মীর আব্দুর আলীম


মধ্যপ্রাচ্য কি পৃথিবীর মগজহীন হৃদয়?  বারবার গাজায় শিশুরা মরবে, আর বিশ্ব সভ্যতা নিঃশব্দ থাকবে? বোম পড়ে, বাড়ি-ঘর উড়ে, পাশে দাঁড়িয়ে কেরানির মতো গণনা করে জাতিসংঘ- “আজকে ৮৬ জন, কালকে ৭১। মোট কতো হল?” ছি লজ্জা লাগে বিশ্ব বিবেকের নির্লজ্জতা দেখে। বিশ্ব মোড়লরা বলছে, “ইসরায়েল নিরাপত্তা জরুরি”- এমন যেন তারা মশার কামড় খাচ্ছে, আর তার প্রতিক্রিয়ায় গোটা ঘর আগুনে জ্বালিয়ে দিচ্ছে!

গাজায় এখন আর দিন নেই, রাত নেই। আকাশে সূর্য ওঠে না, নামে না- কারণ আকাশ ভরা ধোঁয়া, আগুন আর মৃত্যুর ছায়া। শিশুরা আর স্কুলে যায় না। গাজার শিশুগুলো আজ বড়ই ক্লান্ত। তারা আর বাঁচতে চায় না। কেননা এই পৃথিবী তাদের জন্য নয়। তবু প্রশ্ন থেকে যায়- এই নিঃসঙ্গ কাঁদন, এই রক্তাক্ত লাল সূর্য- কবে থামবে? গাজায় যখন বোমা পড়ে, শুধু মাটি কাঁপে না, মানবতার অন্তিম আস্থাও একটু একটু করে ভেঙে পড়ে। গাজা এখন এক মুক্ত শবযাত্রার নগরী। কবর খোঁড়ার লোক নেই, ওষুধ নেই, খাবার নেই- আকাশভর্তি বোমা আছে। এই দুঃসময়ে বড় বড় রাষ্ট্রের মৌনতা যেন এক নিঃশব্দ বর্বরতা। বিশ্বব্যবস্থা আজ ভয়ানক রকম পক্ষপাতদুষ্ট। একটি জাতি নিরস্ত্র, পরাজিত, অথচ অভিযুক্ত! আরেকটি পরমাণু শক্তিধর দেশ, আগ্রাসী- অথচ নিরাপত্তা বেষ্টিত। এই বৈপরীত্য কেবল রাজনীতি নয়, এটি সভ্যতার মূল্যবোধের দেউলিয়াপনাও। গাজাবাসীর কষ্টে কেউ কেউ কবিতা লেখেন। একটি লাই আমায় বড় কষ্ট দেয়। কবিতার লাইটি এমন- “আমার মেয়ে শুধু জানতে চায়- মৃত্যুর পর কি ভয় কমে যায়?” এই একটি বাক্য পড়ে আমি ঘুমাতে পারিনি সেদিন।

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যখন উৎসব-উচ্ছ্বাস, আর এই সময়েই গাজার আকাশে চক্কর কাটছে যুদ্ধবিমান। বোমা পড়ে স্কুলে, হাসপাতালে, মসজিদে। গাজার এই দৃশ্য নতুন কিছু নয়, বরং এ যেন এক দুঃস্বপ্নের পুনরাবৃত্তি, যা গত কয়েক দশকে পৃথিবী দেখেছে বারংবার। গত অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরাইল-গাজা সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ৩৩,০০০ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ৭০%–এর বেশি নারী ও শিশু, যার মধ্যে কেবলমাত্র ১৩,০০০-এর বেশি শিশু নিহত হয়েছে—এই তথ্য ফাঁস করেছে Palestinian Ministry of Health। গড়ে প্রতি দশ মিনিটে একজন শিশু মারা যাচ্ছে। জাতিসঙ্ঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজার ৯০% মানুষ এখন মানবিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, প্রতি তিনজন গাজাবাসীর মধ্যে একজন বর্তমানে অপুষ্টির শিকার। চিকিৎসা নেই, আশ্রয় নেই, ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা নেই। খাবার, জ্বালানি ও পানীয় জলের মারাত্মক সংকট চলছে। গড়ে প্রতিদিন গাজায় ৮ ঘণ্টার বেশি সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। হাসপাতালগুলো জেনারেটর চালাতে পারছে না জ্বালানির অভাবে। অন্তত ১৮ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত।

বিশ্ব দেবতা আমেরিকা বলছে, “ইসরায়েলের আত্মরক্ষা অধিকার আছে।” ইসরাইল বলে, “আমরা শুধু হামাসকে মারছি।” তো বাকি যে হাজার হাজার নারী-শিশু মরছে, তারা কী করেছিল? সম্ভবত যুদ্ধের আগে তারা হামাসের হয়ে কফি বানাত, না হলে স্কুলের হোমওয়ার্কে ভুল করেছিল—আর তার শাস্তি? ৫০০ কেজির স্মার্ট বোমা! কী সুন্দর গণতন্ত্রীয় ছাঁদে সাজানো প্রতিশোধ! জাতিসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: বিড়াল হাঁচি দিলে যেমন শোরগোল হয়, এখানে তাও না! জাতিসঙ্ঘ প্রতিবাদ জানায়, বিবৃতি দেয়, গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে-তারপর এক কাপ চা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। বেচারা গুতেরেস তো এতবার “শান্তি চাই, যুদ্ধ বন্ধ হোক” বলেছেন, যে এখন জোরে কথা বললেও কেউ কান দেয় না। কারণ শান্তির শব্দে কোনো ড্রোন থাকে না। আর যুক্তরাষ্ট্র? তারা বলেছে, “ইসরাইলকে সমহযিাগিতা করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। ১৪ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য তারা দিয়েছে-বোমা কেনার জন্য।

আর এই বোমার আঘাতে মরছে নিরিহ মানুষ। সেদিন আন্তজাতিক এক জার্নালে দেখলাম- একটা রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত মৃত শিশু পড়ে আছে- চোখ দুটো খোলা, যেন প্রশ্ন করছে, “আমার কী অধিকার ছিলো বাঁচার?” এই তো সভ্যতার আসল রূপ! এই বিশ্ব এক চোখে কাঁদে, অন্য চোখে চোখ রাঙায়। বাংলাদেশে টকশো- “এই হামলার পেছনে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত!” চা খেতে খেতে সবাই জ্ঞানী, সবাই বিশ্লেষক, আর গাজায় একটা মা তার সন্তানের নাম ধরে চিৎকার করে, কেউ শোনে না, কারণ মিডিয়াতে এখন নতুন ট্রেন্ড চলছে- নেটফ্লিক্সে নতুন সিরিজ!

কখনো কখনো কিছু ছবি থাকে, যা ভাষাকে হার মানায়। গাজায় আবারও আগুন। আবারও আকাশ ভরে গেছে যুদ্ধবিমানের গর্জনে। বিশ্ব বলছে, “এটি একটি সংঘাত।” কিন্তু যারা মরছে, তারা তো কেউ যোদ্ধা না। তারা ছোট ছোট শিশু। যাদের গায়ে স্কুল ইউনিফর্ম থাকার কথা, আজ গায়ে শুধু ধুলা, রক্ত আর ছিন্নভিন্ন পোশাক। ইসরায়েল বলছে, “আমরা সন্ত্রাসী খুঁজছি।”একজন সন্ত্রাসীর জন্য গোটা পাড়া উড়িয়ে দিলে, সেটা কি যুদ্ধ হয়, না নিধনযজ্ঞ? প্যালেস্টাইন এখন এক মৃত নদী। যেখানে প্রতিদিন ভেসে আসে— বাবাহীন শিশু, মা হারানো মুখ, আর মাটি খুঁড়ে বাঁচতে চাওয়া মানুষ। আর আমরা? আমরা টিভি চ্যানেল বদলাই, একটা ছবি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। এই সময়টাতে কবিতার ভাষাও কেমন যেন ঠোঁট কেটে যায়। কারণ শব্দ দিয়ে কি বোঝানো যায়- একটা বাচ্চা কেন আর খেলনা চায় না? শুধু বলে, “আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও, আমি আর ভয় পাই না”?

বাংলাদেশ থেকে আমরা শুধুই দেখছি এসব। কেউ চোখের পানি মুছছে, কেউ প্রতিবাদ করছে, কেউ কেউ আবার চুপচাপ। কেউ আবার প্রতিবাদের নামে সুযোগ বুঝে লুটপাট করছে। দিনেদুপুরে ডাকাতি! এসবের মধ্যেই সবচেয়ে বড় সহিংসতা লুকানো থাকে। যখন আমরা মুখ ফেরাই, তখন ইতিহাস লিখে নেয়-“তোমরা মানুষ ছিলে, নাকি কেবল দর্শক?” বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্ব প্রতিবাদ জানিয়েছে, তবে তা এখনও কূটনৈতিক ভাষার সীমায় আবদ্ধ। মানবিক আওয়াজ এখনো যেন চাপা পড়ে আছে রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের হিসাব-নিকাশে। আমি কেবল একজন লেখক, কলামিস্ট, ক্ষুদ্র নাগরিক। তবু বিশ্বাস করি- শব্দ কখনো কখনো বোমার চেয়েও শক্তিশালী হয়। এই শব্দ দিয়েই আমাদের বলতে হবে- গাজার প্রতিটি শিশু যেন এই পৃথিবীর সন্তান। তাদের রক্তে যদি আমরা চুপ থাকি, তাহলে আমাদের বিবেক বলে কিছু নেই। ভারত সরকার একদিকে মানবিক সাহায্য পাঠিয়েছে, অন্যদিকে ইসরাইলের সঙ্গে পুরোদমেই কূটনৈতিক সমর্থন বজায় রেখেছে। তবে জনগণ ও নাগরিক সমাজের মধ্যে গাজায় ইসরাইলি হামলার বিরোধিতা প্রবল। কলকাতা, দিল্লি, কেরলসহ বিভিন্ন শহরে প্রতিবাদ মিছিল ও মানববন্ধন হয়েছে।

এখনো ভাবছি, কী করবো আমরা? কম করে হলেও মুখ খুলুন। পোস্ট দিন। কবিতা লেখেন। কলম ধরুন। চুপ থাকবেন না। গাজার দিকে তাকিয়ে যদি চোখ না ভিজে, তাহলে আপনি মানুষ নন, আপনি কেবল একটা মেমোরি কার্ড! গাজার মাটিতে রক্ত পড়ছে, কিন্তু লজ্জা পড়ে গেছে আমাদের চোখে। কারণ সেই চোখ দিয়ে আমরা কেবল দেখি-কে কবে “ইনফ্লুয়েন্সার”! আর কে কবে মানুষ ছিলো- তা ভুলেই গেছি। গাজায় আকাশ ফাটে বোমায়, আর আমাদের আকাশ ফাটে চুপচাপ লজ্জায়। তবে লজ্জারও তো একটা সীমা থাকে, তাই না? চলুন, এই বার চুপ নয়, শব্দ হই।

শেষ প্রশ্ন একটাই- এই হামলা কি আত্মরক্ষা নাকি যুদ্ধাপরাধ? শিশু হত্যার কোন ন্যায় আছে? মানবতা কোথায়? গাজা শুধু একটা যুদ্ধক্ষেত্র না, এটা পৃথিবীর বিবেকের পরীক্ষা। আপনি, আমি কোথায় দাঁড়াবেন?” এটা কোন সভ্যতা? কোথায় সেই মানবাধিকার, যেখানে জাতিসঙ্ঘের কণ্ঠস্বরও অস্পষ্ট হয়ে যায় পরাক্রমশালী দেশের রাজনৈতিক মেরুকরণে? শিশু, নারী, সাধারণ মানুষ—কার দোষে তারা এই মৃত্যু যন্ত্রণার ভাগীদার? গাজায় যখন বোমা পড়ে, শুধু ভবন ভাঙে না-ভাঙে একটা জাতির আশা, একটা শিশুর স্বপ্ন, আর এই পৃথিবীর মানুষের বিবেক। চলুন, আমরা আর চুপ না থাকি। একটি শব্দ বলি অন্তত- “বন্ধ হোক এই হত্যা।”

লেখক: সাংবাদিক, জীবনমুখী লেখক, কলামিস্ট, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।