কানাইপুরে জব্দ হওয়া ৬ বস্তা সরকারি 'সার' তুমি কার?

রিয়াজুল রিয়াজ, ফরিদপুর : ফরিদপুর সদরের কানাইপুর বাজারে সরকারি অনুমোদিত একটি সারের দোকানে বিক্রির উদ্দেশ্যে নিয়ে আসা ৬ বস্তা সরকারি চোরাই সার জনতার হাতে ধরে পড়েছে। যার মধ্যে ৩ বস্তা ইউরিয়া রাসায়নিক সার ও বাকী ৩ বস্তা ডিএপি সার বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু এই ৬ বস্তা সরকারি সার যে কার বা সরকারের কোন অধিদপ্তরের তা তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
উপজেলা পরিষদের নির্দেশে স্থানীয় ৯নং কানাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আলতাফ হুসাইন ঘটনাস্থলে এসে স্থানীয় জনতা, প্রশাসন ও গণমাধ্যমের সামনে ওই ৬ বস্তা সরকারি সার জব্দ করে গ্রাম্য পুলিশের মাধ্যমে তা ফরিদপুর সদর উপজেলা পরিষদের হেফাজতে পাঠিয়ে দেন। এই বিষয়ে শীঘ্রই এক বা একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করে সারগুলোর সঠিক রহস্য উন্মোচন করা হবে ও এসবের সাথে যারাই জড়িত তাদের শান্তি নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
শুভ নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল, সোমবার) বেলা আড়াইটার দিকে কানাইপুর বাজারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত খুচরা সার বিক্রেতা মেসার্স মনোরমা এন্টার প্রাইজের সামনে থেকে একটি অটো চালিত ভ্যান ভর্তি ওই ৬ বস্তা সার আটক করে স্থানীয় জনতা। পরে প্রশাসন ও সংবাদকর্মীদের খবর দেন তারা। পরবর্তীতে কোতয়ালি থানা পুলিশ, বেশকিছু গণমাধ্যমকর্মী, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সদস্য ও কৃষি সস্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপজেলা কার্যালয় তথা ফরিদপুর সদর উপজেলা কৃষি অফিস থেকে কৃষি কর্মকর্তা এসে সারের বস্তাগুলো সরকারি বলে সনাক্ত করেন। তবে কোন অধিদপ্তরের সার হতে পারে সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারেননি ওই কৃষি কর্মকর্তা।
কানাইপুরের খাসকান্দি গ্রামের বাসিন্দা ও ভ্যানচালক ইশারত শেখ (৫৩) এর দাবি, এই ৬ বস্তা সার কানাইপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কালো ও বেটে টাইপের একটা লোক তাঁর ভ্যানে তুলে দিয়ে তাঁকে বলেছেন- কানাইপুর বাজারে মেসার্স মনোরমা এন্টার প্রাইজ নামক সারের দোকানে বস্তাগুলো নামিয়ে রেখে তাঁর থেকে ভ্যানভাড়া বুঝে নিতে।'
এ বিষয়ে কানাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আলতাফ হুসাইন বলেন, 'খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে ৬ বস্তা সরকারি সার জনতার হাতে আটক অবস্থায় দেখতে পাই। ভ্যানচালককে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোন একজন ব্যক্তি দিয়েছেন বলে দাবি করলেও এই সার তাঁর ইউনিয়ন পরিষদের গোডাউনে কিছুতেই থাকার কথা নয় বলে জানান চেয়ারম্যান। সরকারিভাবে কৃষি অফিস কৃষকদের এসব সার এখন ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নয় বরং উপজেলা পরিষদ থেকে সরাসরি কৃষকদের বুঝিয়ে দেয় বলেও জানান তিনি।
আলতাফ হুসাইন আরো জানান, ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে সরকারের কোন অধিদপ্তর কৃষকদের সার বা বীজ বিতরণ করলেও সরকারি তালিকা অনুযায়ি সরকারি সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে তা বিতরণ করে থাকেন। এবং ইউনিয়ন পরিষদ সচিব ও ওই অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছে সুস্পষ্ট একটা পরিসংখ্যানও সেই বিষয়ে থেকে থাকে বলেও জানান তিনি। ওই ইউপি চেয়ারম্যান জোর দাবি করে আরো বলেন, 'কিছুতেই এই সার কানাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের নয়, নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোন ষড়যন্ত্র রয়েছে। তাছাড়া আজ শুভ নববর্ষের দিন, সরকারি ছুটির দিন। কোন জনপ্রতিনিধিই ইউনিয়ন পরিষদে নাই, বা থাকার কথাও নয়। সুতরাং এখানে অন্য কোন রাজনৈতিক কারসাজি আছে কিনা তা অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে ক্ষতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এ সময় ঘটনাস্থলে চেয়ারম্যানের পাশে বসে থাকা স্থানীয় ইউপি মেম্বার ও কানাইপুর ইউনিয়ন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. মোতালেব শেখও বিষয়টির সুষ্ঠু, সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সরকারি সার চোর বের করতে উপজেলা প্রশাসনের প্রতি জোড়ালো আহ্বান জানান।
এর আগে, এ বিষয়ে ফরিদপুর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইসরাত জাহান উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে জানান, 'আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর উপজেলা কৃষি অফিসারকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছি। কৃষি অফিসের কোন কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থলে পাঠিয়ে জনতার আটককৃত সারের বস্তাগুলো সরকারি কিনা তা সনাক্তের নির্দেশ দিয়েছি।' সনাক্ত হওয়ার পর এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলেও আশ্বাস দেন ইউএনও ইসরাত।
এদিকে, আটককৃত সারের বস্তাগুলো সরকারি সারের বস্তা হিসেবে চিহৃিত করে স্থানীয় কানাইপুর ইউনিয়নের খাসকান্দি ব্লকের দায়িত্বে থাকা ফরিদপুর সদর উপজেলা কৃষি অফিসের সহকারি কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জয় বিশ্বাস ঘটনাস্থল থেকে উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে জানান, 'এগুলো সরকারি সার। তবে উপজেলা কৃষি অফিস এখন ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে কোন কৃষককেই এসব সার ও বীজ বিতরণ করেনা। আমরা উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে সরাসরি তালিকাভুক্ত কৃষকদের হাতে সরকারি সার ও তাঁদের প্রয়োজনীয় বীজ বিতরণ করে থাকি।
সঞ্জয় আরো জানান, এসব সারের বস্তা কোনো ইউনিয়ন পরিষদের গোডাউনেই থাকার কথা নয়। ওই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, এই সারগুলো ফরিদপুর সদর উপজেলা কৃষি অফিসের গোডাউনেরও নয়, এটা আমি মোটামুটি নিশ্চিত। তবে এগুলো কোথা থেকে এসেছে সে বিষয়েও তিনি আসলেই অবগত নন বলে জানান উপজেলা কৃষি অফিসের ওই কর্মকর্তা।
এদিকে, যে সারের দোকানের ওই সারের বস্তা আটক হয়, কানাইপুর বাজারে সরকার অনুমোদিত সেই খুচরা সার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স মনোরমা এন্টার প্রাইজের দায়িত্বে থাকা সুদীপ দত্ত সল্টু এসব বিষয়ে 'দৈনিক বাংলা ৭১কে জানান, 'আমার কাছে একটা অজানা নম্বর থেকে ফোন আসে, আমি রিসিভ করলে তিনি বলেন, 'আপনার দোকানের সামনে একটা ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে, ওই ভ্যানে ছয় বস্তা সার রয়েছে, আপনি তা রিসিভ করে ভ্যান চালককে ভাড়া মিটিয়ে দিন। আমি পরে আসতেছি।' সুদীপ তাৎক্ষণিক ওই লোকের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে ফোন রেখে দেন দাবি করে জানান, 'আমি এসব সার ফ্রী দিলেও কিনিনা। আপনি অন্য কোথায় চেষ্টা করুন, ধন্যবাদ! বলেই আমি ফোন রেখে দেই।' সুদীপ আরো বলেন, 'ভ্যানচালক আমার অপারগতার কথা জানতে পেরে তার প্রেরকের সাথে ফোনে কথা বলে যখন সার ভর্তি ভ্যান নিয়ে আমার দোকানের সামনে থেকে ফিরে যাচ্ছিলেন এমন সময় ওইখানে উপস্থিত স্থানীয় জনৈক বাবু সরদার ওই ভ্যানটি আটকে দেন এবং ভ্যানচালককে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাকে আটক করে রাখেন।'
এবিষয়ে স্থানীয় বাবু সরদার ঘটনাস্থল থেকে উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে জানান, 'আমিই প্রথম ভ্যানচালককে থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে বুঝতে পারি সারের বস্তাগুলো সরকারি এবং চুরি করে বাজারে বিক্রি করতে পাঠিয়েছে মো. ইউনূস নামের এক ব্যক্তি।' বাবু আরো জানান, 'ভ্যানটি আটকের পর আমি স্থানীয় লোকজন, স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং ফরিদপুর জেলা বিএনপির শীর্ষনেতাকে এ বিষয়ে জানাই, সেই সাথে প্রশাসন ও গণমাধ্যমকর্মীদের এ খবর পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করি।'
এদিকে, ' জব্দকৃত সরকারি এই সার আসলে কার বা কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানের?' এমন বিষয়টি মাথায় রেখে তাৎক্ষণিক তথ্য অনুসন্ধানে নামে উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ। অনুসন্ধানের এক পর্ষায়ে সোমবার দিবাগত প্রায় মধ্যরাতে পাট অধিদপ্তরের একটি সূত্রের মাধ্যমে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার সরকারের পাট অধিদপ্তর থেকে কানাইপুর ইউনিয়নের পাট চাষী কৃষকদের মধ্যে এই ধরণের ৪৮ বস্তা সার বিতরণ করা হয়েছে। যা পাট অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতেই স্থানীয় কানাইপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ওই ইউনিয়নের মেম্বারদের মাধ্যমে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। ওই দিনই সরকারি দপ্তরটির এই যৌথ কর্মসূচীর সমাপ্তি হয় এবং তালিকাভুক্ত কৃষকদের মধ্যে একটি সুনির্দিষ্ট আনুপাতিক হারে সেই সার বিতরণ করা হয়।
সূত্রটি আরো জানায়, সম্ভবত ৫০ কেজি/বস্তা ওজনের ৪৮ বস্তা সার ওইদিন কৃষকদের মাঝে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে, যেখানে সারা ইউনিয়নব্যাপী চেয়ারম্যানের করা কৃষকদের লিস্ট বাদেও ওই ইউপি'র প্রতিটি ওয়ার্ড মেম্বার ৫০ কেজি ওজনের দুই বস্তা করে সরকারি সার বরাদ্দ পেয়েছেন। যা তারা নিজ ওয়ার্ডের ১০ জন কৃষককে ১০ কেজি পরিমাপে নিজ হাতে বিতরণ করার সুযোগ পেয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার পাট অধিদপ্তর থেকে সার বিতরণের বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে কানাইপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আলতাফ হুসাইন 'দৈনিক বাংলা ৭১'কে জানান, 'আমার জানামতে স্থানীয় পাট অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ও তাঁদের উপস্থিতিতে ওই যৌথকাজের সমাপ্তি বৃহস্পতিবারেই সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ইউনিয়নের তালিকাভুক্ত সব কৃষককেই সার বিতরণ করা হয়েছে ওইদিন। তবে বিতরণের পর দুই-এক বস্তা বারতি সার ছিলো কিনা, বা থাকলেও সেটি ইউনিয়ন পরিষদের গোডাউনে ছিলো কিনা, সেটাও আমার জানা নেই এবং কেউ আমাকে সে সম্পর্কে অবগতও করেননি।' তিনি বলেন, 'আমার ইউপি পরিষদের গোডাউনে যদি থেকেও থাকে, এবং সেখান থেকে যদি কোন সার খোয়া যায়, তবে এটির হিসেব ইউনিয়ন পরিষদের সচিব ও পাট অধিদপ্তর দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারাই সঠিকভাবে দিতে পারবেন। কারণ, ইউনিয়ন পরিষদের গোডাউনের চাবি ও সরকারি মালামালের হিসাব সবই থাকে ইউনিয়ন পরিষদ সচিবের নিকট এবং তাঁর একান্ত দায়িত্বে। তাছাড়া,এ বিষয়ে পাট অধিদপ্তর দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের হাতেও এসবের সঠিক হিসেব থাকার কথা রয়েছে।'
তবে, এই সার কান্ডে তাঁর ইউনিয়ন পরিষদের নাম আসায় ও তাঁর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কতিপয় ব্যক্তিবর্গ মিথ্যা অপবাদের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের কালিমা লেপনের অপচেষ্টার বিষয়ে ওই চেয়ারম্যান উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, 'যদি ইউনিয়ন পরিষদের গোডাউনে কোনো সরকারি সার থেকেও থাকে, তা সরকারি ছুটির দিনে বের করবে কে? তাছাড়া গোডাউনে তালিকাভুক্ত কোন কৃষকের সার তাঁর অনুপস্থিতির কারণে থেকে থাকলে আমার তা জানা থাকতো এবং যা গত রবিবার ওয়ার্কিংডে তে বিতরণ করারও সুযোগ পেতাম। এছাড়া তালিকাভুক্ত কৃষকদের বিতরণ করেও যদি কোন সার উদ্বৃত্ত থাকে এবং কোন কারণে সরকারি কর্মকর্তারা তা রেখে যান, তাহলেও তো গোডাউন থেকে সরকারি সারের বস্তা যে কেউ চুরি করে বিক্রির ক্ষমতা রাখেনা,তাইনা? এবং সে সুযোগও নেই। এ বিষয়গুলোও তদন্ত করে বের করা হবে। তিনি শতর্কতা উচ্চারণ করে আরো জানান, 'জব্দকৃত সারের বস্তাগুলো যদি কানাইপুর ইউনিয়নের গোডাউনের রাখা কোন সার প্রমাণিত হয়ে থাকে তাহলে, যে বা যারাই এই চুরির সাথে জড়িত তাদের সবগুলোকে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই।'
এদিকে, ভ্যানচালক ও দোকানদারের তথ্য অনুসারে জনৈক মো. ইউনুসের সাথে যোগাযোগ করতে না পারায় এবং এ বিষয়ে অনুসন্ধান ও তথ্য সংগ্রহ করতে করতে গভীর রাত হয়ে যাওয়ায় কানাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের গোডাউনের চাবির দায়িত্বে থাকা ওই ইউনিয়ন পরিষদ সচিবের সাথে যোগাযোগ করে বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়ে উঠেনি।
(আরআর/এএস/এপ্রিল ১৫, ২০২৫)