মীর আব্দুল আলীম


রমজান এলেই আমাদের দেশের বাজারে এক অভিনব প্রতিযোগিতা শুরু হয় "কে কাকে কতটা কষ্ট দিতে পারে; কিভাবে বাড়তি মুনাফা করতে পারে!" বিশ্বের অনেক দেশে এসময় পণ্যের দাম কমানো হয়, কিন্তু আমাদের দেশে ব্যবসায়ীরা মনে করেন, "রমজান আসছে মানেই আকাশের দিকে তাকানোর সময়, পণ্য মূল্য বাড়িয়ে দেওয়ার সময়!" কারণ, তারা দামের গতি দেখিয়ে যেন রকেট বিজ্ঞানীদেরও হার মানিয়ে দেন।

প্রতি বছর রমজানের শুরুতে আমরা একটি চমৎকার দৃশ্য দেখি- ব্যবসায়ীরা একযোগে দাম বাড়ানোর জন্য প্রতিযোগিতায় নামেন। কেউ বলেন, "বৈশ্বিক সংকট", কেউ বলেন, "সরবরাহ ঘাটতি", আবার কেউ বলেন, "বৃষ্টি বেশি হচ্ছে, তাই দাম বাড়বে!" এসব শুনে মনে হয়, বাজারে নয়, আমরা যেন রহস্যময় কোনো জাদুঘরে ঢুকে গেছি।

তবে হতাশার মধ্যেও কিছু আশার খবর আছে। যেমন, রাজধানী ঢাকার পাশে রূপগঞ্জের আল-রাফি হাসপাতাল লিমিটেড রমজান মাসজুড়ে চিকিৎসা সেবার ব্যয় কমিয়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, তারা রোজাদারদের কথা মাথায় রেখে বিশেষ ছাড় দিচ্ছে, যা প্রশংসার দাবিদার। এমন উদ্যোগ অন্যান্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গ্রহণ করলে হয়তো রমজানে সাধারণ মানুষের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হতো। যখন বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত মুনাফার জন্য রমজানকে "বোনাস মৌসুম" বানিয়েছে, তখন তারা রোগীদের জন্য বিশেষ ছাড় দিয়েছে এমন সংবাদ পত্রিকায় পেয়েছে। এ ধরনের উদ্যোগ আরও প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যবসায়ীরা নিলে হয়তো সাধারণ মানুষ একটু স্বস্তি পেতো।

আমরা বরাবরই দেখি রমজানের আগে বাজারে পণ্য ভরপুর থাকে, কিন্তু রমজান শুরু হলে হঠাৎ করে সব উধাও হয়ে যায়। যেন তেল, পেঁয়াজ, চিনি আর ডালেরাও সংযম পালনের জন্য হিজরত করে। তবে এবার পিয়াজ আলুর দাম বেশ নিয়ন্ত্রণে। এজন্য সরকার ধন্যবাদ পেতে পারে। তবে তেল সংকটের কারনে উচ্চমুল্যে তেল বিক্রি হচ্ছে।

পণ্যের দাম বাড়ার অজুহাতের যেন আর শেষ নাই। এক ব্যবসায়ী একবার বলেছিলেন, "এইবার বেশি বৃষ্টি হওয়ায় ডালের উৎপাদন কম!" শুনে ক্রেতা প্রশ্ন করলেন-" আরে ভাই, ডাল তো ভারতসহ অন্য দেশ থেকে আমদানি হয়?" তিনি ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি দিয়ে বললেন, "আমদানি হলেও তো আবহাওয়া ভালো না!" এভাবেই প্রতিবছর রমজান এলে উত্তপ্ত হয়ে পণ্যের বাজার।

বৈশ্বিক তুলনা; আমরা যা করি

বিশ্বের অনেক দেশ রমজানে জনগণকে স্বস্তি দিতে উদ্যোগ নেয়। সৌদি আরব, দুবাই, কাতার: বাজারে সরকারি ভর্তুকি দেওয়া হয়, সুপারশপগুলোতে রমজান স্পেশাল ডিসকাউন্ট চলে। মিশর, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া: সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। অমুসলীম দেশ গুলো যেমন ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, কানাডা: অমুসলিম দেশ হয়েও অনেক সুপারশপ মুসলিমদের জন্য বিশেষ ছাড় দেয়। আমাদের দেশের সরকারও কিছু কিছু পণ্য ভর্তুকি দিয়ে বিশেষ ব্যবস্থা বিক্রি করছে যা পর্যাপ্ত নয়।

প্রশ্ন হলো, আমরা কেন পারছি না? কেন এই দেশে ব্যবসা মানেই শুধু লাভের প্রতিযোগিতা? ইসলাম আমাদের ন্যায়বিচার, সততা ও মানবিকতার শিক্ষা দেয়। অথচ মুসলিমপ্রধান দেশ বাংলাদেশেই রমজান এলেই মুনাফালোভীদের দৌরাত্ম্য বাড়ে। সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘবের বদলে তাদের দুর্ভোগ আরও তীব্র করা হয়। এই পরিস্থিতি কি আমাদের সামষ্টিক ব্যর্থতা নয়?

সরকারের উচিত বাজার ব্যবস্থাপনায় আরও কঠোর হওয়া এবং সিন্ডিকেট ভাঙতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। পাশাপাশি, ব্যবসায়ীদেরও ভাবতে হবে- শুধু মুনাফা নয়, নৈতিকতার দিকেও নজর দেওয়া জরুরি। রমজান মুনাফার নয়, সংযমের মাস। তাই আসুন, এই পবিত্র মাসের শিক্ষা বাস্তবে প্রয়োগ করি এবং রোজাদারদের দুর্ভোগ লাঘবে সকলে সচেষ্ট হই। আমাদের দেশে রমজান এলেই মুনাফালোভীরা বাজারকে যেন এক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেন। এখানে সরকার ঘোষণা দেয়, "বাজার মনিটরিং করা হবে!" কিন্তু ব্যবসায়ীরা এই ঘোষণার উপহাস করে।

বাংলাদেশে রমজানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে:

১. সিন্ডিকেট ও মজুদদারি: ব্যবসায়ীদের একটি অংশ ইচ্ছাকৃতভাবে পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন, যা মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ।

২. চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম: রমজানে নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়, যেমন ছোলা, তেল, চিনি, দুধ, মাংস ইত্যাদি। সরবরাহ পর্যাপ্ত না থাকলে দাম বাড়ে।

৩. পর্যবেক্ষণ ও শাস্তির অভাব: সরকার মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও শক্তভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। ফলে অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেয়।

৪. আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব: বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা এবং আমদানিকৃত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশেও প্রভাব ফেলে।

৫. পরিবহন খরচ বৃদ্ধি: রমজানকে কেন্দ্র করে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যায়, যা পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

সমাধানের পথ কি

১. সরকারের কঠোর বাজার মনিটরিং: নিয়মিত অভিযান চালিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

২. সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ ও ভর্তুকি প্রদান: মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে পণ্য সংগ্রহ করা উচিত।

৩. বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি: বিকল্প আমদানি উৎস তৈরি করা হলে একচেটিয়া সিন্ডিকেট ভাঙবে।

৪. মানবিক ব্যবসায়িক নীতি প্রচলন: আল-রাফি হাসপাতালের মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও রমজানে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য উৎসাহিত করা উচিত।

সরকার কঠোরভাবে করণীয়: সরকার যদি সত্যিই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তাহলে কয়েকটি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি

১. সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ "রমজান কারাগার" খোলা হোক।

২. নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের গোপন আস্তানাগুলোতে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে তাদের পণ্য উদ্ধার করে ন্যায্য মূল্যের বিক্রির ব্যবস্থা করা হোক।

রমজান শুধুমাত্র ব্যবসার সময় নয়, এটি সংযম, মানবিকতা ও পরোপকারের সময়। ব্যবসায়ীদের বোঝা উচিত, রোজাদারদের কষ্ট দিয়ে করা মুনাফা কখনোই বরকতময় হতে পারে না। কিছু প্রতিষ্ঠান যেমন আল-রাফি হাসপাতাল মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, তেমনি অন্যরাও যদি তাদের পথ অনুসরণ করে, তাহলে হয়তো আমরা সত্যিকার অর্থেই রমজানের শিক্ষাকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পারবো।

রমজান শুধু ব্যবসার সময় নয়, এটি মানবিকতা দেখানোরও সময়। বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সরকার, ব্যবসায়ী এবং নাগরিকদের সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই ভবিষ্যতে রমজানে সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে জীবনযাপন করতে পারবে।

লেখক : সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব, কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।