স্পোর্টস ডেস্ক : আফগানিস্তানের ক্ষমতায় তালেবানরা আসার পর থেকেই বন্ধ হয়ে যায় নারীদের খেলাধুলা। বিশেষ করে নারী ক্রিকেট দল না থাকার কারণে আফগানিস্তানের সঙ্গে সিরিজ বাতিল করেছে অস্ট্রেলিয়া। ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলকে আফগানিস্তানের সঙ্গে না খেলার আহ্বান জানিয়েছিলো সে দেশের সরকার। যদিও ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড সেই আহ্বান গ্রাহ্য করেনি।

এবার আফগানিস্তানের সদস্যপদ স্থগিত করার জন্য আইসিসির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সে সঙ্গে তালেবান পরিচালিত জাতিটির আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ইভেন্টে অংশ নেয়া নিষিদ্ধের আহ্বানও জানিয়েছে তারা।

আইসিসির চেয়ারম্যান জয় শাহ বরাবর গত ৩ ফেব্রুয়ারি ই-মেইলের মাধ্যমে এই অনুরোধ পাঠায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এ মেইলের বিষয়টি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় ৭ মার্চ। মেইলের সাবজেক্ট লাইন ছিল: ‘আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডকে বহিষ্কার করা এবং মানবাধিকার নীতি বাস্তবায়ন করা।’

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ই-মেইলে পাঠানো চিঠিতে নিজেদের পরিচয় সম্পর্কে তুলে ধরেছে- তারা একটি স্বাধীন, আন্তর্জাতিক, বেসরকারি (এনজিও) সংস্থা, যারা বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রীয় এবং অ-রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যাক্তি বা সংস্থা দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের উপর গবেষণা এবং অ্যাডভোকেসি পরিচালনা করে।’

ই-মেইলে আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডকে নিষিদ্ধ করার দাবি তুলে তারা লিখেছে, ‘আমরা এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) কাছে আবেদন জানাচ্ছি যে, তালেবান-শাসিত আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডকে আইসিসির সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশগ্রহণ থেকে নিষিদ্ধ করা হোক, যতক্ষণ না নারী ও মেয়েরা দেশটিতে আবার শিক্ষা ও খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে পারে।’

জাতিসংঘের মানবাধিকার নীতি বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে আইসিসিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ লিখেছে, ‘একই সঙ্গে আমরা আইসিসির কাছে আহ্বান জানাই, জাতিসংঘের ব্যবসা ও মানবাধিকার বিষয়ক নির্দেশিকা নীতিমালার উপর ভিত্তি করে প্রণীত মানবাধিকার নীতি বাস্তবায়নের।’

নারী ক্রিকেটের সম্প্রসারনের লক্ষ্যে আইসিসি চেয়ারম্যান জয় শাহ’এর পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ লিখেছে, ‘আমরা লক্ষ্য করছি যে, আপনি বিশ্ব ক্রিকেটের (আইসিসি) নেতৃত্বে থাকাকালীন নারী ক্রিকেট ডেভেলপমেন্টে আরও অর্থ বরাদ্দে’র প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং নারী ক্রিকেটে আরও সম্পদ এবং মনোযোগ বরাদ্দ করে আইসিসির লক্ষ্যকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’

তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পর নারীদের খেলাধুলা কিভাবে বন্ধ করে দিয়েছে, সেটা উল্লেখ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ লিখেছে, ‘২০২১ সালের আগস্টে ক্ষমতা দখলের পর থেকে তালেবানরা দীর্ঘ এবং ক্রমবর্ধমান সংখ্যক নিয়ম ও নীতিমালা আরোপ করেছে যা নারী ও মেয়েদের তাদের মৌলিক অধিকার প্রয়োগে বাধা দিচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং চলাচলের স্বাধীনতা, বিভিন্ন ধরণের কর্মসংস্থান এবং ষষ্ঠ শ্রেণীর পরে শিক্ষা গ্রহণে। এগুলি তাদের জীবন, জীবিকা, আশ্রয়, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য এবং পানিসহ কার্যত সমস্ত অধিকারকে প্রভাবিত করেছে।’

ই-মেইলে আরও বলা হয়েছে যে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য যে আইসিসির যে বৈষম্য বিরোধী নীতি রয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে যে এটি নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, যেখানেই ক্রিকেট খেলা হোক না কেন, নিজ নিজ অবস্থান নির্বিশেষে সকল অংশগ্রহণকারী এটি উপভোগ করতে পারবেন। এটি উল্লেখ করা হয়েছে যে, নীতিটি নিশ্চিত করার চেষ্টা করে যে সমস্ত অংশগ্রহণকারীরা - অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে - লিঙ্গ, বৈবাহিক অবস্থা অথবা মাতৃত্ব- যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন, কোনো ভয়ঙ্কর আচরণের শিকার না হয়েও খেলা উপভোগ করতে পারবে।’

ই-মেইলটিতে আরও যুক্তি তুলে ধরে বলা হয়েছে যে, ২০২১ সালে আফগানিস্তানের নারী (ক্রিকেট) দলকে অর্থ প্রদান স্থগিত করা হলেও, দেশটির পুরুষ (ক্রিকেট) দল আর্থিক ও লজিস্টিক সহায়তা পেয়ে যাচ্ছে, যা স্পষ্টতই আইসিসির নিজস্ব বৈষম্য বিরোধী নিয়ম লঙ্ঘন করে।

আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড নারীদের ক্রিকেট খেলতে না দিয়ে নীতি মানছে না বলে দাবি করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াট। তারা ই-মেইলে লিখেছে, ‘নারী ও মেয়েদের ক্রিকেট খেলতে না দিয়ে এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য নারী ও মেয়েদের জাতীয় দলকে অনুমতি না দিয়ে আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড এই (আইসিসির) বৈষম্য বিরোধী নীতি মেনে চলতে ব্যর্থ হচ্ছে।’

এরপর অলিম্পিক সনদের কথা তুলে ধরে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ লিখেছে, ‘আমরা লক্ষ্য করছি, ২০২৮ সালের লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক গেমসে ক্রিকেটকে একটি ডিসিপ্লিন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবুও তালেবানরা এই খেলায় নারী ও মেয়েদের অংশগ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। যা অলিম্পিক সনদের ‘খেলাধুলা অংশগ্রহণ একটি মানবাধিকার' গ্যারান্টির গুরুতর লঙ্ঘন।’

২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পর থেকে নারীদেরকে খেলাধুলাসহ নানা ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করতে বাধা দেয়া হচ্ছে। ওই ঘটনার কিছুদিন আগে, আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (এসিবি) ২৫ জন নারী খেলোয়াড়ের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে সম্মত হয়েছিল, যাদের বেশিরভাগই এখন অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন।

গত বছরের জুলাই মাসে, আফগানিস্তান জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের সাবেক সদস্য, যারা দেশটির তালেবান শাসকদের দ্বারা স্বীকৃত নয়, তারা আইসিসির কাছে একটি শরণার্থী দল হিসেবে স্বীকৃতি চেয়ে চিঠি লিখেছিলো।

গত জানুয়ারিতে মেলবোর্নের জংশন ওভালে ক্রিকেট উইদাউট বর্ডার্স একাদশের বিপক্ষে একটি প্রদর্শনী ম্যাচে আফগানিস্তান নারী ক্রিকেট একাদশে সেই ক্রিকেটারদের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় একত্রিত হয়েছিল।

এসব পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানের পুরুষ ক্রিকেট দলকে নিষিদ্ধ করা বা বয়কট করার বিষয়টি জটিল। কারণ পূর্বে চুক্তিবদ্ধ আফগানিস্তানের কিছু নারী ক্রিকেটার ইএসপিএনক্রিকইনফোর পাওয়ারপ্লে পডকাস্টে বলেছেন, তারা তাদের পুরুষ ক্রিকেট দলকে খেলতে বাধা দিতে চান না। কারণ তারা (পুরুষ ক্রিকেট দল) আশার আলো দেখান। তবে এসব নারী ক্রিকেটাররা চান যে, পুরুষ ক্রিকেটাররা সেই নারী এবং মেয়েদের জন্য আরও কিছু করুক যারা একই অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আইসিসির কাছ থেকে বেশ কয়েকটি প্রশ্নের জবাব চেয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে মানবাধিকার নীতি তৈরির বিষয়ে গভর্নিং বডি কী পদক্ষেপ নিচ্ছে? নারী ও মেয়েদের শিক্ষা ও খেলাধুলায় প্রবেশাধিকার না পাওয়া পর্যন্ত কেন তারা এসিবিকে (আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড) আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা থেকে নিষিদ্ধ করেনি। একই সঙ্গে জানতে চাওয়া হয়, আইসিসি কী নির্বাসিত আফগানিস্তানের নারী জাতীয় দলকে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত থাকবে? যাতে তারা প্রশিক্ষণ, প্রতিদ্বন্দ্বীতা এবং আইসিসির কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পেতে পারে!

আইসিসির কাছে আরও জানতে চাওয়া হয়েছে যে, ‘আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডকে নারী ও মেয়ে খেলোয়াড়দের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য চাপ দিতে আইসিসি কী পদক্ষেপ নিয়েছে বা নেওয়ার পরিকল্পনা করছে? সে সঙ্গে কী আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডকে আর্থিক বা অন্যান্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে বা হবে?’

সর্বশেষ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ থেকে আইসিসিকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে এই বলে যে, ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) উচিত আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটিসহ অন্য সব আন্তর্জাতিক ক্রীড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থার পদক্ষেপ অনুসরণ করে তালেবানদের প্রতি আফগান নারী ও মেয়েদের খেলাধুলায় অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানানো এবং মানবাধিকার কাঠামোর প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া।’

এ নিয়ে আইসিসি এখনও তাদের কোনো মন্তব্য প্রকাশ করেনি।

(ওএস/এএস/মার্চ ১১, ২০২৫)