মারুফ হাসান ভূঞা


গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে পুলিশের নিয়ন্ত্রণ কাঠামো ধারা নিষ্ক্রিয় করবার যে অপচেষ্টা আবারো জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত রূপে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা চলছে, এটি ফ্যাসিবাদী কাঠামোর নয়ারুপ হিসেবে ধরে নেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। নয়া রূপ সংযোজনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মৌন সমর্থন লক্ষ করা যাচ্ছে। যা যে কোনো ঘটনা পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভাষাগত বক্তব্যে প্রায় দৃশ্যমান হয়। 

জুলাই গণঅভ্যুত্থান প্রেক্ষাপট যে কারণে তৈরি হয়েছে তাঁর একটা বড় কারণ শেখ হাসিনার অর্থনীতি ব্যবস্থা, এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষকে ফ্যাসিবাদী শাসনে সামজিক ভাবে আবদ্ধ রেখেছিল। যার ফলে শেখ হাসিনার পতনের সময়কাল দীর্ঘতর হয়েছিল। হাসিনার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কী? হাসিনার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল শোষণ মূলক, লুটতরাজ ও মাফিয়াতন্ত্রের অর্থনীতি। আর তার শাসনামলের নির্যাতন, নিপীড়ন ও গুম, হত্যার আয়োজন ছিল সেটা তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রক্ষার কবজ।

এই প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদের এক কলামে লেখেন “গত কয়েক দশকে উন্নয়নের ধরনটা এমন যে সেখানে কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ছিল না। আমাদের দেশের অর্থনীতির ভঙ্গুর অবস্থার জন্য শুধু শেখ হাসিনাই নয় বরং গত কয়েক দশকে সরকারে থাকা লোকদেরও দায় রয়েছে। এছাড়া বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, এস আলম, সামিট, মেঘনার মতো কতিপয় গোষ্ঠীর দায় রয়েছে। এই গোষ্ঠীগুলোর উদ্ভব ও বিকাশের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, এরা শেখ হাসিনার আমলে তারা সম্পদ পাচারের ক্ষেত্রে চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এছাড়া এদের উদ্ভবে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ’র মতো উন্নয়ন সহযোগীরা পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করেছে। জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা না থাকার কারণে এই ধরনের বড় ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে।”

কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন সময়কালে যে আশ্বাস জনগণ দেওয়া হয়েছিল “ যে কাঠামো হাসিনার মতো শাসক তৈরি করে সে কাঠামোর বিলুপ্তি ও সঠিক গণতান্ত্রিক কাঠামোর রুপান্তর।” সে আশ্বাস দিনে দিনে ভাষাগত পরিবর্তনের আবরণে নয়া রূপান্তর হচ্ছে বলে ধারণা করা যায়। অর্থাৎ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পাল্টানোর আশ্বাস থেকে সংস্কার প্রতিশব্দে রূপান্তরিত করে সেখান থেকেও গুটিয়ে নিয়েছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অন্তরায় ঢুকে পড়ে একটা ধোঁয়াশাময় রূপে দৃশ্যমান। এই ধোঁয়াশাময় রূপ ফ্যাসিবাদী শাসনের উন্নত সংস্কৃতি বলে আখ্যা দেওয়া ছাড়া আর কোনো সত্য হতে পারে না। সাথে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যতোটা না গণতান্ত্রিক চর্চা রক্ষার সংস্কৃতিকে প্রলুব্ধ করেছে তারচেয়ে জনপ্রিয়তা মূলক অগণতান্ত্রিক চর্চাকে প্রলুব্ধ করেছে। যার ফলে সামাজিক ভাবে শেখ হাসিনার শাসন যে ফ্যাসিবাদী মননের ব্যাধি মানুষের মাঝে রূপায়িত করেছে তার প্রকাশ এই সময়ে তীব্র ভাবে হচ্ছে, এই হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে গিয়ে কোথাও কোথাও প্রায় অধিকতর সমর্থন জুগিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

সারাদেশে অব্যাহত চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, মব ভায়োলেন্স ও হত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়ন নিবৃত করতে সরকার ব্যবস্থা নেওয়াকে উপেক্ষা করে, ব্যর্থতাকে অস্বীকার করে জনপ্রিয়তামূলক বচনে সীমাবদ্ধ থেকেছে। অর্থাৎ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যতোটা না জননিরাপত্তার কথা ভেবেছে তারচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তায় মনোযোগ নির্ধারণ করেছে। এটি খুবই জনগণের বিশ্বাসের নিকট আশংকাজনক চরিত্র। যা কেবল নিন্দনীয় নয়, এক ধরনের অবৈধতার প্রশ্নও বটে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে অব্যাহত নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণ পূর্বের তুলনায় অধিক কিংবা কম, দশজনে একজন অথবা একশ জনে একজন এটি কে গুরুত্বের সাথে প্রতিরোধ, মোকাবিলার চেয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিসংখ্যানে থেমে থেকেছে। এবং যে শক্তি গুলো এই নারী নিপীড়ন, নির্যাতনকে বৈধতা কিংবা আকারে, ইঙ্গিতে প্রলুব্ধে করছে সে শক্তির ব্যাপারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদাসীনতা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্তরায় ধোঁয়াশার গল্পকে সত্যতা দেয়।

সে সত্য আরো গুরুতর বাস্তবতায় রূপান্তর হচ্ছে গত কয়েকমাসে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পুলিশের পুরোনো চরিত্রের নয়া রূপে আক্রমণের দৃষ্টান্ত। আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উপর হামলায় স্টুডেন্ট ফর সাবরেন্টিকে মৌন সমর্থন দিয়ে এই নয়া রূপের আবির্ভাব ঘটে। পরবর্তী সময়ে হামলার প্রতিবাদে শান্তি পূর্ণ মিছিলে পুলিশের নৃশংস হামলা ও ইবতেদায়ী মাদ্রাসার নারী শিক্ষকদের উপর ন্যাক্কারজনক ভাবে লাঠিপেটা, জ্বল কামান নিক্ষেপ ছাড়াও আরো বেশ কিছু গণতান্ত্রিক আন্দোলনে হামলা।

সমালোচনা ধানা বাঁধা শুরু করলে আন্দোলনকারীদের না মেরে বিদ্যুৎ এর খুঁটিতে আঘাত করে বিতর্ক এড়ানোর পর চূড়ান্ত ভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে হামলার ন্যায্যতা নিশ্চিতে পুলিশ পরিকল্পনা মাফিক পরিবেশ তৈরির আয়োজন করে ১১ মার্চ ২০২৫ মঙ্গলবার। ধর্ষণ ও নিপীড়ন বিরোধী ব্যানারে শিক্ষার্থীদের স্মারক লিপি দেওয়ার কর্মসূচিতে একজন কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তার সিভিল পোষাকে ঢুকে পড়ে হঠকারিতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, নারী এবং কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে আক্রান্ত করার পর শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে প্রমাণ করা পালটা শিক্ষার্থীদের উপর মিথ্যা বানোয়াট মামলা। পুলিশের পুরোনো দমন-পীড়ন কাঠামোর আধুনিকায়ন হিসেবে ধরা যায়। এই কাঠামো আরো আরো নয়া রূপে রূপান্তরিত করবে ফ্যাসিবাদী কাঠামো ও নয়া শাসককে।

সুতরাং ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের কাঠামোকে রক্ষা করবার যে অপচেষ্টা প্রতি ক্ষণে সংস্কার কিংবা প্রতিশব্দের ব্যবহারে আবদ্ধ করে রাখা হচ্ছে। তা দিয়ে এদেশের মানুষের প্রকৃত শোষণ মুক্তি মিলবে না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কিংবা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনা যে শোষণ মুক্তির লড়াইয়ের প্রেরণা ছিল সেটাকে ক্ষুণ্ন করে ফ্যাসিবাদী শাসনের আধুনিকায়ন, দীর্ঘয়ান অব্যাহত থাকলে আগামী শাসন ব্যবস্থা আরো দুর্বিষহ, বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।

লেখক : লেখক ও একটিভিস্ট।