ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


শুরু হয়েছে পবিত্র মাহে রমজান। সিয়াম সাধনার মাস। এ মাসে আল্লাহ তায়ালা সুস্থ ও সচল মানুষের উপর রোজাকে ফরজ করেছে। তবে অনেকেই বিভিন্ন রোগের কারণে রোজা রাখবেন কি রাখবেন না। এটা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো কিডনি রোগ।

বর্তমান বিশ্বে অসংক্রামক ব্যাধিগুলোর মধ্যে কিডনি রোগ অন্যতম। সারা বিশ্বে বেড়েই চলেছে কিডনি রোগীর সংখ্যা। পুরুষের তুলনা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে নারী। বাংলাদেশে দিন দিন কিডনি রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। একজন কিডনি রোগী তার শরীরের দু’টি কিডনিই যখন ৬০ থেকে ৭০ ভাগ বিকল হয়ে পড়ে তখনই তিনি এ রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন।

কিডনির বিভিন্ন ধরনের রোগ আছে। যাদের কিডনি রোগ থাকা সত্ত্বেও কিডনি ফাংশন ভালো আছে, তাদের রোজা রাখতে বাধা নেই। স্বাভাবিক নিয়মেই রোজা রাখতে পারবেন। কিডনির বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে আছে শরীরের বর্জ্য বা টক্সিন নির্গত করা, শরীরে পানি/তরল ও লবণ/ইলেকট্রলাইটে ভারসাম্য বজায় রাখা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা ইত্যাদি। কিডনি রোগীদের রোজা রাখা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান উদ্বেগের বিষয় হলো ডিহাইড্রেশন এবং রেনাল হাইপোপারফিউশন, যার ফলে কিডনি ফাংশনের অবনতি হতে পারে।

যাদের দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ, তাদের বেশির ভাগেরই মূল কারণ থাকে ডায়াবেটিস। এ ছাড়া উচ্চরক্তচাপ এবং কিডনির প্রদাহও দায়ী। কিডনি রোগে আক্রান্ত সব রোগীই রোজা রাখলে পানিশূন্যতা ও উচ্চরক্তচাপ এবং ইলেকট্রলাইট ভারসাম্যহীনতার ঝুঁকি থাকে। এ ছাড়া ডায়াবেটিস রোগীদের হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়ে রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।

এগুলো যেমন কিডনির কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়, অনেক সময় AKI on CKD বা আকস্মিকভাবে কিডনি বিকলের কারণ হতে পারে। এ ছাড়া এই বিষয়গুলো সাধারণ স্বাস্থ্যের জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে।

কিডনি প্রতিস্থাপন করা রোগীদের আজীবন ওষুধ এবং নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ডিহাইড্রেশন ও হাইপোপারফিউশনের জন্য কিডনি ফাংশনের অবনতি হতে পারে। ১২ ঘণ্টার বেশি রোজা হলে সাধারণত এই রোগীদের ট্যাক্রলিমাসের ডোজ এবং ফর্মুলেশনে পরিবর্তন করা হয় এবং এমএমএফ ওষুধ পেয়ে থাকলেও সেটা পরিবর্তন করে দেয়া হয়। বেশির ভাগ গবেষণায় রমজান মাসে রোজা রাখার জন্য উল্লেখযোগ্য পার্থক্য পাওয়া যায়নি।তবে মাঝারি থেকে গুরুতর কিডনি ফাংশন খারাপ হলে রোজা রাখার পরামর্শ দেয়া হয় না।

রমজানে কিডনি রোগীদের খাদ্যাভাস কেমন হবে?

যারা দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগী, যাদের কিডনি বিকল হয়ে পঞ্চম ধাপে আছেন, যাদের নিয়মিত ডায়ালিসিস করতে হচ্ছে, যাদের মূত্রতন্ত্রের প্রদাহের চিকিৎসা চলছে, আকস্মিক কিডনি বিকল রোগীদের মধ্যে যারা কিডনির কোনো জরুরি অপারেশন করাতে হচ্ছে তাদের জন্য রোজা রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগীদের যদি রক্তের উপাদানে কোনো জটিলতা দেখা দেয়, যাদের ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত, তাদের এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে রোজা রাখতে হবে।

রোজায় একজন কিডনি রোগী কি খাবেন

সাধারণত ক্রিয়েটিনিন বেশি থাকলে কিডনি রোগীদের ডাল ও ডালের তৈরি খাবার খেতে নিষেধ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজু, বেসনের তৈরি বেগুনি, হালিম, ঘুগনি ইত্যাদি। সুতরাং কিডনি রোগীদের এ সমস্ত খাবার খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। এর বদলে চালের গুড়ো দিয়ে তৈরি খাবার খেতে পারেন। সবজির পাকোড়া ময়দা দিয়ে বানিয়ে খেতে পারেন। আলুর চপ ডিমের সাদা অংশ দিয়ে ভেজে খেতে পারেন।

এছাড়াও বাইরের কৃত্রিম রং দেয়া খাবার, টেস্টিং সল্ট দেয়া খাবার না খাওয়াই ভাল। কিডনি রোগীদের শরীরে পটাশিয়ামের মাত্রার উপর নির্ভর করে তারা কোন্ ধরনের ফল খাবেন, নাকি একদমই খাবেন না।

তবে আপেল, বিচি ছাড়া পেয়ারা, নাসপাতি, পাকা পেঁপে, আনারস,খেতে পারবেন পরিমাণ মতো। তা দিয়ে জুস বা ডেজার্ট করে খেতে পারবেন।

ভাত, রুটি, মাছ, মুরগির মাংস, দুধ ইত্যাদি কিডনির অবস্থার উপর নির্ভর করে পরিমাণ মতো খেতে পারবেন। তবে একসাথে একাধিক প্রোটিন না খাওয়াই ভালো। যেমন- মাছ খেলে মাংস বা ডিম খাবেন না সেই বেলা।

যাদের রক্তে পটাশিয়াম বেশি তারা শাকসবজি পটাশিয়ামমুক্ত করে পানিতে ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রেখে খাবেন ও ফল সীমিত পরিমাণ খাবেন।

আপনার ডাক্তারের পরামর্শে রক্তের উপাদান মাঝে মাঝে পরীক্ষা করিয়ে নেবেন। সেহরির সময় ভাত-রুটি, মাছ-মাংস, ডিম, দুধ পরিমিত খাবেন। ইফতারের সময় খাবেন খেজুর, চিড়া, দই, ডিমের পুডিং, সুজি, সেমাই, পায়েস, সাগুদানা ভালো হবে।

সেই সঙ্গে আলগা লবণ ও লবন জাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে এবং প্রোটিন জাতীয় খাবার বিশেষ করে গরু-খাসির মাংস কম খেতে হবে। ১৫ দিন পর পর ১ দিন খাওয়া ভালো তবে মুরগী, মাছ রোজ পরিমাণ মতো খেতে পারবেন।

কোন ধরনের সবজি ও শাক দিয়ে মেনু তৈরি করবেন আসুন জেনে নেই

শাক: লালশাক, ডাঁটাশাক, কলমিশাক, মিষ্টি কুমড়া শাক, লাউশাক, সরিষা শাক, ও কচুশাক খেতে পারবেন।

সবজি: ডাঁটা, পটোল, করলা, ঝিঙ্গা, কাঁকরোল, লাউ, শসা, বেগুন, চাল কুমড়া, বিচি ছাড়া শিম, ধুনদুল, বেগুন, গাজর, চিচিঙ্গা,ঝিঙ্গা, চালকুমড়া ও আলু পরিমানে কম খেতে পারবে।

ফল: আপেল, পাকা পেঁপে, পাকা পেয়ারা, আনারস, নাসপাতি, জামরুল, পাকা কাঁঠাল, কাঁচা আম ও পাকা বেল।

অন্যান্য: চাল, আটা, ময়দা, মুড়ি, চিড়া, মুগ ডাল (অল্প পরিমাণ), সেমাই, সুজি, বার্লি, কর্নফ্লেক্স, ভুট্টা, কর্নফ্লাওয়ার ইত্যাদি।

মনে রাখতে হবে, এখন প্রচণ্ড গরমের সময়। খোলা খাবার, রাস্তার পাশে বিভিন্ন রঙবেরঙের শরবত সহজেই জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে। এগুলো খেয়ে ডায়রিয়া, বমিতে আক্রান্ত হয়ে অনেক রোগীর আকস্মিক কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে। এজন্য এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। বাড়ির সবার সাথে ইফতার করলেও কিডনি রোগীর ডায়েট প্লানটা হবে আলাদা সেই অনুযায়ী সঠিক খাদ্য পরিমাণ মতো খেলেই রোযা রাখতে কোন অসুবিধা হবে না।

ওষুধ সেবনের নিয়ম : সকালের ওষুধ সাহরিতে এবং রাতের ওষুধ ইফতারে খাওয়া যাবে। সকালে বা সাহরিতে ওষুধ কম রাখা ভালো; যদি সম্ভব হয়।

পরিশেষে বলতে চাই, মহান আল্লাহ রোজা রাখার বিধান দিয়েছেন তার বান্দাদের কল্যাণের জন্য। সারাদিন না খেয়ে থাকার নামই রোজা নয়। আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, “নিশ্চয়ই নিয়মানুবর্তিতার সহিত তোমাদের উপর রোজাকে ফরজ করা হয়েছে।” সুতরাং নিয়ম শৃঙ্খলার সহিত রোজা পালনই এর মূল ভিত্তি। তথাপি বর্তমানে নিয়ম মানার পরেও অনেকেই কিডনি সহ বিভিন্ন ধরনের রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছেন, অনেকেই আবার রোগ নিয়ে কিভাবে রোজা রাখবেন সেই চিন্তায় আছেন।এর সমাধানের জন্য প্রয়োজন শারীরিক, মানসিক ও খাদ্যের সচেতনতা। এসব সচেতনতার পাশাপাশি বিভিন্ন সমস্যার জন্য হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে অনেক সমস্যারই সমাধান সুন্দরভাবে করা সম্ভব। কারণ মনে রাখতে হবে সুস্থতাই জীবন। শৃঙ্খল জীবনযাপনই সুস্থতার মুলভিত্তি। আর শৃঙ্খলার জন্যই রোজা এবং রোজাই আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্যতম মাধ্যম।আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে সুস্থ অবস্থায় রোজা রাখার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক : চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।