রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : ঘেরের জমি ছেড়ে দিতে রাজী না হওয়ায় প্রশান্ত বিশ্বাস নামে এক মৎস্য ঘের মালিককে বাসা গভীর রাতে বাসা থেকে তুলে এনে পিটিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছে এক জামায়ত নেতা। মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২ টার দিকে সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা থানাধীন কাশিয়াডাঙা বিলে এ ঘটনা ঘটলেও মীমাংসার নামে কালক্ষেপন করে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।

বৃহষ্পতিবার সকালে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের জরুরী বিভাগে অবস্থান করা পাটকেলঘাটা থানাধীন খলিশখালি ইউনিয়নের কাশিয়াডাঙা গ্রামের পূর্ণ চরণ বিশ্বাসের ছেলে প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস (৩৫) জানান, ২০১৯ সাল থেকে তিনি একই গ্রামের আইনুদ্দিন গাজীর কাছ থেকে চার বিঘা ও হরিপদ ঘোষের কাছ থেকে সাড়ে তিন বিঘা জমি বিঘা প্রতি ১৪ হাজার টাকায় লীজ নিয়ে মৎস্য ঘের পরিচালনা করে আসছেন।

২০২৬ সালে লীজের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। সম্প্রতি তিনি ঘের করার জন্য অন্য একজনকে অংশীদার নিতে চাইলে কাশিয়াডাঙা গ্রামের আনছার মোড়লের ছেলে ৬নং ওয়ার্ড জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ রাজী হয়ে যান।

একপর্যায়ে তিনি চলতি বাংলা সনের পৌষমাসে মাছ ধরার পর আইনুদ্দিন গাজীর অংশ আব্দুল্লাহকে লীজ দিতে রাজী জন। বিষয়টি তিনি জমির মালিক আইনুদ্দিন গাজীকে অবহিত করলে তিনি অন্য কাউকে জমি লীজ না দিয়ে নিজে করার সিদ্বান্ত নেন। এতে ক্ষুব্ধ হন আব্দুল্লাহ। বাধ্য হয়ে তিনি ২০২৬ সাল পর্যন্ত ঘের করার সিদ্বান্ত নেন।

প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস আরো জানান, বাড়ি থেকে খাওয়া দাওয়া শেষে মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে তিনি ঘেরের বাসায় যান।রাত ১২টার দিকে তিনি ঘেরের বাসায় অবস্থান করাকালিন আব্দুল্লাহ ও পাশের ঘেরের মালিক শফিক মোড়ল সেখানে হাজির হন। আব্দুল্লার হাতে লোহার রড ছিল। জমির লীজের চাইলে এখানে নেই বলায় আব্দুল্লাহ তাকে বাসা থেকে ধরে লোহার রড দিয়ে পেটাতে পেটাতে ঘেরের বাসার ভেড়ির উপর নিয়ে আসে। মারপিটের একপর্যায়ে তিনি প্রায় অচেতন হয়ে পড়লে শফিক মোড়ল তার কাছ থেকে রড কেড়ে নেয়। এরপর আব্দুল্লাহ চলে গেলে শফিক মোড়ল বিষয়টি পার্শ্ববর্তী ঘের মালিক অরুণ মোড়লকে ডেকে আনেন। অরুন মোড়ল বিষয়টি মোবাইল ফোনে খবর দেওয়ায় ঘেরের বাসায় চলে আসেন তার বাবা পূর্ণচরণ বিশ্বাস, ভাইপো সঞ্জীব বিশ্বাস, কাকা অরবিন্দ বিশ্বাস ও কাকার ছেলে সুকান্ত বিম্বাস। কিছুক্ষণ পরে সেখানে হাজির হন একরামুল মোড়ল ও আরিবুল্লাহ মোড়ল। একপর্যায়ে তাকে একটি ভ্যানে করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। রাতেই গ্রাম্য চিকিৎসক কামরুল ইসলাম তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পরদিন সকালে আবার আসবেন বলে চলে যায়। বিষয়টি ৬ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রবিউল ইসলামকে জানানো হলে তিনি তাকে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন।

বুধবার সকালে ডাঃ কামরুল জানান, যে ইউনিয়ন জামায়াতের আমীর মাষ্টার শহীদুল্লাহ হাসপাতালে না পাঠিয়ে তাকে চিকিৎসা করানোর জন্য বলেছেন। একইসাথে চিকিৎসা খরচ বহন করে এশারের নামজের পর মীমাংসা করে দেবেন বলেছেন। ওইদিন সন্ধ্যায় ইউনিয়ন জামায়াতের আমীর মাষ্টার শহীদুল্লাহসহ একই এলাকার আব্দুস সাত্তার, আব্দুল আজিজ তার বাড়িতে আসেন। পরে শহীদুল্লাহ মাষ্টার মীমাংসার দায়িত্ব আব্দুস সাত্তারের উপর দেন। তার (প্রশান্ত) বাড়িতে বা সাত্তারের বাড়িতে শালিসি বৈঠক না বসিয়ে স্থানীয় কাশিয়াডাঙা দাখিল মাদ্রাসার মাঠে বসাবসির সিদ্ধান্ত হয়।

বুধবার আব্দুস সাত্তারের বোন মারা যাওয়ায় বসাবসি হয়নি। তবে বুধবার রাতে আব্দুস সাত্তারসহ কয়েকজন তাদের বাড়িতে এসে কয়েকদিন পর বসাবসি করা হবে বলে জানিয়ে দেন। বিষয়টি তিনি সাবেক ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ভাইপো বিএনপি নেতা রিপনকে জানালে তিনি সদর হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেন। সবশেষে তিনি একটি ইজিবাইকে এসে সদর হাসপাতালে ভর্তি হন।

কাশিয়াডাঙা গ্রামের নেছার শেখের ছেলে হাফিজুল ইসলাম জানান, পৌষ মাসের শেষের দিকে আব্দুল্লাহকে ঘেরের চার বিঘা জমি ছেড়ে দিতে রাজী হন প্রশান্ত বিশ্বাস। একপর্যায়ে তার মাধ্যমে লীজ বাবদ ৩০ হাজার টাকা প্রশান্তকে দেন আব্দুল্লাহ। তবে জমির মালিক আইনুদ্দিন গাজী ওই জমি অন্য কাউকে না দিয়ে নিজে করার সিদ্ধান্ত নিলে প্রশান্ত বিশ্বাস টাকা নেওয়ার একদিন পর তার মাধ্যমে আব্দুল্লাহকে টাকা ফেরৎ দেন।

খলিশখালি ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রবিউল ইসলাম বলেন, প্রশান্তকে যেভাবে মারপিট করা হয়েছে তা অমানবিক।

গ্রাম ডাক্তার কামরুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তাকে মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি।

কাশিয়াডাঙা গ্রামের শফিকুল ইসলাম মোড়ল জানান, পার্শ্ববর্তী ঘেরের মালিক হওয়ায় তিনিও আব্দুল্লাহ এর সঙ্গে মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে প্রশান্ত বিশ্বাসের ঘেরের বাসায় যান। তবে ঘেরের চুক্তিপত্র দিতে রাজী না হওয়ায় প্রশান্তকে লোহার রড/লাঠি দিয়ে যেভাবে ঘেরের বাসনা থেকে বের করে পিটাতে পিটাতে ভেড়ির উপর এনে আব্দুল্লাহ নির্যাতন করেছে তা মেনে নেওয়া যায় না। তিনি প্রশান্তকে রক্ষায় ঝাপিয়ে না পড়লে তাকে বাঁচানো যেত না। এর প্রতিকার দাবি করেন তিনি।

কাশিয়াডাঙা গ্রামের আইনুদ্দিন গাজী বলেন, ২০ বছর আগে টাকা দিলেও ২০১৯ সালে তাদের গ্রামের নিতাই ঘোষের কাছ থেকে সাড়ে তিন বিঘা ও চোমর খালি গ্রামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১০ কাঠা জমি কিনে মোট চার বিঘা জমি প্রথমে তিন বছরের জন্য প্রশান্তকে লীজ দেন। লীজের টুক্তিপত্র পর্যায়ক্রমে পরিবর্তণ করেন তিনি। আগামি ২০২৬ সাল পর্যন্ত লীজ করার কথা ছিল প্রশান্তর। চলতি বাংলা সনের পৌষ মাসের শেষে মাছ ধরার পর আর্থিক সংকটের কারণে প্রশান্ত চার বিঘা জমি আব্দুল্লাহকে দিতে চাইলে তিনি আপত্তি করে নিজে করার সিদ্ধান্ত নেন। একপর্যায়ে প্রশান্ত মাঘ মাসে লীজের আংশিক টাকা দেন। তবে আব্দুল্লাহ যেভাবে রাতের আঁধারে প্রশান্তকে পিটিয়ে জখম করেছে তা কোন সুস্থ মস্তিকের লক্ষণ নয় বলে জানান তিনি। এ ধরণের নির্যাতন প্রমান করে দেশে কোন আইন কানুন নেই।

এ ব্যাপারে কাশিয়াডাঙা ৬ নং ওয়ার্ড জামায়াতের সেক্রেটারী আব্দুল্লাহ প্রশান্তকে মারপিটের কথা অস্বীকার না করেই প্রশান্ত কি বলেছে তা জানতে চান। একপর্যায়ে মোবাইলের পরিবর্তে সাক্ষাতে সব কথা বলবেন বলে জানান। পরবর্তীতে আবারো ফোন করে বলেন, জামায়াত নেতা সাংবাদিক আবু সাঈদ বিশ্বাসকে চেনেন কিনা ?

এ ব্যাপারে খলিশথালি ইউনিয়ন জামায়াতের আমীর মাষ্টার শহীদুল্লাহ’র মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে এক নারী তা রিসিভ করে ওই নাম্বার মাষ্টার শহীদুল্লার নয় বলে দাবি করেন।

সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের জরুরী বিভাগের চিকিৎসক ডাঃ মারুফ আক্তার বলেন, প্রশান্ত বিশ্বাসের সারা শরীরে ভারী জিনিস দিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত রক্তাক্ত জখম করা হয়েছে।

পাটকেলগাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাইনুল ইসলাম জানান, বিষয়টি তিনি শুনেছেন। তবে বৃহষ্পতিবার রাত ৮টা পর্যন্ত এ নিয়ে থানায় কোন লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পর অভিযোগ দিলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

(আরকে/এএস/এপ্রিল ১৮, ২০২৫)