সাতক্ষীরায় প্রতারক চক্রের দাপট
মামলার বাদির নামে ধর্ষণ ও সাক্ষীদের নামে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে মামলা, মামলার আসামিরা সাক্ষী

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : প্রতারণার ফাঁদে ফেলে ঘরের মধ্যে আটকে রেখে পুলিশের সহায়তায় এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৭৫ হাজার টাকা ছিনতাইয়ের পর বিবস্ত্র করে এক নারীর সঙ্গে আপত্তিকর ছবি তুলে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে অলিখিত তিনটি নন জুডিশিয়াল স্টাম্পে সাক্ষর নেওয়ার অভিযোগে গত ৫ এপ্রিল সাতক্ষীরা সদর থানায় দায়েরকৃত মামলার বাদির বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও সাক্ষীদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার আগরদাঁড়ি গ্রামের এক নারী বৃহষ্পতিবার সাতক্ষীরার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এ মামলা দায়ের করেন। বিচারক মোছাঃ মাফরোজা পারভিন মামলাটি এফআইআর হিসেব গণ্য করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশে দিয়েছেন।
মামলার আসামিরা হলেন, গত ৫ এপ্রিল সাতক্ষীরা সদর থানায় দায়েরকৃত পর্ণগ্রাফি ও চাঁদাবাজির ধারায় দায়েরকৃত মামলার বাদি কালিগঞ্জ উপজেলার মথুরেশপুর ইউনিয়নের গণপতি গ্রামের ফজর আলীর ছেলে জাসাস নেতা ও নাজিমগঞ্জ বাজারের চায়না বাংলা কসমেটিকস ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাািথধকারী রিপনুজ্জামান রিপন, মামলার সাক্ষী গণপতি গ্রামের আবুল কাশেম এর ছেলে শহীদুল ইসলাম, সাক্ষী কালিগঞ্জের বাস টার্মিনাল এলাকার জিয়াদ আলীর ছেলে হাবিবুল্লাহ ও সাতক্ষীরা সদর উপজেলার জোড়দিয়া গ্রামের রাশেদ আলীর ছেলে শেখ মেহেদী হাসানসহ অজ্ঞাতনামা ২/৩ জন।
মামলার বিবরনে বাদি উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১ নং আসামি রিপনুজ্জামান রিপনের সঙ্গে বাদির মোবাইল ফোনে পরিচয় হয়।
গত পহেলা এপ্রিল বিকেল ৫টার দিকে আসামী রিপনুজ্জামান রিপন বাদিনীকে কাটিয়া সরকারপাড়ার আশরাফ হোসেনের বাড়ির ভাড়া বাসায় ১নং আসামী ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে সকল আসামী বাদিনীর মুখ চেপে ধরে। ২ নং আসামী বাদিনীর শরীরের সমস্ত কাপড় চোপড় খুলে ফেলে। আসামী হাবিবুল্লাহ ও মেহেদী বাদিনীর দুই হাত চেপে ধরে। আসামী রিপন বাদিনীকে ধর্ষণ করার পর অপর তিন আসামী বাদিনীকে ধর্ষণ চেষ্টা করে। বাদিনীর চিৎকার করলে আসামীরা বাদিনীর কাছ থেকে ১০০ টাকার তিনটি নন জুডিশিয়াল স্টাম্পে(গক- ৯১৯৫৮৮৬, গক ৯১৯৫৮৮৭ ও ৯১৯৫৮৮৮) সাক্ষর করে নেয়। নন জুডিশিয়াল স্টাম্পে বাবলুর রহমান, ফজর আলী ও কাউয়ুমকে সাক্ষী করা হয়।
বাদিনীর আইনজীবী সাতক্ষীরা জজকোর্টের অ্যাড. নুরুল আমিন জানান, বাদিনীর অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গণ্য করার জন্য সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
অপর দিকে কালিগঞ্জ উপজেলার গণপতি গ্রামের ফজর আলীর ছেলে ও নাজিমগঞ্জ বাজারের চায়না বাংলা কসমেটিকস ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক রিপনুজ্জামান রিপনের গত ৫ এপ্রিল দায়েরকৃত মামলা ও সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারের কাছে করা অভিযোগ থেকে জানা যায়. কালিগঞ্জের বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের মুুকুন্দমধুসুধনপুর গ্রামের মিজানুর রহমানের মেয়ে শারমিন আক্তার রিমার সঙ্গে পূর্ব পরিচয়ের কারণে গত ১৭ মার্চ বিকেলে শারমিন আক্তার রিমা ব্যবসায়ি রিপনের দোকান থেকে ৫ হাজার ৫০০ টাকার মালামাল বাকীতে গ্রহণ করে। গত পহেলা এপ্রিল বাকী টাকা দেওয়ার কথা বলে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে রিমার বাসায় ডেকে নিয়ে যায়।
এ সময় রিপনের কাছে ৫৪ হাজার ৩০০ টাকা ছিল। সেখানে তাকে একটি চেয়ারে বসতে দিয়ে রিমা বের হয়ে যায়। পাশের বন্ধ রুম থেকে সদর থানার সহকারি উপপরিদর্শক আব্দুর জব্বারসহ শারমিন আক্তার রিমার সাবেক স্বামী কালিগঞ্জের বিষ্ণুপুর ইউপি সদস্য মুকুন্দুপুর গ্রামের এলাহী বক্স গাজীর ছেলে জাপা নেতা আব্দুল কাদের, দেবহাটার পুষ্পকাটি গ্রামের শেখ আব্দুর রউফ এর ছেলে বাবলুর রহমান, পুরাতন সাতক্ষীরার সাংবাদিক পরিচয়দানকারি ফজর আলীসহ আরো দুইজন বেরিয়ে আসে। এ সময় বাবলুর রহমান ও সহকারি উপপরিদর্শক আব্দুর জব্বার তাকে লাথি মেরে চেয়ার থেকে মেঝেতে ফেলে দেয়। এ সময় কাদের, বাবলু, ফজলু, আব্দুর জব্বারসহ কয়েকজন তাকে মারপিট করে পকেটে থাকা ৫৪ হাজার ৩০০ টাকা নিয়ে আব্দুর জব্বার তাকে হাতকড়া পরিয়ে ওই ঘরে আটকে রাখে। আব্দুল কাদেরসহ সকলে রাত সাড়ে সাতটার দিকে তার কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। উপায় না দেখে তিনি তার গ্রামের ভাই শহীদুলের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা বিকাশে আনার ব্যবস্থা করেন। তার বিকাশে থাকা এক হাজার ও শহীদুলের পাঠানো বিকাশের ২০ হাজার টাকা তারা উত্তোলন করে নেয়।
কাদেরসহ ঘরের মধ্যে থাকা প্রতারক চক্রের সদস্যরা তাকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে একজন নারীর (সদর উপজেলার আগরদাড়ি গ্রামের বাসিন্দা ও বৃহষ্পতিবার ধর্ষণের মামলার বাদিনী) সঙ্গে আপত্তিকর ছবি তুলতে বাধ্য করে ভিডিও করে। পরে ওই ভিডিও বিভিন্ন লোকজনের কাছে পাঠায় তারা। এ ছাড়া ওই ছবি বিভিন্ন লোকের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে সম্মান নষ্ট করার ভয় দেখিয়ে রিপনের কাছ থেকে দাবিকৃত পাঁচ লাখ টাকার জন্য ১০০ টাকার তিনটি অলিখিত নন জুডিশিয়াল স্টাম্পে সাক্ষর করিয়ে নিয়ে পহেলা এপ্রিল রাত ১০টার দিকে ছেড়ে দেয়। সেখান থেকে বের হয়ে তিনি প্রাথমিক চিকিৎসা নেন। গত ৫ এপ্রিল রিপন সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারের কাছে বিস্তারিত অবহিত করার পাশাপাশি সহকারি উপপরিদর্শক আব্দুর জব্বারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। অপর চার প্রতারক সহ অজ্ঞাতনামা তিন জনের বিরুদ্ধে শনিবার থানায় মামলা করেন।
তবে সাতক্ষীরা সদর থানা সূত্রে জানা গেছে, আব্দুল কাদের ও শারমিন আক্তার রিমি কখনো স্বামী স্ত্রী সেজে আবার কখনো বন্ধু সেজে দীর্ঘদিন ধরে নারীকে ব্যবহার করে ফাঁদে ফেলেছেন কমপক্ষে ৩০ জন ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবী ও সাংবাদিককে। ২০২৩ সালের ২৬ এপ্রিল তাদের পাতা ফাঁদে কালিগঞ্জের এক সাংবাদিককে পলাশপোল এলাকার একটি হোটেলে ডেকে নিয়ে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করে তার উপর নির্যাতনের ছরি সোসাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়ে উল্টে তার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়। পরে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসায় ওই সাংবাদিকের স্ত্রী বাদি হয়ে শারমিন আক্তার রিমা ও আব্দুল কাদেরের নামে পর্ণগ্রাফি আইনে মামলা করেন।
(আরকে/এসপি/এপ্রিল ১০, ২০২৫)