রহিম আব্দুর রহিম


জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নদী-নদীর দেশ, বাংলাদেশকে এক সময় নদীমাতৃক দেশ বলা হতো। এখন নদ-নদী ভরাট, নেই আগের সেই প্রকৃতি, না আছে নদীর কলতান, হারিয়ে গেছে নৌ-পথের জৌলুস। অসংখ্য নদীর দেশে নদ ছিলো মাত্র দুটি, তার একটি ব্রহ্মপুত্র, অন্যটি কপোতাক্ষ। 'নদ' এবং 'নদী'র সহজ একটা ব্যাখ্যা পেলেই 'নদ' এবং 'নদী'র পাড়ের জন-মানুষদের জীবনের ভাঙা-গড়ার একটি চিত্র খুঁজে পাওয়া সম্ভব। যে স্রোতধারা একপাড় ভাঙে, অন্য পাড় গড়ে তাকে নদী বলে। তাই গানের সুরে ভেসে আসে, 'নদীর একুুল ভাঙে, ওকুল গড়ে এইতো নদীর খেলো।'

অপরদিকে যে স্রোতধারা দুই পাড়ই ভাঙ্গে তাকে নদ বলে। ব্রহ্মপুত্র নদ তেমনি একটি স্রোতধারা। যেটি চীন হয়ে ভারতের আসাম, অরুণাচল রাজ্যের গুয়াহাটি, শিলঘাট, তেজপুর পেরিয়ে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ ও জামালপুর হয়ে, যমুনার স্রোতের গতিপথ ধরে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যায় গিয়ে মিলিত হয়েছে। অপরদিকে কপোতাক্ষ নদটি বাংলাদেশের দক্ষিণ -পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা বিভাগের চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)'র তথ্য অনুযায়ী নদটির নম্বর-২৩৮।

এই নদ দু'টির প্রবাহিত গতিপথের শাখা-প্রশাখার নদীর এপাড়-ওপাড়ের সু'দিনের অসংখ্য জনশ্রুতি যেমন রয়েছে, তেমনি মহা-কাব্যসম নদীর পাড়ের দুঃখগাঁথাও অবিরাম বহমান। আজ থেকে প্রায় ৮০ বছর আগের কথা, এই ভূখন্ডের মানুষের সকল প্রকার যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে নৌপথ্যই ছিলো অন্যতম যোগাযোগ মাধ্যম। এক দেশ থেকে অন্যদেশে যাবার জন্য ব্যবহার হতো নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার সর্বোপরি পানির জাহাজ। সংক্ষিপ্ত যোগাযোগে হরদম ব্যবহার হতো হরেক রকম নৌকা। যা দুইযুগ আগেও ছিলো সচল। বালাসীঘাটের ইতিকথায় লোকায়ত জানা অজানা বিচিত্রকাহিনী।

১৯৩৮ সালের কথা, দেশের পূর্ব- উত্তরাঞ্চলের জনমানুষের সাথে পশ্চিম-উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং পূর্ব -উত্তরাঞ্চলের জন-মানুষের দৈনিন্দন সকল প্রকার যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্যের দিগন্তসম চলাচল ছিলো দক্ষিণাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনমানুষের এই নদী পথ ধরে। ওই সময় জামালপুর মহকুমার দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে আসা লঞ্চ ঠেকতো গাইবান্ধার তিস্তামুখ ঘাটে। যমুনার করালগ্রাসী স্রোতে ৩০বছরের ব্যবধানে ১৯৭২-১৯৭৪ এর দিকে ওইঘাট নিশ্চিহৃ হয়, প্রয়োজন দেখা দেয় নতুন ঘাটের। ঘাট স্থাপন হয় গাইবান্ধার সাঘাটা থানার হলদি ইউনিয়নে। চলে প্রায় আরও ৩০বছর।

১৯৮২-১৯৮৩ সালের দিকে ওইঘাটও নদী গ্রাস করে, স্থাপিত হয় তিস্তামূখঘাট-ফুলছড়ি টু বাহাদুরারাদঘাট। ত্রিশের দশকের পুরাতন ফুলছড়ি ঘাটটি ব্রিটিশ শাসনামলে ব্রিটিশরাও তাদের বিভিন্ন পণ্য আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহার করতেন। নদী ভাঙতে থাকে পুরাতন নিয়মেই; যমুনা নদীর নাব্যতা সঙ্কটের কারণে ফেরি সেবাটি তিস্তামুখ ঘাট থেকে বালাসীঘাটে স্থানান্তর করা হয় ১৯৯০ সালে। এবার ঘাট স্থাপিত হয় গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামের বালাসীতে। এই ঘাটই প্রতিষ্ঠালগ্নে রেলওয়ের লোড-আনলোড স্টেশন হিসেবেও ব্যবহার হতো। যে বন্দরের মাধ্যমে পরিবহন হতো দেশ -বিদেশের পণ্য সামগ্রী।

২০১২ সালের দিকে বালাসীঘাটটি প্রায় ২০০শ কোটি টাকা সরকারি ব্যয়ে নির্মিত হলেও যা এখন অচল, অর্থব, অব্যবহৃত শুধুই সৌন্দর্যে প্রতিক। বর্তমান অতীব দর্শনীয় এই ঘাটের সৌন্দর্যের আড়ালে লাখো মানুষের যে দুঃখগাঁথা তা নিশ্চিহৃ হবার নয়, যা একসময় ইতিহাস বেত্তাদের কাছে অমর জীবন আলেখ্য হয়ে স্থান পাবে এটাই নিশ্চিত। মানচিত্রে গাইবান্ধা জেলার ৭টি উপজেলার মধ্যে অন্যতম একটি উপজেলা। উপজেলাটির মোট আয়তন ৭৭ হাজার ৬শ একর বা ৩১৪ বর্গকিলোমিটার।

২০২৩ সালের হিসেব অনুযায়ী লোক সংখ্যা ১ লাখ ৬৫ হাজার ৩৩৪ জন। এর মধ্যে মহিলা ৮২ হাজার ৮১১ জন, পুরুষ ৮২ হাজার ৫২৩ জন। ৭১'র মুক্তিযুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধারা ফুলছড়ি থানায় আক্রমন করে অস্ত্রসস্ত্র গোলাবারুদ হস্তগত করে পাকবাহিনীরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নতুনমাত্রা যোগ করে। ৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ফুলছড়ি উপজেলার ইউনিয়নগুলো হচ্ছে, কঞ্চিপাড়া, উড়িয়া, উদাখালি, গজারিয়া, ফুলছড়ি, এরেন্ডাবাড়ি ও ফজলুপুর। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বন্যায় প্রতিবছর নদীবাহিত এই উপজেলার প্রায় সর্বত্র সৃষ্টি হয় অসংখ্য চর। আজ থেকে প্রায় ১১০ বছর আগের ঘটনা, ১৯১৪ সাল। প্রবল বন্যা এবং ভাঙ্গনের ফলে গাইবান্ধা থানা বিভক্ত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ফুলছড়ি থানা। ওই সময় ফুলছড়ি ঘাটে ভিড়তো বড়বড় লঞ্চ, স্টিমার, পানির জাহাজ। ঘাটের ইতি-ঐতিহ্য যাই হোক না কেনো?' সকাল বেলা রাজারে তুই, ফকির সন্ধা বেলা!' গানের এই বাক্য বানের গভীরতা কত! তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে তার ঢেউ ঘাটের এপার ওপারের হাজারো জন-মানুষের জীবন যাত্রার করুনরসে পরিপূর্ণ এক মহাকাব্য।

২০২৫ সালের ৭ ফ্রেবুয়ারি- শুক্রবার, পঞ্চগড় জেলার লীড শিশু-কিশোর সংগঠন 'ষড়ঋতু জগদল' এর শিক্ষাসফর উপলক্ষে যাওয়া হয়েছিল ফুলছড়ির বালাসী ঘাটে।যতদূর চোখ যায়, ধু ধু বালুচর, শীত মৌসুমে ঝাঁকে ঝাঁকে চরে নেমে আসে অতিথি পাখি, চকোয়া, রাজহাঁস, বালিহাঁস। নদীর স্রোতাধারায় হালকা আকাশি পানির রং, খটখট আওয়াজে চলছে একের পর এক ট্রলার।যাত্রীরা দূরের কোন গাঁও গেরামের নয়। নদীর এপার-ওপারের জনমানুষ, প্রতিবছর নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনের ফলে এরা নদীর এপার-ওপারের অধিবাসী হয়েছেন। কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামটি এখন দুইভাগে বিভক্ত। নদীর পূর্বাঞ্চলে, 'পূর্ব-রসুলপুর, 'পশ্চিমাঞ্চলে 'পশ্চিম-রসুলপুর।'

পূর্বপাড়ের মানুষজন জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন ভোর বিহানে পশ্চিমপাড়ে চলে আসে; দিনমান শেষে পড়ন্ত বিকাল কিংবা সন্ধায় ঘরে ফেরা। এটাই এই অঞ্চলের কর্মজীবি শত মানুষের দৈনিন্দন নির্ঘন্ট। ঘাটেরপাড়ে কথা হয়েছে, আবুল হোসেন (৬৫) নামের একব্যক্তির সাথে, তিনি বললেন, 'নদীর ভাঙনে রসুলপুর গ্রামটি বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একই পরিবারের কেউ এই পাড়ে, কেউ আবার ওইপাড়ে বসবাস করছে। এটাই আমাদের জীবন।'

বালাসীঘাটের হোটেল ব্যবসায়ী মমিনের প্রতিদিনের বেচাকেনায় সংসার ভালই চলে, কিন্তু নদীর অব্যাহত ভাঙনের সাথে তাদের কর্মজীবনের ভাঙ্গা-গড়া খুবই কঠিন, এমনটি উঠে এসেছে তাঁর সাথে আলাপচারিতায়। পান ব্যাবসায়ী চান মিয়া (৭৫) জানালেন, "বারবার নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে সবকিছুই হারিয়েছি, পান ব্যবসা করেই সংসার চালাই, বর্তমানে ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ।"

নদীর পূর্বপাড়ের পূর্ব রসুলপুরে কথা হয়েছে ক্ষণস্থায়ী মধ্যবয়সী চা দোকানদারের সাথে, তার কথা, "নদীর পাড়ের মানুষের সুখের কথা নেই, আছে দুঃখের কথা, আছে বেদনার কথা। সরকার আসে, সরসার যায়, আমাদের কথা কেউ জানতেও চায় না, শোনতেও চায় না।"

লেখক: নাট্যকার ও গবেষক।