মীর আব্দুল আলীম


‘কসাই আর ডাক্তার দুটোই আজ প্রফেসন।’ নচিকেতার গানের এই লাইন শুনলেই চিকিৎসক সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। একদল বলবে, "এটা আমাদের পেশার প্রতি অবমাননা!" আরেকদল কেবল মুচকি হেসে বলবে, "সত্য কথায় নাকি নিন্দুক বেশি কষ্ট পায়!" কিন্তু গানের কথাটা কেন এত জনপ্রিয় হলো? নচিকেতা ডাক্তারদের সঙ্গে কসাইদের তুলনা করলেন কেন?

আমরা তো জানি, চিকিৎসা একটি মহৎ পেশা। চিকিৎসকরা মানবতার সেবক। তারা রোগীকে সুস্থ করার জন্য কাজ করেন, রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। এই পেশাটি এত সম্মানজনক যে, একজন চিকিৎসক যখন স্টেথোস্কোপ গলায় ঝুলিয়ে চলেন, তখন মানুষ তার প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা পোষণ করে। কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই বিশ্বাস কি টিকে আছে? নাকি কিছু চিকিৎসকের কারণে পুরো চিকিৎসক সমাজ আজ প্রশ্নবিদ্ধ?

ডাক্তার না ব্যবসায়ী?

একসময় বলা হতো, শিক্ষক ও ডাক্তার—এই দুই পেশা সবচেয়ে বেশি সম্মানের। কিন্তু বর্তমান সময়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে—ডাক্তার কি সত্যিই সেবক, নাকি ব্যবসায়ী?

চেম্বারে ঢুকতে গেলেই প্রথম ধাক্কা—ফি জমা দিতে হবে। সাধারণ মানুষ ভাবে, টাকা দিলেই ডাক্তার সময় নিয়ে কথা বলবে, রোগের খোঁজ নেবে, সবকিছু বুঝিয়ে বলবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে ‘পরের রোগী ঢোকান’ বলে ডাক পড়ে। রোগী কী বুঝলো, কী জানলো—সেসব দেখার যেন সময় নেই।

তারপর সেই ব্যবস্থাপত্র দেখলে বোঝা যায়, ডাক্তার শুধু রোগীর জন্য নয়, কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ কোম্পানির জন্যও কাজ করেন! ওষুধের নাম শুনলেই বোঝা যায়, এসব ওষুধ ওই কোম্পানির ছাড়া আর কেউ দেবে না। সঙ্গে যুক্ত হয় অতিরিক্ত ডায়াগনস্টিক টেস্ট। "আপনার এই পরীক্ষা করানো দরকার, না হলে রোগ ধরা পড়বে না।" এসব পরীক্ষা করানোর জন্য নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানও থাকে, যেখানে ডাক্তারদের কমিশন ঠিক করা থাকে!

প্রশ্ন হলো, ডাক্তার যখন কমিশনের চিন্তা করেন, তখন কি তিনি রোগীর কথা ভাবেন? নাকি তার মূল লক্ষ্য হয়ে যায় ব্যবসা? চিকিৎসা কি তখন পণ্য হয়ে যায় না?

জীবন রক্ষাকারী না জীবন হন্তারক: ডাক্তারদের শপথ কী বলে? "রোগীর সেবাই আমার প্রধান দায়িত্ব।" কিন্তু আজকের বাস্তবতা কী বলে? অনেক চিকিৎসক নিজের সুবিধার জন্য ভুল ওষুধ লিখে দেন, অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার করেন, ভুল চিকিৎসায় রোগীর জীবন নিয়ে খেলা করেন। এসব ঘটনা প্রায়ই গণমাধ্যমে উঠে আসে। অপারেশন থিয়েটারে রোগীর পেটে কাঁচি রেখে সেলাই করা, ভুল ইনজেকশন দিয়ে মৃত্যু, সঠিক চিকিৎসার অভাবে রোগীর অবস্থা খারাপ হওয়া—এসব ঘটনা কি আমাদের দেখা হয় না?

অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তারের অবহেলার কারণে রোগী মারা যায়, কিন্তু তাদের জবাবদিহিতা নেই। রোগীর স্বজনরা চিৎকার করলেও, হাসপাতাল বা চিকিৎসকগণ দোষ স্বীকার করতে চান না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীর পরিবার ন্যায়বিচার চাইলেও, শক্তিশালী চিকিৎসক লবি তাদের দাবিয়ে ফেলে। প্রশ্ন হলো, রোগীর জীবন কি এতই মূল্যহীন?

রাজনীতির মঞ্চে চিকিৎসক: আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো চিকিৎসকদের রাজনৈতিক আচরণ। আগে চিকিৎসক মানেই ছিলেন সমাজের শিক্ষিত, সৎ ও দায়িত্বশীল নাগরিক। কিন্তু এখন চিকিৎসা পেশায় রাজনীতির প্রবেশ ঘটেছে ভয়ানকভাবে।

একজন ডাক্তার হয়ে উঠছেন হাসপাতালের বড় পদ দখলের লড়াইয়ে ব্যস্ত। সিন্ডিকেট তৈরি করে নিজেদের মানুষ বসানো হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। সরকারি হাসপাতালে ভালো পজিশন পেতে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগ দেওয়া, বিভিন্ন নেতার আশীর্বাদ নেওয়া—এগুলো যেন সাধারণ চিত্র হয়ে উঠেছে।

ফলে চিকিৎসক সমাজের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বাড়ছে। কে ভালো ডাক্তার, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়—কে কোন দলের লোক, সেটাই মূল বিচার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ, যারা মনে করেন ডাক্তাররা তাদের জন্য কাজ করবে, অথচ তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যস্ত।

সমাধান কী?

সব চিকিৎসক একরকম নন। অনেক ডাক্তার এখনো সৎ, নিষ্ঠাবান, মানবিক। তারা দিনরাত রোগীদের সেবা করেন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, খারাপদের সংখ্যাই দিন দিন বাড়ছে। আর তারাই পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছেন।

চিকিৎসা সেবা যদি সত্যিকার অর্থে সেবা হয়ে থাকে, তাহলে সেটিকে ব্যবসায় পরিণত করা চলবে না। চিকিৎসকদের নিজেদের অবস্থান বোঝা দরকার—তারা ব্যবসায়ী নন, তারা মানুষের জীবন বাঁচানোর দায়িত্বে আছেন। তাদের নৈতিক মূল্যবোধ বজায় রাখা দরকার, যাতে সাধারণ মানুষ আবারও আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে।

নচিকেতার গান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—চিকিৎসা কি সত্যিই মহৎ পেশা হিসেবে আছে, নাকি এটি আজ কসাইখানায় পরিণত হয়েছে?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে চিকিৎসক সমাজকেই। অন্যথায়, সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ফিরে আসবে না।

লেখক : সাংবাদিক ও সমাজ গবেষক।