মোহাম্মদ সিরাজ আল মাসুদ, টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলের দুই গ্রামের মানুষ ৫ বছর ধরে  সাপ্তাহিকভাবে পাড়া মহল্লায় মুষ্টির চাল তুলে বাজারে বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করেছেন। চাল বিক্রির টাকা এবং নিজেরা কিছু টাকা জমিয়ে চলাচলে অনুপযোগী রাস্তা সচল করতে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে মাটি ফেলেছেন তারা। 

তবে ক্ষুদ্র সামর্থে সম্পূর্ণ রাস্তা মেরামত সম্ভব না হওয়ায় প্রশাসনের কাছে স্থায়ীভাবে রাস্তা পাকা করার দাবি গ্রামবাসীর।

ডুবাইল ও গবড়া নামের গ্রাম জেলার দুই উপজেলা দেলদুয়ার ও মির্জাপুরের সীমান্তে এলাকায়।

স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার হয়ে গেলেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি প্রত্যন্ত এই গ্রাম দু’টিতে। এক কিলোমিটার দীর্ঘ ভঙ্গুর এই রাস্তাটাই গ্রামগুলোয় যাতায়াতের একমাত্র পথ। এবড়োখেবড়ো এ রাস্তায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও কেউ অসুস্থ হলে অনেক কষ্ট করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়।

বিকল্প কোন রাস্তা না থাকা ও সরকারি কোন উদ্যেগ না নেওয়ায় দুই গ্রামের সাধারণ মানুষ মুষ্টির চাল তুলে স্বেচ্ছা শ্রমের মাধ্যমে এ রাস্তাটি সংস্কারের কাজ শুরু করেছেন।

ভোটের সময় জনপ্রতিনিধিদের মায়াকান্না আর প্রশাসনের মিথ্যে আশ্বাসে বসে না থেকে নিজেরাই চলাচল উপযোগী রাস্তা গড়ে তুলেছেন বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী । তবে প্রশাসনের কাছে তাদের দাবি- দুই গ্রামের হাজারো মানুষের চলাচলের একমাত্র রাস্তাটি যেন পাঁকা করে দেওয়া হয়।

গবড়া গ্রামের ৪৫ বছর বয়সী শাজাহান মিয়া বলেন, “এই রাস্তা নিয়ে আমরা সবার কাছে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু কেউ কোনো গুরুত্ব দেয় না। অনুদান আসে, অন্য দিকে চলে যায়। তাই আমরা রাস্তাটা সবাই মিলে মেরামত করতেছি। কিন্তু এখন তো টাকা পয়সা কিছু নাই।”

স্থানীয়রা জানান, গ্রাম দুটি নিচু এলাকা হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে গ্রামীণ এই কাঁচা রাস্তাটি পানির নিচে তলিয়ে যায় । তখন নৌকায় চলাচল করতে হয়। পরে শুষ্ক মৌসুমে রাস্তা চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়ে। অল্প বৃষ্টিতেই যানবাহন চলাচলতো দূরের কথা কাঁদা মাটিতে হেঁটে চলাচলই দায় হয়ে পড়ে। এলাকার একমাত্র রাস্তাটি চলাচল অনুপযোগী হওয়ায় ছেলে-মেয়েদের ভাল জায়গায় বিয়েও হচ্ছে না বলে জানান স্থানীয়রা।

গ্রামবাসী জানায়, বাধ্য হয়ে ৫ বছর ধরে দুই গ্রামের মানুষ মিলে সাপ্তাহিকভাবে পাড়া মহল্লায় মুষ্টির চাল তুলছেন। সংগ্রহ করা চাল বাজারে বিক্রি করে সেই টাকা এবং নিজেরা কিছু টাকা জমিয়ে চলাচলে অনুপযোগী রাস্তা সচল করতে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে মাটি ফেলেছেন। কিন্তু তাতেও তারা পুরো কাজ শেষ করতে পারেননি।

রাস্তাটি পাকা হলে দুই উপজেলা ছাড়াও বাসাইল উপজেলার হাজারও মানুষের উপকার হবে বলে জানান স্থানীয়রা।

সোহেল, মাহীন,সজীব, তোফায়েল সহ এলাকার তরুণরা বলেন, “কতো বছর যাবত এই রাস্তা অবহেলিত, শত চেষ্টা করেও চেয়ারম্যান, মেম্বার,এমপির কাছে আবেদন করেও কোন লাভ হয়নি। তারা কেউই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন নি। শেষ মুহূর্তে আমাদের মুষ্ঠি ফান্ডের টাকায় আমরা কিছু কাজ করেছি, তারপরেও আমরা কাজ পরিপূর্ণ করতে পারি নাই।”

তিনি বলেন, “সারা বাংলাদেশে ডিজিটাল হইছে, মির্জাপুর থানার শেষ প্রান্ত দেলদুয়ার উপজেলার এই অঞ্চল কি ডিজিটালে পড়ে না। প্রশাসন-কর্মকর্তার কাছে আবেদন করতেছি আমাদের ৪০ বছরের ভুক্তভোগী রাস্তাটা অবহেলিত রাস্তায় দৃষ্টি দেন, কাজ করে দেন- আমরা রক্ষা পাবো।”

৬০ বছর বয়সী মো. আলী আজম বলেন, গ্রামে একটা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠান আছে। একটা হাফিজিয়া খানা আছে। এখানে সামান্য বর্ষা হলেই কোমর পর্যন্ত পানি হয়ে থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাচ্চারা যাতায়াত করতে পারে না। নৌকা-টৌকা এখন চলেই না।

“তাছাড়া এই এলাকার দিকে কেউ নজরও দেয় না। চেয়ারম্যান মেম্বার যারাই আসে, যখন এমপিরা আসে, যখন নির্বাচন হয় তখন তারা আগে উল্লেখ করে গবড়ার এই রাস্তাটা কইরা দিমু। এমপি হইয়া গ্যালে আর আমাদের খবর বার্তা নাই।”

গবড়া গ্রামের এই প্রবীণ বলেন, “আমাদের পরিবার নিয়ে কোথাও যাওয়ার উপায় নাই। একটা রুগী হাসপাতালে নেওয়ার মতো কোনো ক্ষমতা নাই। আমাদের সমিতিতে কিছু টাকা ছিলো। যতটুকু পারছি করেছি। এখন আমাদের আর উপায় নাই, সামর্থ্যও নাই।”

শিক্ষার্থী নাজমা আক্তার (২০) বলেন, “ছোটবেলা থেকে এই রাস্তাটা এরকমই দেখতেছি। বর্ষাকালে কলেজে যাইতে কষ্ট হয়।”

ডুবাইল গ্রামের আমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা নিজের উদ্যোগে রাস্তাটা সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করতেছি। আমাদের যতটুকু সম্ভব, ততটুকু বাস্তবায়ন করতে পারতেছি। ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি মেম্বার এবং দয়াবান ব্যক্তিদের আহ্বান জানাচ্ছি এই রাস্তাটা দ্রুত তৈরি করলে সবাই চলাচল করতে পারে।

মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ. বি. এম. আরিফুল ইসলাম বলেন, “বিষয়টি আমাকে কেউ অবগত করেনি। স্থানীয়দের কিভাবে সহযোগিতা করা যায় তা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “যোগাযোগ করা হলে সরেজমিন পরিদর্শন করে গুরত্বপূর্ণ এই রাস্তাটি দ্রুত সংস্কার করার চেষ্টা করা হবে।

(এসএম/এএস/এপ্রিল ২৯, ২০২৫)