ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


আবহমানকাল থেকে বাংলাদেশী মুসলমানদের ঈদ সংস্কৃতি হলো, রুটি-রোজগারের জন্য দেশের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, বেতন-বোনাস যাই পাক বা না পাক, ধার-কর্য করে হলেও বাবা-মা ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে উৎসব পালন করা।আর ঈদের আর বেশি দিন বাকি নেই। জমে উঠেছে ঈদের কেনাকাটা। এ মার্কেট থেকে সে মার্কেটে ছুটছে মানুষ। বেড়ে গেছে যানবাহনের চলাচল। বেড়েছে যানজটও। রমজান শুরুর পর থেকে প্রায় প্রতিদিন সকাল থেকে ইফতার পর্যন্ত দেখা গেছে দেশের সব সড়কেই ভয়াবহ যানজট। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় বিপণিবিতানগুলোর সামনে যানজট থাকে সকাল থেকে ইফতারের সময় পর্যন্ত। ঈদের বাজারে মানুষের ঢল থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। যানজট, ভিড়-ভোগান্তি তো কিছু থাকবেই। কিন্তু জনভোগান্তিকে আরো বেশি বাড়িয়ে দেয়, আমাদের নিজেদের আইন অমান্যসহ কিছু নেতিবাচক প্রবণতা। এর সঙ্গে আছে কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনাজনিত দুর্বলতা। সবাই কর্তব্য সচেতন হলে এই ভোগান্তি কিছুটা হলেও সহনীয় রাখা যেত। আমরা সবাই নিয়ম মেনে, সবার সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে চললে ঈদের আগে বাকি দিনগুলোতে নিজেদের ভোগান্তিটা কিছুটা হলেও সীমিত রাখতে পারি।

এরই মধ্যে ঈদের কেনাকাটা থেকে শুরু করে সব রকম প্রস্তুতি চলছে বেশ জোরেশোরে। সামর্থ্য অনুযায়ী পরিবারের সবার জন্য নতুন পোশাক কেনা, ঈদের দিন ভালো এবং মজাদার সব খাবারের আয়োজনের ব্যবস্থা করা ছাড়াও প্রতিবছর দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাগরিক গ্রামের বাড়িতে ছুটে যায় প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ করতে। কর্মব্যস্ত জীবনে এসব মানুষের যেমন স্বজনদের সঙ্গ ভোগ করার অবসর মেলে না, তেমনি গ্রামে বসবাসরত স্বজনরাও বছরের এদিনটির জন্য পথ চেয়ে অপেক্ষা করে থাকেন। নাড়ির টানে গ্রামে ফেরা এসব মানুষের আকুতি যে কত গভীর, তা ঈদের সময় প্রতিটি টিকিট কাউন্টারের দিকে তাকালেই অনুভব করা যায়। দ্বিগুণ, তিনগুণ মূল্য দিয়ে হলেও টিকিট চাই। শুধু একটি টিকিটের জন্য রাতভর কাউন্টারে পড়ে থাকেন অসংখ্য মানুষ। কেউ টিকিট সংগ্রহ করতে পারেন, আবার কেউ হতাশ হয়ে ফেরেন। তবু শেষ চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। কিন্তু যারা টিকিট পান না, তারা কি হাল ছেড়ে দেন? দেন না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও ঝুলে পড়েন বিভিন্ন বাস, গাড়ি ও লঞ্চের অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে। কারণ তাকে যে বাড়ি ফিরতেই হবে।

আমাদের দেশে যাত্রীর তুলনায় গণপরিবহনের সংকট এমনিতেই প্রকট। এর ওপর ঈদের সময় যাত্রীর চাপ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ফলে বাড়ি ফেরা মানুষগুলো দিশেহারার মতো যেখানে সুযোগ পায় চড়ে বসে। নিজেদের নিরাপত্তার কথা একবারও ভাবে না। এছাড়া এদের ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করার মতোও কেউ নেই। বরং যাত্রী চাপের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে কিভাবে দু’পয়সা বাড়তি লাভ করা যায় সেই লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যায় পরিবহন কর্তৃপক্ষ। এই উদ্দেশ্যে এ সময় তারা অনেক লক্কড়ঝক্কড় বাস, ট্রেন ও লঞ্চ কোনো রকম রঙচঙ করে নামিয়ে দেয় পথে। ফলে প্রতিবছরই একাধিক দুর্ঘটনা ঘটে এবং অনেক প্রাণহানিও হয়। তা সত্ত্বেও কারো কোনো সর্তকতা নেই। প্রতিকারের নেই কোনো উদ্যোগ। এবারের ঈদকে সামনে রেখেও চলছে পুরনো লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি, লঞ্চ রং করা, ট্রেনের বগি রং করা ও সংযোজনের প্রস্তুতি। বিশেষ করে নৌযানগুলোর ক্ষেত্রেই এ ধরনের চিত্র বেশি দেখা যায়। এসব ফিটনেসবিহীন যান পথে নামবে দূরপাল্লার যাত্রী পরিবহনে। ফলে প্রতি মুহূর্তেই থেকে যাবে জীবনের ঝুঁকি। প্রতিবছরই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে দায়সারা বক্তব্য ছাড়া কোনো সহায়তাই পাওয়া যায় না।

সৃষ্ট পরিস্থিতি আমলে নিয়ে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। কারণ মানুষ সারা বছর পরিশ্রম করে যখন ঈদের আনন্দকে ভাগাভাগি করে নিতে ব্যস্ত থাকে, তখন যদি যাত্রাপথের ভোগান্তি বৃদ্ধি পায় তবে তা অত্যন্ত পরিতাপের। আমরা চাই, সরকার সংশ্লিষ্টরা সামগ্রিক বিষয়গুলোকে খতিয়ে দেখে যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত করুক। জানা যায়, বিভিন্ন স্থানে লোকাল বাস রংচং করে এবং নতুন করে সিট বাঁধিয়ে দূরপাল্লার যাত্রার জন্য তৈরি করা হচ্ছে। এমনকি দীর্ঘ সড়ক পাড়ি দেওয়ার জন্য লোকাল বাসের চালকরাও প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। আর এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অদক্ষ লোকাল বাসের চালকরা দূরপাল্লার যাত্রায় গাড়ি নিয়ে নামলে শুধু পথের ভোগান্তিই বাড়বে না; সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানিরও শঙ্কা রয়েছে।

ঈদের সময় এসব যানের মালিকরা যাত্রী পারাপারের মাধ্যমে মৌসুমি আয় করে নিতে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ভাড়া কম হওয়ায় এসব ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চ, ট্রলারকেই বেছে নেন স্বল্প আয়ের মানুষ।

ভাঙাচোরা গাড়ি দিয়েই দেশের বিভিন্ন রুটে যাত্রী পরিবহন চলবে। প্রশাসনের নজর এড়াতেই মূলত এই রঙের প্রলেপ। প্রশাসন যদি তৎপর হয়, তবে রং করে যে প্রকৃত অবস্থা কোনোভাবেই আড়াল করা সম্ভব নয়, এটি সচেতন মাত্রই জানেন। তবু ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের প্রয়োজনে যান সঙ্কটের দোহাই দিয়ে এসব অনিয়ম দেখেও না দেখার ভান চলছে বছরের পর বছর। এতে ঈদের আনন্দ নিমিষেই বিষাদে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি থাকলেও কারো যেন কিছুই করার নেই। অন্যদিকে ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের হাতে অগ্রিম টিকিট বুঝিয়ে দিতেও চলছে নানা তেলেসমাতি। এমন অনেক বাস মালিক আছেন যারা তাদের গাড়ির তুলনায় অতিরিক্ত অগ্রিম টিকিট বিক্রি করেছেন।

ফলে যাত্রীদের সিট বুঝিয়ে দিতে হলে এসব ভাঙাচোরা, সদ্য রং করা গাড়িই তাদের ভরসা। শেষ পর্যন্ত এসব গাড়ি নিরাপদে গন্তব্যে আদৌ পৌঁছতে পারবে কি না তা নিয়ে বাস মালিকদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এখানেই যাত্রীদের ঘরে ফেরার যন্ত্রণার শেষ নয়। বাস, ট্রেন ও লঞ্চের অগ্রিম টিকিটের ক্ষেত্রে মুখচেনা লোকদের প্রাধান্য দিতে দেখা গেছে সর্বক্ষেত্রে। ফলে কেউ কেউ রোদ, বৃষ্টি মাথায় করে ১৬ ঘণ্টা অপেক্ষা করেও টিকিটের দেখা পায়নি। অন্যদিকে ভিভিআইপিরা পাচ্ছেন কোটা সুবিধা। ফলে সাধারণ মানুষের ভাগ্যে হাহাকার আর দুর্ভোগ ছাড়া কিছুই মিলছে না।

আবার টিকিট পেলেও যাত্রা নিরাপদ হবে কি না এ নিশ্চয়তা দেওয়ার কেউ নেই। এসব চিত্র নতুন নয়। বছরের পর বছর ধরে একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটছে, কিন্তু সংকট নিরসনের কোনো উদ্যোগ নেই। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে যে কারণগুলোকে চিহ্নিত করা হয় তার মধ্যে অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ি এবং ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট অন্যতম। তা সত্ত্বেও ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রার ভার এসবের ওপরই ন্যস্ত থাকে। ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে প্রিয়জনের সান্নিধ্য। ঈদ মানে শত বাধা পেরিয়ে নাড়ির টানে ঘরে ফেরা। কিন্তু এই আনন্দ কারো গাফিলতি বা অসতর্কতায় বিষাদে পরিণত হোক- তা আমরা চাই না।

ঈদে বাড়ি যেতে ভোগান্তির কারণগুলো

১. প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ তাদের কর্মক্ষেত্র ছেড়ে বাড়ির দিকে পাড়ি জমান।

২. কোন উৎসবকে কেন্দ্র করে বাড়ির দিকে পাড়ি জমানোর এমন ঘটনা বিশ্বে প্রায় দুর্লভ।

৩. প্রতিবছর শিক্ষা, কর্মসংস্থান কিংবা ভাগ্য বদলের আশায় ঢাকায় আসে অসংখ্য মানুষ।

৪. বাড়ি ফেরা মানুষের স্রোত যখন একসাথে রাজধানী ছাড়ে তখন সৃষ্টি হয় ভোগান্তির।

৫. অতিরিক্ত মানুষের চাপ নিতে পারে না সড়কগুলো। তাই মাইলের পর মাইল যানজটে বসে থাকতে হয়।

৬. বাস, লঞ্চ কিংবা ট্রেনে ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী নিয়ে চলাচল জন্ম দেয় অনেক দুর্ঘটনার।

৭. বাড়ি ফেরা এ জনস্রোতের উল্লেখযোগ্য অংশ শ্রমজীবী মানুষ।

৮. ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যাওয়া অনেকটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

৯. যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং যাতায়াতের টেকসই উন্নয়নের অভাবে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।

১০. রাজধানীকে বিকেন্দ্রীকরণের কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় সমস্যা ঘনীভূত হচ্ছে।

১১. সারাদেশে সুষমভাবে কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে না পারাও ভোগান্তির অন্যতম কারণ।

সর্বোপরি বলতে চাই, সড়ক পথের নিরাপত্তা ও পরিস্থিতিকে আমলে নিতে হবে। ঈদযাত্রাকে সামনে রেখে দূরপাল্লার যাত্রায় লোকাল বাস কিংবা অদক্ষ চালক, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাটসহ সার্বিক বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। আসন্ন ঈদযাত্রাকে কেন্দ্র করে ঘরমুখো মানুষ যেন ভোগান্তি থেকে রক্ষা পায়, এর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিশ্চিত হবে—এমনটি আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।