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের (রাজাস্ব) শাখার প্রধান সহকারী আ.রশিদ এর কাছে সম্প্রতি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল হক ননীর স্ত্রী মনজিলা খাতুন যোগাযোগ করতে গেলে বিভিন্ন টালবাহানা দেখিয়ে তাঁকে গালমন্দ করে তাড়িয়ে দেন বলে জানান। বিষয়টি জানার জন্য (রাজস্ব) শাখার প্রধান সহকারী আ.রশিদকে জিঞ্জাসা করা হলে তিনি বলেন, সারাদিন অফিসিয়াল কাজকর্মে ব্যস্ত থাকি আর সেসময়ে ওই মহিলা এসে বিরক্ত করেন। এতে করে আমাদের কাজে জটিলতা সৃষ্টি হয়। বাড়িটি যেহেতু গণপুর্ত অধিদপ্তরের তা স্থায়ী বরাদ্দ দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এছাড়াও সে বাড়িতে থাকা কদ্দুছ নামে আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন তিনিও এসে বাড়ি বরাদ্দের দাবী করেন। বাড়িটি স্থায়ী বরাদ্দের বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা ননীর আবেদনকৃত ভুমি মন্ত্রণালয় থেকে প্রেরিত পত্রের বিষয়ে জেলা প্রশাসক এস.এম.আলম এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন,্ এ বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এর কাছে বিষয়টি জেনে নিতে পারেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কাজী আবেদ হোসেন এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, যেহেতু তিনি (মুক্তিযোদ্ধা ননী) এখনও বাড়িটিতে বহাল আছেন। মন্ত্রণালয় থেকে বাড়ি বাতিল বা তাকে কেহ তাড়িয়ে এমনকি উচ্ছেদ করেও দিচ্ছেন না। এতে করে তার কোন সমস্যাও নেই। জেলা প্রশাসনে যোগাযোগ করতে এসে তার স্ত্রী গালমন্দ শুনবে কেন? সরাসরি তাকে আমার কাছে আসতে বলবেন। আমিই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল হক ননী বলেন,১৯৭১ সালের আগষ্ট মাসে দেশের প্রখ্যাত শিল্পী ও সুরকার আলতাফ মাহমুদ, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে রুমী, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার কৃতি সন্তান আমার আত্বীয় অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলম বদি পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন কাইয়ুম এর কাছে ধৃত হন। সেদিন আমিও তাদের কবলে পড়েছিলাম। পরবর্তীতে আমি রক্ষা পেলেও ঘাতক পাকিস্তানী হানাদাররা এই সাহসী সন্তানদের কোথায় নিয়ে হত্যা করেছেন তা আর জানা যায়নি। স্বাধীনতা উত্তর বঙ্গবন্ধু সরকার শহীদ বদিউল আলমকে মরনোত্তর ’বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করেন। কিন্তু আমাদেরকে কোন খেতাব দেওয়া হয়নি। কিশোরগঞ্জ ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদের সাধারন সম্পাদক লেখক ও গবেষক আমিনুল হক সাদী বলেন, প্রতি বছর যথারীতি ১৬ ডিসেম্বর আসে, জনতা বিজয় স্তম্ভে ফুল দেয়, শ্রদ্ধাবনত চিত্তে মুক্তিযোদ্ধাদের কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা জানায়। মুখে মুখে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বের কথা বলে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে। কিন্তু বাস্তবতা বড় ভিন্ন,বড় ব্যতিক্রম। যে মুক্তিযোদ্ধা (আজিজুল হক ননী) একবেলা খাবার জোটে না, চিকিৎসার অভাবে কঙ্কাল শরীর নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনে- মৃত্যুর পরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় হয়ত তার দাফন হবে। বিউগলে করুণ সুর বাঁজাবে, মুক্তিযুদ্ধে তার বীরত্বগাথা উচ্চারিত হবে। অথচ নিজের একটি আবাসস্থলে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারবেনা কি না এর কোন নিশ্চয়তা নেই।
আজিজুল হক ননী আক্ষেপ করে বলেন, জীবনের শেষ ক’টি দিনগুলিতে তার মাথাগোজার ঠাইটুকু সংস্কার ও সরকারের পক্ষ থেকে তাকে যেন এ বাড়িটি স্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়, তিনি যেন কোনক্রমে একবেলা আধবেলা খেয়ে জীবনের বাকি দিনগুলো পার করে দিতে পারে এটাই এখন বাংলাদেশের মাননীয় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান সরকারের নিকট আমার একমাত্র চাওয়া।
(পিকেএস/পি/ডিসেম্বর ১৬, ২০১৪)