সালথায় টাকা ছাড়া মিলে না পেঁয়াজ সংরক্ষণের ঘর

আবু নাসের, সালথা : ফরিদপুরের সালথায় পেঁয়াজ সংরক্ষণের মডেল ঘর নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। টাকা ছাড়া মিলছে না পেঁয়াজ সংরক্ষণের মডেল ঘর। শুধু তাই নয়, প্রকৃত যোগ্য কৃষকদের বাদ দিয়ে টাকার বিনিময় অযোগ্য কৃষকদের ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে যারা এই মডেল ঘর পেয়েছেন, তাদের অনেকেরই ঘর নির্মাণ এখনো শেষ হয়নি। অথত পেঁয়াজ উঠানো শেষ হয়েছে আরো একমাস আগে। যে কারণে বিপাকে পড়েছেন কৃষকেরা। অন্যদিকে বরাদ্দ পাওয়া কৃষকদের প্রশিক্ষণের বরাদ্দও আত্মসাৎ এর অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, ফলন ও দাম ভাল হওয়ায় প্রতিবছরই সালথায় বাড়ছে পেঁয়াজের আবাদ। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে এখানকার উৎপাদিত পেঁয়াজের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশই পঁচে নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে পেঁয়াজ চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। এমন অবস্থায় পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল প্রান্তিক পেঁয়াজ চাষিরা। এর ফলে এই বছর কৃষিবিপণণ অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন কৃষক পর্যায়ে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণ পদ্ধতি আধুনিকায়ন এবং বিপণন কার্যক্রম উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় সালথায় ৪৫টি ঘরের বরাদ্দ দেওয়া হয়।
সালথা উপজেলা কৃষি অফিস থেকে কৃষদের নাম পাঠালেও কোন কৃষক পাননি ঘর। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তা শাহজাহান আলী ও আধুনিক পদ্ধতিতে পেয়াজ ও রসুন সংরণাগার নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হেলাল উদ্দিনের যোগসাজশে টাকার বিনিময়ে দেওয়া হয়েছে এ সকল সরকারি ঘর। এছাড়া ঘরের ডিজাইন বিকৃত করে নির্মাণ করা হচ্ছে। ঘর নির্মাণে অথবা বিতরণের বিষয়ে কোন মতামত নেওয়া হচ্ছে না সালথা উপজেলা প্রশাসন ও কৃষি অফিসের। এমনকি সালথা উপজেলা প্রশাসন ও কৃষি অফিসে নেই এ সকল ঘরের তালিকা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাঁচ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রতিটি ঘর বাড়ির উঠান বা ফাঁকা জায়গায় মাত্র এক শতাংশ জমিতে টিন-বাঁশ, লোহা ও কংক্রিটের সমন্বয়ে তৈরি করা হচ্ছে। এই ঘরের আয়তন প্রায় ৩৭৫ বর্গফুট। প্রতিটি ঘরে বাতাস চলাচলের জন্য ৬টি বায়ু নিষ্কাশন পাখা সংযুক্ত রয়েছে। মূলত ভ্যান্টিলেশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকার কারণেই সংরক্ষিত পেয়াজ পঁচবে না। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা পরিমাপের জন্য প্রতিটি ঘরে হাইগ্রোমিটার রয়েছে। প্রতিটি ঘরে সংরক্ষণ করা যায় সাড়ে ৩শ থেকে ৪শ মণ পেঁয়াজ। প্রতিটি ঘরে আলাদা আলাদা স্তরে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে পারবেন অন্তত পাঁচজন কৃষক। এ ঘরে নয় মাস পর্যন্ত পেঁয়াজ ভালো থাকে।
পাঁচ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য প্রতিটি ঘর গত বছরের নভেম্বর মাসে ফরিদপুরের মেসার্স জাকির এন্ড ব্রাদার্স ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ৭% লেস দিয়ে এই ঘরগুলোর কাজ শুরু করেন। চলতি বছরের ৩০ মার্চ ঘরের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও ঠিকাদার ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের উদাসিনতার কারনে এখনো ঘরগুলোর কাজ শেষ হয়নি। অধিকাংশ ঘরের কাজ শুরু করলেও একটি ঘরের কাজও সম্পূর্ন করেতে পারেনি। এমনকি কিছু কিছু ঘরের কাজ এখনো শুরুই করা হয়নি। পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণের দেশীয় মডেল ঘরের আশায় পেঁষাজ চাষিরা তাদের পুরাতন ঘর মেরামত না করায় এখন পেঁয়াজ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা কৃষি অফিসের মাঠ কর্মীরা জানান, ৪৫ টি মডেল ঘরের আওতায় ৪৫০ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া কথা। প্রশিক্ষণ বাবদ প্রত্যেক কৃষকের জন্য ১ হাজার করে টাকা বরাদ্দ রয়েছে। সেই হিসেবে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ পেয়েছেন। কিন্তু মাত্র ৪০ থেকে ৫০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অতএব কৃষকদের প্রশিক্ষণ বরাদ্দ থেকেই অন্তত ৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া প্রতিটি ঘরই মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময় দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ঘর নির্মাণ কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ও ডিজাইন পরিবর্তণ করে প্রায় অর্ধেক বরাদ্দ হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সালথা উপজেলার যদুনন্দি ইউনিয়নের কাজীপাড়ার মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমি এই বছর ৬-৭শ মন পেঁয়াজ পেঁয়েছি। পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণের দেশীয় মডেল ঘরের আশায় আমি পিয়াজ সংরক্ষনের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করি নাই। ঘরের ঠিকাদারের চাহিদামত টাকা না দেওয়ায় আমার ঘরের কাজ এখনো শুরু করা হয়নি। তাই আমি বাধ্য হয়ে কম দামে পিঁয়াজগুলো বিক্রি করে দিয়েছি। এতে আমার কয়েক লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গট্টি ইউনিয়নের কানইড় গ্রামের ঘর পাওয়া এক কৃষক বলেন, আমি ১০ হাজার টাকা খুশি হয়ে শাহজাহান স্যারকে দিয়েছি। অন্যরা ৫০ হাজার থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত দিয়ে ঘর পেয়েছে।
রামকান্তুপুর ইউনিয়নের নারানদিয়া গ্রামের শাহিদ মিয়া বলেন, টাকা ছাড়া কি ঘর পাওয়া যায়? ঘর পেতে ৫০ হাজার টাকা লাগে। তবে টাকাটা কাকে দেওয়া লাগবে তার নামটি বলেননি।
বল্লভদী ইউনিয়নের পশ্চিম পিশনাইল গ্রামের নান্নু মোল্যা বলেন, ঘরের সকল খরচ সরকার বহন করার কথা থাকলেও মিস্ত্রি খাবারের খরচ আমাদের বহন করা লাগতেছে। এছাড়া আমরা ঘরের ফ্লরে বালু না দেওয়া পর্যন্ত ঠিকাদারের লোক কাজে আসবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। তাই ঘরের ফ্লরের বালুও আমরা দিয়েছি।
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স জাকির এন্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মো. জাকির হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা কোন অতিরিক্ত টাকা পয়সা নিচ্ছি না । মিস্ত্রিদের খাওয়াচ্ছে ওই কৃষক নিজে স্বেচ্ছায় । আর যে সকল ঘরে বেশি বালু লাগছে সেই ঘরে ওই কৃষকই বালু ফেলে দিচ্ছে এবং যে ঘর গুলোতে বেশি মেটেরিয়ালস খরচ হচ্ছে সেই বেশি মেটেরিয়ালস এর টাকা গুলো কৃষকদেরকে দেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে । কারণ সমতল জায়গায় ঘর গুলো করার কথা ছিল। অনেক কৃষক সেই সমতল জায়গায় ঘর গুলো করছে না বিধায় এই সমস্যাটা তৈরি হচ্ছে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তা শাহজাহান আলী টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, সালথায় সরকারী ঘর বরাদ্দের চেয়ে চাহিদার বেশি থাকায় আমরা সবাইকে ঘর দিতে দিতে পারি নাই। তাই আমার নামে উল্টাপাল্টা কথা বলছে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারবো না। আরো কিছু জানার দরকার হলে প্রকল্প পরিচালকে ফোন করেন। কারন তিনি নিজে এই এলাকায় এসে কৃষকদের বাড়িতে গিয়ে যাচাই-বাছাই করে ঘর গুলো দিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে দেখেন আমি অনেকের বাড়িতে যেয়ে পানি পর্যন্ত খাই না।
সালথা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুদর্শন শিকদার বলেন, মডেল ঘর পাওয়ার জন্য সালথা উপজেলা কৃষি অফিসে ৭০ জন কৃষক আবেদন করেন। কৃষি অফিস যাচাই-বাছাই করে ৩০ জন কৃষকের নাম প্রকল্প পরিচালকের কাছে পাঠানো হয় কিন্তু এই তালিকা থেকে কাউকেই ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এছাড়া কারা এসকল ঘর পেয়েছে সে বিষয়েও আমাদেরকে অবগত করা হয়নি।
সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান বালী বলেন, ঘর বিতরণ, নির্মান ও টাকা নেওয়ার বিষয়ে আমাদের কাছে কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব।
ফরিদপুর জেলার সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন এই বিষয়ে প্রকল্প পরিচালকের সাথে কথা বলতে বলেন।
আধুনিক পদ্ধতিতে পেয়াজ ও রসুন সংরণাগার নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হেলাল উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, এই মডেল ঘরগুলো পাওয়ার জন্য গণবিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছিল। গণবিজ্ঞপ্তির প্রকাশ হওয়ার পরে কৃষকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যাচাই-বাছাই করে ঘরগুলো কৃষকদের সুবিধার্থে বিনামূল্যে দিয়েছে । টাকা-পয়সা নিয়ে ঘর দেয়ার কোন সুযোগ নেই। টাকা পয়সা নিয়ে ঘর দেয়ার ব্যাপারে আমরা অবগত নই। আর আমাদের ডিজাইনের বাহিরে ঘর করা বা বাড়তি টাকা নিয়ে ঠিকাদার ঘর করে দিবে এই ধরনের কোন সুযোগ রাখা হয়নি। টাকা পয়সা লেনদেনের বিষয়ে যদি কোন কৃষক আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দেয় তাহলে আমরা তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী এই ঘরের কাজ ৩০ শে মার্চ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন কারণে ঠিকাদার ৩০ শে এপ্রিল পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে নিয়েছেন। ৩০ শে এপ্রিল ভিতরে এই ঘরের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। আমাদের জানামতে ৭০ পারসেন্ট ঘরের কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে।
(এএনএইচ/এএস/এপ্রিল ২৯, ২০২৫)