রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের ভয়ভীতি নয়, স্বস্তির বার্তা দিন

চৌধুরী আবদুল হান্নান
পত্রিকায় আতঙ্ক সৃষ্টির খবর বেশি থাকে, স্বস্তিদায়ক খবর চোখেই পড়ে না। প্রবাস থেকে বৈধপথে আনা রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিকে কীভাবে শক্তিশালী করে আর অর্থ পাচার দেশকে কতটা দুর্বল করে তা ভালো বুঝবেন অর্থনীতিবিদরা। তবে একজন নাগরিক হিসেবে এ বিষয়ে আমার কৌতূহল আছে এই জন্য যে, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি হলে, দেশ থেকে অর্থ পাচার হলে তার নেতিবাচক অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রতিটি নাগরিক।
রাষ্ট্রের বৈদেশিক মুদ্রার অভাব হলে জরুরি প্রয়োজনে খাদ্য সামগ্রী বা জীবন রক্ষাকারী ঔষধ আমদানি করতে পারে না এবং তাতে রাষ্ট্র অকার্যকর হওয়ার শঙ্কা তৈরি হতে থাকে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে দেশে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে অনুকুল অবস্থা তৈরি করতে হবে। কারণ যে কোনো সংকটে বড় ভরসার স্থল প্রবাসী আয়।
৭৩০ কোটি টাকার প্রবাসী আয় নিয়ে প্রতীক গ্রুপের চেয়ারম্যান জনাব ফারুকী হাসানকে নিয়ে প্রথম আলো ১৭ মার্চ প্রকাশিত খবরটা রীতিমতো আতঙ্কিত হওয়ার মতো। আরও বলা হয়েছে, প্রবাসী আয়ের নামে এক ব্যাক্তির এত বিপুল অর্থ আনার বিষয়টি কর কর্মকর্তাদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আমার মনে হয়েছে ব্যাংক খাত দখলে রাখা দুর্বৃত্তদের মতো আর এক বড় দুর্বৃত্ত এবার সামনে আসছে।
ব্যাংক ব্যবস্থার নিদারুণ দুরবস্থা সকলের জানা, এ বিষয়ে কোনো ভালো খবর নেই, ভয়াবহ খবর ছাড়া। সে কারণে প্রথমেই খারাপ ভাবনাটা মাথায় আসে।
পরবর্তীতে জনাব ফারুকী তাঁর ৭৩০ কোটি টাকা প্রবাসী আয় দেশে আনার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, বৈধ আয়ের অর্থই তিনি দেশে এনেছেন। নিয়ম মেনে সেই অর্থ আয়কর নথিতেও দেখিয়েছেন। তাঁর এমন স্পষ্ট দাবির পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এ বিতর্ক নিরসনে কোনো ব্যাখ্যা দিয়েছে কিনা তা জানা যায়নি। বিলম্বে এ বিষয়ে যত ব্যাখ্যাই দেওয়া হোক, ইতোমধ্যে প্রবাসীদের মধ্যে যে নেতিবাচক বার্তা পৌছে গেছে তা দূর করা সহজ হবে না।তবে প্রতীক গ্রুপের চেয়ারম্যান ওই টাকা দেশে এনেছেন তাতে তো কোনো সন্দেহ নেই। এই অর্থ তিনি দেশে না এনে বিদেশে কোনো সুবিধাজনক শহরে সেকেন্ড হোম বানাতে পারতেন, কোনো সমস্যা ছিল না। অথচ বিদেশে নিজের অর্জিত অর্থ বৈধভাবে দেশে এনেও কত বিড়ম্বনা।
এসব ব্যাপারগুলো মানুষকে আতঙ্কিত না করে চুপচাপ সুরাহা করাই যৌক্তিক।এ জাতীয় খবর প্রবাসীদের মধ্যে কেবল আতঙ্কই সৃষ্টি করবে না, বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতেও উৎসাহ হারাবেন এবং সেক্ষেত্রে তারা হুন্ডির পথ বেছে নিতে পারেন।
কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনা বা স্বজনপ্রীতি পরিহার করে মেধা এবং যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। অর্থ ও বানিজ্যবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি দৌলত আক্তার মালা এক মতবিনিময় সভায় করদাতাদের ভয়ভীতি দূর করার পরামর্শ দেন।
শিক্ষিত লোকদের মধ্যে অনেকেই দেশ থেকে সব বিক্রি করে নিয়ে যায় পছন্দের দেশে বসবাস করবে বলে; আরেক দল বিদেশে টাকা পাচার করে সেখানে সেকেন্ড হোম তৈরি করতে কিন্ত প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকরা দেশে টাকা পাঠান তাদের স্বজনদের জন্য যা রাষ্ট্রের বৈদেশিক মুদ্রা ভান্ডার সম্মৃদ্ধ করে এবং তাঁরাই প্রকৃত রেমিট্যান্স যোদ্ধা।
সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশে অস্বাভাবিক তাপমাত্রায় কঠিন সব পরিশ্রমের কাজ করে তাঁরা উপার্জন করেন। কিন্ত তাদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের ভোগান্তির শেষ থাকে না।
বিগত দিনে বিশেষ করে পতিত সরকারের আমলে অবাধে বিদেশে অর্থ পাচার হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের উদ্ধৃতি দিয়ে গত ডিসেম্বরে নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন বলছে, হাসিনা শাসনের ১৫ বছরে কেবল বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনা থেকেই ১৭০০ কোটি ডলারের সমপরিমান অর্থ পাচার হয়েছে। এ অর্থের সিংহভাগই পাচার হয়েছে ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে আমদানি-রপ্তানি বানিজ্যের মাধ্যমে। এভাবে পাচারকৃত বিপুল অর্থ কখনও দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে, তা কেউ মনে করে না। কারণ অতীতে এমন কোনো নজির নেই। বিগত সরকারের সময় ব্যাংক ও আর্থিক খাত ছিল কার্যত অভিভাবকহীন এবং সে কারণেই শীর্ষ নেতারা অর্থ আত্মসাতের জন্য বেছে নেয় ব্যাংক।
পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বৈধ পথে পাঠানো প্রবাসী আয় উল্লেখযোগ্য পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় উৎস রপ্তানি ও প্রবাসী আয়।
প্রবাসী আয় পাঠানোকে উৎসাহিত করতে বিদ্যমান করমুক্ত সুবিধা এবং নগদ প্রণোদনা ছাড়াও আরও কিছু সুবিধা দেওয়া যায় কিনা তাও ভাবতে হবে।
প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যারা অর্থ পাচার করে, বিভিন্ন দেশে যাদের বাড়ি, সম্পদ রয়েছে তারা চেনা মানুষ। তাদের চিনে নেওয়া আরও সহজ হয় যদি বিশ্বব্যাপী অবৈধ অর্থের লেনদেন নজরদারি সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি এর সাথে কৌশলগত যোগাযোগ রক্ষা করা হয়। সব সরকারই পাচারকারীদের পাকড়াও করার কথা বলেছে কিন্ত কেউ শক্ত অবস্থান নেয়নি, কারণ তাতে যে আপন লোকের ওপরই আঘাত আসে।
অতীতে কেউ ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাচার ঠেকাতে বা পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে আন্তরিক ছিল না, যা করা হয়েছে তা কেবলই লোক দেখানো, আই ওয়াস।
রেমিট্যান্স যোদ্ধারা বিদেশে থেকেও নিজ দেশের সংকটকালে দেশের জন্য অবদান রাখতে দেখা গেছে এবং স্বৈরচারী সরকার পতনের আন্দোলনে একাত্ম হওয়ায় বিদেশে তাঁদের কারাদন্ড ভোগ করতে হয়েছে।
বিমান বন্দরে তাঁদের ভিআইপি সেবা বা স্যার সম্বোধন করার ভাবনা খুবই ইতিবাচক কিন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মানসিকতা ওই পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পূর্বে তাদের সাথে ভদ্রোচিত আচরণ এবং বিধিমতো ন্যায্য প্রাপ্য নিশ্চিত করা জরুরি।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।