গরমকালে জন্ডিস রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি রোধে সতর্কতা প্রয়োজন
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
তাপপ্রবাহে দেখা দেয় বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব। এ সময় মানুষের ডায়রিয়া, হজমজনিত সমস্যা, পেটের গোলমালের সঙ্গে দেখা দেয় জন্ডিসও। সাধারণত গ্রীষ্মকালেই এই রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি হয়। এ সময় প্রচণ্ড গরমে দূষিত পানি, শরবত গ্রহণের মাধ্যমেই জন্ডিসের ভাইরাস সবচেয়ে বেশি ছড়ায়। এ ছাড়া বন্যা বা বর্ষা মৌসুমে নগর কিংবা গ্রাম সব জায়গায়ই পানি দূষণের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ানোর মারাত্মক ঝুঁকি থাকে। আর জন্ডিস খুব সাধারণ রোগ মনে হলেও বিষয়টি কিন্তু সবসময় সাধারণ থাকে না, মারাত্মক ঝুঁকির কারণও হয়ে উঠে।
জন্ডিস কী ও কেন হয়?
জন্ডিস আসলে কোনো রোগ নয়, রোগের লক্ষণ মাত্র। জন্ডিস হলে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়। জন্ডিস বলতে আমরা শরীর, চোখ ও প্রস্রাবের রং হলুদ হয়ে যাওয়াকেই বুঝি। মূলত বিলিরুবিন নামক রঞ্জকের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রভাবেই এটা ঘটে থাকে।রক্তে এই বিলিরুবিন বাড়ার অনেক কারণ রয়েছে। যেমন- রক্তের লোহিত রক্তকনিকার দ্রুত ও অত্যাধিক পরিমাণ ভেঙে যাওয়া, লিভারের প্রদাহতে বিলিরুবিনের বিপাক বা মেটাবলিজম বাধাগ্রস্ত হওয়া, পিত্তরসের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়াসহ বেশকিছু কারণে জন্ডিসের উপসর্গ দেখা দেয়।
জন্ডিসের কারণগুলোকে কয়েকভাবে ভাগ করা যায়। যেমন-
১. ভাইরাসের সংক্রমণ ২. থ্যালাসেমিয়া ৩. হিমোলাইটিক এনিমিয়া ৪. ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ৫. লিভার সিরোসিস ৬. লিভার/ প্যানক্রিয়াস/ পিত্তনালীর ক্যানসার ৭. কিছু বিরল জেনেটিক রোগ (উইলসন ডিজিস) বা অটোইমিউন ডিজিস
জন্ডিসের লক্ষণ
১. জন্ডিস হলে চোখ, প্রস্রাব ও শরীর হলুদ বর্ণ ধারণ করে। ২. ভাইরাল হেপাটাইটিসের ক্ষেত্রে মুখে খাদ্য গ্রহণে অরুচি ও বমি বমি ভাব আসে।৩. অনেক সময় বমিও হতে পারে। ৪. শরীরে অস্বাভাবিক দুর্বলতা থাকে। ৫. জ্বর বা জ্বর-জ্বর ভাব। ৬. পেট ব্যাথাও দেখা দিতে পারে। ৭. শরীরে চুলকানি ও ফ্যাকাসে বা সাদাটে পায়খানা হতে পারে। ৮. কোনো কোনো ক্ষেত্রে রক্তবমি হতে পারে। ৯. আলকাতরার মতো কালো পায়খানা হতে পারে। ১০. পেট ও পায়ে পানি এসে ফুলে যেতে পারে।১১. পেটে চাকা বা লাম্প অনুভূত হতে পারে।
নবজাতকের জন্ডিস: সব ঠিকঠাক থাকলেও জন্মের পর শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ নবজাতকের জন্ডিস হতে পারে। জন্ডিস আক্রান্ত শিশুর প্রায় ৫০ শতাংশের বেলায় একে বলে স্বাভাবিক জন্ডিস। শিশুর যকৃৎ পুরোপুরি কর্মক্ষম হয়ে উঠতে একটু দেরি হলে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গিয়ে এই জন্ডিস হয়। এ সময়ে কোনো অবস্থায়ই নবজাতককে বুকের দুধ খাওয়ানো থেকে বিরত রাখা যাবে না। স্বাভাবিক জন্ডিস সাত দিনের মধ্যেই সেরে ওঠার কথা। তবে জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই জন্ডিস দেখা দিলে, সাত বা দশ দিনের পরও না সারলে, শিশু খাওয়া বন্ধ করে দিলে বা কমিয়ে দিলে, জ্বর বা সংক্রমণের লক্ষণ থাকলে, বিলিরুবিনের মাত্রা দ্রুত বাড়তে থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
জন্ডিসের ঝুঁকি
আমাদের দেশে সব বয়সের মানুষের অ্যাকিউট ভাইরাল হেপাটাইটিস বা ভাইরাসজনিত লিভারের প্রদাহ হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। ইংরেজি অক্ষর দিয়ে এই ভাইরাসগুলোর নামকরণ করা হয়ে থাকে যেমন এ, বি, সি, ডি এবং ই ভাইরাস। আমাদের দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেই ভাইরাসের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি, যা সাধারণত কোনো দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ তৈরি করে না।তবে কখনো কখনো মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। তবে এই ভাইরাসগুলোর একটি ভালো দিক হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আক্রান্ত ব্যক্তি কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নিজে থেকেই সেরে ওঠেন।
'এ' ও 'ই' ভাইরাসজনিত লিভার রোগ, 'বি' ও 'সি' ভাইরাসজনিত লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যানসার, ফ্যাটি লিভার রোগসহ লিভারের অন্যান্য রোগে বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ প্রচলিত ভাষায় জন্ডিসে আক্রান্ত। দেড় কোটির বেশি মানুষ লিভারের দীর্ঘস্থায়ী রোগ হেপাটাইটিস 'বি' এবং প্রায় ১০ লাখ মানুষ হেপাটাইটিস 'সি' ভাইরাসে আক্রান্ত বলে জানান এই চিকিৎসক।
জন্ডিস প্রতিরোধের উপায়
বেশ কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা যেতে পারে জন্ডিস প্রতিরোধে। যেমন- ১. বিশুদ্ধ পানি পান করা। ২. রাস্তাঘাটের অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা খাবার এবং পানি না খাওয়া। ৩. ড্রেনেজ ব্যবস্থা আর নিরাপদ পানির সরবরাহ ব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পানিবাহিত হেপাটাইটিস 'ই' ছড়ানোর ঝুঁকিটা খুবই বেশি থাকে। ৪. নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন নিশ্চিত করা। ৫. অনিরাপদ শারীরিক সম্পর্ক থেকে বিরত থাকা। ৬. শরীরের অতিরিক্ত ওজন, ডায়াবেটিস ও ফ্যাটিলিভারের চিকিৎসা গ্রহণ করা। ৭. মদ্যপান থেকে বিরত থাকা। ৮. ক্রনিক লিভার ডিজিজের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা।
জন্ডিস রোগীর সহজলভ্য পথ্য
জন্ডিস হলে এমন খাবার খাওয়া উচিত, যাতে যকৃৎ কিংবা পিত্তথলির ওপর কোনো চাপ না পড়ে। অল্প করে একটু পরপর সঠিক খাবার খেলে এবং পূর্ণ বিশ্রামে থাকলে এমনিতেই জন্ডিস সেরে যায়।নিম্নে তালিকা দেওয়া হয়েছে...
জন্ডিস হলে যা খাবেন
* গোটা শস্য: কার্বোহাইড্রেটের চাহিদা পূরণে বাদামি চাল, রুটি, ওট্স খেতে পারেন। গোটা শস্যে প্রচুর আঁশ, ভিটামিন থাকে, যা ক্ষতিকর টক্সিন বের
করে দেয়।
* প্রোটিন: খাদ্যতালিকায় প্রতিদিন মাছ, মুরগির মাংস, ডাল পরিমাণমতো থাকতে হবে। না হলে রোগী দুর্বল হয়ে পড়বে। অনেকে মনে করেন, জন্ডিসে আক্রান্ত রোগী মাছ-মাংসজাতীয় খাবার খেতে পারবেন না। এটা আসলে ভুল ধারণা।
* সবজি: মিষ্টিকুমড়া, মিষ্টি আলু, মুলা, বিট, গাজর, টমেটো, ব্রকলি, ফুলকপি, বাঁধাকপি ও পালংশাক জন্ডিস রোগীর জন্য খুব ভালো।
* ফল: বেরিস, পেঁপে, তরমুজ, আনারস, পাকা আম, কলা, কমলা, জলপাই, অ্যাভোকাডো, আঙুরের মতো সহজপাচ্য ফল প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় থাকতে হবে।
* দুগ্ধজাতীয় খাবার: জন্ডিস হলে ফুল ক্রিম দুধ বা দই, পনির খাওয়া ঠিক নয়। এতে স্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি থাকে, যা যকৃতের জন্য ক্ষতিকর।
* অ্যান্টি-অক্সিডেন্টযুক্ত খাবার: লেবু, বাতাবি লেবুর শরবত জন্ডিস রোগীর জন্য খুবই ভালো। এগুলো শরীরে পানির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এ ছাড়া প্রতিদিন বাদামও পরিমাণমতো খেতে পারেন। সামান্য আদা কুচি বা রসুন কুচি, আদার রস বা আদা-চা খাওয়া যেতে পারে দিনে দু-একবার। এগুলো যকৃতের জন্য ভালো।
*পানি: প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি (দৈনিক অন্তত আট গ্লাস) পান করতে হবে। তবে অতিরিক্ত পানি পানের প্রয়োজন নেই। পানি শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিন বের করে দেয়। আখের রস, ডাবের পানিও শরীরে পানির চাহিদা পূরণ করে। তবে রাস্তার পাশের আখের শরবত না পান করে ঘরে তৈরি শরবত খেতে হবে।
যা খাওয়া যাবে না
চিনি বা অতিরিক্ত মিষ্টিজাতীয় খাবার, কাঁচা লবণ, অতিরিক্ত তেল-মসলাযুক্ত খাবার, রেড মিট (গরু, মহিষ, ছাগলের মাংস), অ্যালকোহল, ট্রান্স ফ্যাট ও স্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত খাবার খাওয়া যাবে না।
হোমিওসমাধান
রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয় এই জন্য একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক কে ডা. হানেমানের নির্দেশিত হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতি অনুসারে গরমকালে জন্ডিস সহ যে কোন জটিল কঠিন রোগের চিকিৎসা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ভিওিক লক্ষণ সমষ্টি নির্ভর ও ধাতুগত ভাবে চিকিৎসা দিলে আল্লাহর রহমতে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। চিকিৎসা বিজ্ঞানে চিরন্তন সত্য বলে কিছুই নেই। কেননা একসময় আমরা শুনতাম যক্ষা হলে রক্ষা নেই, বর্তমানে শুনতে পাই যক্ষা ভাল হয়। এ সবকিছু বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও উন্নয়নের ফসল। জন্ডিস চিকিৎসা হোমিওপ্যাথিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় চিকিৎসা পদ্ধতি। সামগ্রিক উপসর্গের ভিত্তিতে ওষুধ নির্বাচনের মাধ্যমে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করা হয়। এটিই একমাত্র চিকিৎসা পদ্ধতি যার মাধ্যমে রোগীর কষ্টের সমস্ত চিহ্ন এবং উপসর্গগুলি দূর করে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যের অবস্থা পুনরুদ্ধার করা যায়। আর জন্ডিস রোগীদের লক্ষণের যেইসব ঔষধ প্রাথমিক ভাবে যেইসব ঔষধ আসতে পারে, ব্রাইয়োনিয়া, চেলিডিনাম, নাক্স ভোম, চায়না, মার্ক সল, আর্সেনিক আয়োড, হাইড্রাস, লেপ্টেন্ডা, লাইকো, মার্ক ডাল, সিয়ানোথাস, নেট্রাম সালফ, থুজা সহ অনেক মেডিসিন লক্ষনের উপর আসতে পারে, তাই অভিজ্ঞ হোমিওচিকিৎসক ছাড়া ঔষধ নিজে নিজে ব্যবহার করলে রোগ আরো জটিল আকারে পোঁছতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, জন্ডিস দেখা দিলে অবশ্যই দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের চিকিৎসা গ্রহণ করা যাবে না। বিশেষত প্রচলিত কবিরাজি, হারবাল বা বনাজি ও তথাকথিত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক অথবা ঝাড়ানোর মাধ্যমের মতো চিকিৎসা মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এক্ষেত্রে কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চলতে হবে।
লেখক: চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।