মাহে রমজানে রোজাদারদের কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা কারণ ও প্রতিকার

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
রমজান মাসে রোগীরা নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তাদের রোজা রাখার মতো ফরজ কাজটি থেকে বিরত থাকেন না। রোজা রাখার সময় তাই ঝুঁকি এড়াতে এ সময় তাদের প্রয়োজন হয় বাড়তি সতর্কতা। রোজা রাখার ফলে যেসব রোগগুলো রোজাদারদের মধ্যে নানান প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে তার মধ্যে অন্যতম রোগটি হলো কোষ্ঠকাঠিন্য। আর কোষ্ঠকাঠিন্য এমনিতেই একটি যন্ত্রণাদায়ক ও বিরক্তিকর সমস্যা। রমজানে অনেকেরই এই প্রবণতা বেড়ে যায়। অনেক রোজাদার কমবেশি এ সমস্যায় ভোগেন। সাবধানতা অবলম্বন না করলে কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে মলত্যাগের সময় রক্তপাত এবং পাইলস ও অ্যানাল ফিসারের মতো জটিল সমস্যা দেখা দিতে পারে।
কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণ
কেউ যদি পর্যাপ্ত আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করার পরও সপ্তাহে তিনবারের কম পায়খানায় যান, তখন একে কোষ্ঠকাঠিন্য বলা যেতে পারে। নিচের লক্ষণগুলো দেখে কোষ্ঠকাঠিন্য নির্ণয় করা যায়:
• শক্ত পায়খানা হওয়া,
• পায়খানা করতে অধিক চাপের দরকার হওয়া,
• অধিক সময় ধরে পায়খানা করার পরও পূর্ণতা না আসা,
• আঙুল কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে পায়খানা বের করা এবং
• মলদ্বারের আশপাশ এবং তলপেটে ব্যথা অনুভব করা।
রোজায় কোষ্ঠকাঠিন্য বৃদ্ধির কারণ
রমজানে আমাদের খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। খাদ্যতালিকায় অধিক ভাজাপোড়াযুক্ত ও শাকসবজিহীন বা ফাইবারবিহীন খাবারের পরিমাণ বাড়ে। অপর্যাপ্ত পানি পান, গ্রীষ্মকালীন গরমে অধিক ঘামে সৃষ্ট হওয়া পানিশূন্যতা এবং দীর্ঘ ১৪-১৫ ঘণ্টা পানি পান করতে না পারার কারণও এর জন্য দায়ী। এ ছাড়া কিছু রোগ, যেমন হাইপোথাইরয়েডিজম; কিছু ওষুধ, যেমন ক্যালসিয়াম, আয়রন, অ্যালুমিনিয়ামসমৃদ্ধ প্রভৃতি কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রভাব বাড়িয়ে দিতে পারে।
রমজানে কীভাবে ভালো থাকবেন
ইফতারের পর থেকে সাহ্রি পর্যন্ত প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। খেতে হবে অধিক আঁশসমৃদ্ধ খাবার।
যেমন ঢেঁকিছাঁটা চাল, লাল আটা, গোটা শস্য, শাকসবজি ও ফলমূল। যেসব খাবার শরীরে পানি কমিয়ে ফেলে, সেসব খাবার বা পানীয়, যেমন চা, কফি, অধিক মসলাযুক্ত ও তেল-চর্বিজাতীয় খাবার, ভাজাপোড়া ও মাংস কম খেতে হবে।
একটি কমলা খোসা ছাড়িয়ে নিন। ব্লেন্ড করে রসটুকুর সঙ্গে সামান্য লবণ মিশিয়ে নিতে পারেন। এবার খেয়ে নিন। এটিও আপনাকে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি দেবে।
লেবু যে শুধু কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে তা-ই নয়, এটি আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়িয়ে তোলে। এর সঙ্গে জিরা ও মধু যোগ করে খেলে তো কথাই নেই!
একটি লেবুর অর্ধেকটা নিয়ে রস বের করে নিন। এককাপ গরম পানি নিন। এবার গরম পানিতে লেবুর রসটুকু মেশান। সঙ্গে মেশান এক চা চামচ মধু ও আধা চা চামচ জিরা গুঁড়া। ভালো করে মিশিয়ে খেয়ে নিন। কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি মিলবে সহজেই।
নাসপাতি খেতে হবে রস করে। এর মধ্যে আছে সরবিটল। এই সরবিটল মলের নির্গমনে বাঁধা দূর করে, তাই এই রস কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে ভীষণ কার্যকরী। এর সঙ্গে মিশিয়ে নিতে পারেন সামান্য লেবুর রস। লেবুর রসে আছে ভিটামিন ও মিনারেল যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
দুটি নাসপাতির বীজ বের করে ফেলে দিন। নাশপাতি ছোট ছোট টুকরা করে কেটে নিন। এবার ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে নিন। একটি ছাকনিতে রস ছেঁকে নিন। এবার দুই চামচ লেবুর রস ও একটি চিমটি লবণ মেশান। এবার খেয়ে নিন। ইফতারে এটি খেলে ভালো ফল পাবেন।
আপেলে যে প্রচুর ফাইবার আছে, একথা আমরা সবাই জানি। আরও আছে ভিটামিন আর মিনারেল। আপেলের রস কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে আপনাকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে। এর সঙ্গে সামান্য মৌরি গুঁড়া করে মিশিয়ে নিতে পারেন। মৌরিতে আছে ডায়াটেরি ফাইবার। এটি মলের মধ্যে পানির অংশ যোগ করে মল করে নরম।
একটি আপেলের বীজ বের করে ফেলে দিন। আপেলটি ছোট ছোট টুকরা করে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে নিন। আধা কাপ পানি মেশান। এবার একটি ছাঁকনিতে ছেঁকে রসটুকু বের করে নিন। এর সঙ্গে আধা চা চামচ মৌরির গুঁড়া মেশান। এরপর খেয়ে নিন। সাহরি বা ইফতার, আপনার সুবিধামতো সময়ে তৈরি করে খান এটি।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার জন্য ইসবগুলের ভূসি পানিতে ভিজিয়ে সাথে সাথে খেয়ে ফেললে এবং গরু ও খাসির গোশত এবং অন্যান্য চর্বিযুক্ত খাবার যেগুলো মল শক্ত করে তা থেকে দূরে থাকলে অনেকে উপকার পাবেন।
সতর্কতা
১. ইফতার কী দিয়ে করা হবে তার ওপর নজর দিন। সুস্বাস্থ্যের জন্য একটি খেজুর দিয়ে ইফতার ভাঙতে পারেন। এরপর এর পাশাপাশি ইফতারে রাখতে পারেন গ্রীষ্মকাল বা মৌসুমি ফলকে। কোষ্ঠকাঠিন্য এড়াতে ইফতারে ফলের জুস হিসেবে রাখতে পারেন বেলের শরবত, তরমুজের শরবত, বিশেষ করে ইসবগুলের শরবত রাখুন।
২. এ সময় খাবারে রাখতে পারেন ফাইবার জাতীয় খাবার ও হেলদি ফুডকে। বাইরে তৈরি খাবারের পরিবর্তে ইফতারের প্রাধান্য দিন বাড়িতে তৈরি খাবারকে।
৩. কোষ্ঠকাঠিন্য এড়াতে কখনই ইফতারে বেশি খাবার খাওয়া যাবে না। ইফতারে বেশি খাবার খেয়ে অনেকেই রাতের খাবার বাদ দেন। তা মোটেও করা যাবে না। এর জন্য ইফতারে খেতে হবে এমন পরিমাণ খাবার যাতে রাতের খাবার সামান্য পরিমাণে হলেও খাওয়া যায়।
৪. রাতের খাবারের মাঝে মাঝে যে সময়টা ঐ সময়টাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করার চেষ্টা করতে হবে।
৫. যাদের একটু হাঁটার অভ্যাস আছে তারা অবশ্যই খাবার গ্রহণের পরপরই কোনো ফিজিক্যাল অ্যাকটিভিটিতে যাবে না। কারণ সারাদিন অনাহারে থাকার পরে আমরা যখন খাবার গ্রহণ করি তখন ভরা পেটে হাঁটা বা ফিজিক্যাল অ্যাকটিভিটি করলে তা শারীরিক সমস্যা তৈরি করতে পারে।
৬. সেহরিতে কখনই ভরপেট খাওয়ার চেষ্টা করা যাবে না। এসময় সহজে হজম হয় এমন খাবারগুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে।
৭. সহজে হজম হয় এমন খাবারের মধ্যে রয়েছে আমরা রুটি, লাল চাল, শস্যজাতীয় খাবার ও রঙিন ফলমূল।
৮. মাংস বা যেকোনো খাবার অবশ্যই ভালো করে চিবিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। কখনই সেহরি খেতে তাড়াহুড়ো করা যাবে না। যাদের ৫ বা ১০ মিনিটে সেহরি খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে তাদের এই অভ্যাস বন্ধ করতে হবে।
৯. দামি খাবার মানেই ভালো খাবার এমন ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। দামি বা টেস্টি খাবারের চেয়ে হেলদি খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে।
১০. কোষ্ঠকাঠিন্যের আরেকটি বড় সমস্যা হলো অনেক বেশি সময় টয়লেটে বসে থাকা। তাই এই অভ্যাসটি বাদ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টয়লেটে বেশি সময় না থাকা এবং নির্দিষ্ট সময়ে টয়লেটে যাওয়ার অভ্যাসে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে অনেকটাই দূরে থাকা যায়।
১১. অনেকেরই পাইলস বা এনাল ফিশারের সমস্যা থাকে। এই ধরনের সমস্যা যাদের থাকে তাদের রমজানে কোষ্ঠকাঠিন্য অনেকটাই বেড়ে যায়। এই সমস্যায় অনেক রোগীর মল শক্ত হয়ে যায়। কখনও কখনও রোগীর ব্লিডিং বা ব্যথা হতে পারে। যাদের এই সমস্যা আছে তাদের আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
১২. এই সমস্যা সমাধানে তারা বাজারে বিভিন্ন ধরনের সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করতে পারেন। এর ব্যবহারে মল অনেকটাই নরম থাকে ও রোগী আরাম বোধ করে।
এভাবেই রোজার সময় কোষ্ঠকাঠিন্যকে সহজে নিয়ন্ত্রণে রেখে রোজা রাখা যাবে। সেই প্রতিকার করা যাবে কোষ্ঠকাঠিন্যের নানান উপসর্গকেও।তাই চিকিৎসক রোগীদের রোগের বিবরণ নিয়ে, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, কী কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য হচ্ছে সেটি শনাক্ত করে যথাযথ চিকিৎসা দেবেন।আর নিজেকে সুস্থ ও নিরাপদ রাখতে এইটুকু চেষ্টা আমাদের সকলেরই করা উচিত।
লেখক : চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।