সদরঘাট রক্ষায় ফের অবরোধ, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের আশঙ্কা
কর্ণফুলীতে মাঝিদের ঘাট হারানোর শঙ্কা: চসিকের ভূমিকা কতটা ন্যায্য?

স্টাফ রিপোর্টার : "বৈঠা যার, ঘাট তার"—এই নীতিই হওয়া উচিত। কিন্তু চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর সাম্পান মাঝিদের জন্য বাস্তবতা ভিন্ন। অভিযোগ উঠেছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রকৃত পাটনিজীবীদের কাছ থেকে ঘাটগুলো কেড়ে নিয়ে একটি চক্রের হাতে তুলে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে। এই চক্রটি বহিরাগত ও নামসর্বস্ব পাটনিজীবীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে চসিক মেয়রকে বিভ্রান্ত করে একের পর এক ঘাটের নিয়ন্ত্রণ দিচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় অভয়মিত্রঘাটের পর এখন সদরঘাট নিয়েও অনিয়মের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। করছে নানা ষড়যন্ত্র, এমনটাই দাবি সাম্পান মাঝিদের।
মেয়র কি প্রকৃত ঘটনা জানতে পারছেন?
সাম্পান মাঝিরা অভিযোগ করছেন, তাঁরা আগেভাগেই সিটি মেয়র, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ও এস্টেট শাখার কাছে দরখাস্ত জমা দিয়েছিলেন, কিন্তু চসিকের কিছু কর্মকর্তা সেই আবেদন মেয়রের সামনে তুলে ধরেননি। ফলে মেয়র প্রকৃত ঘটনা থেকে দূরে রয়েছেন। এতে রাজস্ব শাখার কিছু ব্যক্তি স্বার্থান্বেষী মহলের সুবিধা নিশ্চিত করতে পারছেন, যা প্রকৃত মাঝিদের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠছে।
এছাড়া, যাঁরা নতুন করে সদরঘাটের খাস কালেকশনের দায়িত্ব পাচ্ছেন, তাঁদের কেউই পেশাদার মাঝি নন। তাঁরা নিজেদের মেয়রের ঘনিষ্ঠ পরিচয় দিয়ে প্রভাব খাটাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে করে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাট—সদরঘাট, অভয়মিত্রঘাট ও বাংলাবাজারের প্রায় ১ হাজার মাঝির জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। এর ফলে, যে কোনো সময় মাঝিরা ঘাটে সাম্পান চলাচল বন্ধ রেখে অবরোধ, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মাঝিদের অভিযোগ: অনিয়মে জড়িত চসিক কর্মকর্তারা
বিশেষ সূত্র জানায়, কর্ণফুলীর ঘাট ইজারার অনিয়মের পেছনে চসিকের এস্টেট শাখার কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী সরাসরি জড়িত। এ কারণেই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কিছু ব্যক্তি ঘাট দখলের সুযোগ পাচ্ছেন, যা সাধারণ মাঝিদের জন্য বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাম্পান মাঝিরা দীর্ঘদিন ধরে ঘাটগুলোতে যাত্রী পারাপার করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। তাঁরা বহুবার চসিকের কাছে প্রকৃত পাটনিজীবীদের তালিকা পুনর্গঠনের অনুরোধ জানিয়েছেন, কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি। বরং বহিরাগতরা ভুয়া পরিচয়ে পাটনিজীবী তালিকাভুক্ত হয়ে ঘাটের ইজারা/খাস কালেকশন আদায়ের কাজ নিচ্ছে, এতে করে প্রকৃত মাঝিরা কাজ হারাচ্ছেন এবং সাধারণ যাত্রীদের যাতায়াত ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
সদরঘাটের নতুন নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক
গত ২৩ মার্চ মো. হাসান রুবেল নামে এক ব্যক্তিকে সদরঘাটের খাস কালেকশনের সহযোগী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, তিনি কখনো সাম্পান চালানোর সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তবুও চসিকের এস্টেট অফিসার (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী তাঁকে এই দায়িত্ব দেন। এর ফলে প্রায় তিন ঘাটের ১ হাজার পেশাদার সাম্পান মাঝির জীবিকা সংকটে পড়েছে। এই সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে মাঝিরা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন কর্ণফুলী উপজেলা বিএনপি'র সাবেক সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার হারুনুর রশিদ, উপজেলা বিএনপির সাবেক যুব বিষয়ক সম্পাদক মো. ইসমাইল, চরপাথরঘাটা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মির্জা মোহাম্মদ ইসমাইল, সাধারণ সম্পাদক সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আলহাজ্ব এম মঈন উদ্দিন, কর্ণফুলী নদী সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি এসএম পেয়ার আলী, সিনিয়র সহ-সভাপতি জাফর আহমেদ, চরপাথরঘাটা ব্রিজঘাট সাম্পান চালক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. কোরবান আলী, চট্টগ্রাম ইছানগর বাংলাবাজার ঘাট সাম্পান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইউসুফ, সদরঘাট সাম্পান মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলী, সাধারণ সম্পাদক নুর মোহাম্মদ, ইছানগর সদরঘাট সাম্পান মালিক সমিতির ক্রীড়া সম্পাদক আবদুন নবী, সিনিয়র সদস্য মো. শাহাজান, জানে আলমসহ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত সকল ঘাটের সদস্যবৃন্দ।
মাঝিদের পক্ষে আইনি ও সামাজিক সমর্থন
ইতিমধ্যে কর্ণফুলীর ১ হাজার সাম্পান মাঝি ও তাঁদের পরিবারের ১৫ হাজার মানুষের স্বার্থ রক্ষায় ইছানগর সদরঘাট সাম্পান টেম্পু মালিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শফি চসিকের কাছে লিখিত দরখাস্ত জমা দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'সদরঘাটের পাটনিজীবী মাঝিরা দীর্ঘদিন ধরে খাস কালেকশনে চসিককে সহযোগিতা করে আসছে। এখন বহিরাগত কাউকে দায়িত্ব দিলে আমাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে।'
মাঝিদের দাবির পক্ষে কর্ণফুলী নদী সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি এসএম পেয়ার আলী বলেন, '২০০৩ সালের পাটনিজীবী নীতিমালা লঙ্ঘন করে বহিরাগতদের দিয়ে ঘাটের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। এটি সাম্পান মাঝিদের জীবন-জীবিকার ওপর সরাসরি আঘাত। চসিককে অবশ্যই মাঝিদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। না হয় আন্দোলন ছাড়া কোন উপায় নেই।'
সদরঘাট রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক চৌধুরী ফরিদ বলেন, 'সদরঘাট কর্ণফুলীর একটি ঐতিহ্যবাহী নৌঘাট। এটি মাঝিদের সংগ্রামের ফসল। এখানে যদি অনিয়ম হয়, তাহলে মাঝিদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। চসিকের উচিত নীতিমালার ভিত্তিতে প্রকৃত মাঝিদের হাতে ঘাটের দায়িত্ব দেওয়া।'
আইনি দিক: আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষিত?
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ১৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের রিট পিটিশন (১৫১৬৩/২৩) অনুযায়ী অভয়মিত্র ঘাটের ইজারা কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছিল। কিন্তু ২৩ অক্টোবর চসিকের সাবেক প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ফেরিঘাট ইজারার ১০ নম্বর শর্ত প্রত্যাহার করে দেন। এতে অনেকে অভিযোগ করছেন, আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে চসিক কিছু সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করছে।
আইনি নীতিমালা অনুসারে, স্থানীয় সরকার নীতিমালার ফেরিঘাট ব্যবস্থাপনা নীতিতে (অনুচ্ছেদ ২) পেশাদার পাটনিজীবীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া, ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়েল ১৯৯০-এর ২৪০ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পেশাদার মাঝিরাই ঘাট ইজারার বৈধ দাবিদার।
কি বলছেন খাস কালেকশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত তারেক
সদরঘাটে সদ্য খাস কালেকশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আরাফাত রহমান কোকো স্মৃতি সংসদ (চট্টগ্রাম মহানগর)-এর সভাপতি মোহাম্মদ হাসান তারেক বলেছেন, 'আমি নিয়মতান্ত্রিকভাবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) এস্টেট শাখা থেকে সদরঘাটের খাস কালেকশনের দায়িত্ব পেয়েছি। এর আগে যারা দায়িত্বে ছিলেন, তারা আওয়ামী লীগের দোসর ছিলেন—এর প্রমাণও রয়েছে। তবে আমি কখনো সাম্পান মাঝিদের পেটে লাথি মারব না, বরং তাদের সঙ্গে সমন্বয় করেই কাজ করব। সাধারণ যাত্রীরা কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হবেন না, আর ঘাটে কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ড চলতে দেওয়া হবে না। এটা আমার নেতার নির্দেশ।
তিনি আরো বলেন, 'সদরঘাটের যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো যেমন যাত্রী ছাউনি ও পল্টনের ব্যবস্থা করা হবে। প্রয়োজনে মাঝিদের সঙ্গে আবারও বসব। আমি ইতোমধ্যে ব্রিজঘাটের সাম্পান মাঝিদের সঙ্গে আলোচনা করেছি এবং তাদের সমস্যাগুলো সরাসরি শুনেছি।'
চসিকের অবস্থান কী?
চসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা এস. এম. সরওয়ার কামাল জানান, 'মাঝিদের অভিযোগ আমরা আমলে নিয়েছি। মেয়রের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করব। চসিক সব সময় নীতিমালা মেনে কাজ করে, মাঝিদের ক্ষতি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।'
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, চসিক যদি সত্যিই নীতিমালা মেনে চলে, তাহলে মাঝিদের দীর্ঘদিনের অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার কথা নয়। তাঁরা মনে করেন, স্বচ্ছ কমিটি গঠন করে প্রকৃত পাটনিজীবী মাঝিদের হাতে ইজারা দেওয়া হলে সংকট সমাধান সম্ভব।
সাম্পান মাঝিরা চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের বাহক
কর্ণফুলীর সাম্পান মাঝিরা শুধু এই শহরের পরিবহনের অংশ নন, তাঁরা চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের বাহক। তাঁদের অধিকার নিশ্চিত করা শুধু মানবিক দায়িত্ব নয়, এটি আইনসম্মতও বটে। চসিক যদি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে মাঝিদের আন্দোলন তীব্র হতে পারে, যা সামগ্রিকভাবে নগর ব্যবস্থাপনার জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই, "বৈঠা যার, ঘাট তার"—এই নীতির প্রতি সম্মান জানিয়ে চসিকের উচিত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
(জেজে/এসপি/মার্চ ২৭, ২০২৫)