রূপক মুখার্জি, নড়াইল : বসন্ত কালে মাঠেঘাটে, বনেবাদাড়ে, সড়কের ধারে অনাদরে আর অবহেলায় বেড়ে ওঠা যে ফুলগুলো সহজেই মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নেয়, তার মধ্যে একটি হলো বনজুঁই বা ভাট ফুল। তবে এলাকা ভেদে এটি ‘ভাটি ফুল’ নামেই বেশি পরিচিত। 

পৌরসভাসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, ঝোপ-ঝাড়ে, বনজঙ্গলে, রাস্তার পাশে, এখানে-সেখানে নিজের সুন্দর রূপ ছড়িয়ে সুবাস ছড়িয়ে মানুষকে মুগ্ধ করছে ভাটি ফুল।

স্থানভেদে এটির নাম ভাটি ফুল, ভাটফুল, ঘেটু ফুল, ভাত ফুল, ঘণ্টাকর্ণ থাকলেও লোহাগড়া অঞ্চলে এটি 'ভাটিফুল’ নামেই পরিচিত।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বসন্তের আগমনে পলাশ-শিমুলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাটি ফুল ফোঁটে। এ ফুল ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে ফুটতে দেখা যায়। বিশেষ করে পরিত্যক্ত মাঠঘাট, বনবাদাড়, সড়ক বা রাস্তা কিংবা জলাশয়ের পাশে ভাটি ফুলের ঝোঁপ চোখে পড়ে। ফাল্গুনে মোহনীয় সৌন্দর্যের অপরুপ শোভা ছড়ায় বনজ ফুল ভাটি।

ভাটি গাছের প্রধান কান্ড সোজাভাবে দন্ডায়মান। সাধারণত ২ থেকে ৪ মিটার লম্বা হয় এ ফুলের গাছ। এ গাছের পাতা দেখতে কিছুটা পানপাতার আকৃতির ও খসখসে। ডালের শীর্ষে পুষ্পদন্ডে ফুল ফোঁটে। পাপড়ির রং সাদা এবং এতে বেগুনি রঙের মিশ্রণ আছে। বসন্ত থেকে গ্রীষ্ম অবধি ফুল ফোঁটে। এ ফুলের রয়েছে মিষ্টি সৌরভ। রাতে বেশ সুঘ্রাণ ছড়ায় এ ফুল। ফুল ফোঁটার পর মৌমাছিরা ভাটি ফুলের মধু সংগ্রহ করে থাকে।

ভাঁটি ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম Clerondendron viscosum। ভাটি গুল্মজাতীয় বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। ভাট মিয়ানমার ও ভারতীয় প্রজাতি। ভাটি ফুল একটি ওষুধি উদ্ভিদ। এর পাতা কবিরাজরা অ্যাজমা, টিউমার, সাপের কামড়ের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করেন। এছাড়া গ্রামাঞ্চলের মানুষেরা জ্বর, চর্মরোগ ও বিছার হুল ফোটানোতে এর পাতা, ফল, ফুল ও মূল ভেষজ হিসেবে ব্যবহার করেন।

ফাল্গুন মাসের শুরু থেকেই দেখা মিলছে এই ভাটি ফুলের। এই ফুলকে অনেকে বন জুঁই বা ঘেটু ফুল নামেও চেনে। তবে স্থানীয়রা বলছেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের এবং দ্রুতঃ নগরায়নের ফলে রাস্তাঘাটে, বনবাদাড়ে কিংবা পরিত্যক্ত জমিতে আগের মতো ভাটি ফুল চোখে পড়ে না।

বনজ ভাটি ফুলের অপার সৌন্দর্য আর রুপ লাবণ্যের কারণে বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিতে ভাটি ফুল স্হান করে নিয়েছে।

প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশও পড়েছিলেন ভাটি ফুলের প্রেমে। তাইতো কবি তার ‘বাংলার মুখ’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়/ বাংলার নদী মাঠ ভাঁট ফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়।’

নড়াইলের সিনিয়র সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম তুহিন বলেন, 'একসময় গ্রামগঞ্জে এ ফুল দেখতে পাওয়া যেতো। এখন আর আগের মতো ভাটি ফুল চোখে পড়ে না। অযত্নে আর অবহেলায় প্রাকৃতিকভাবে ভাটি ফুল বেড়ে উঠলেও সৌন্দর্যে কোনো কমতি নেই'।

লোহাগড়া সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এস এম হায়াতুজ্জামান বলেন, 'বসন্তকালে প্রকৃতিগতভাবে বেশ কিছু বুনো ফুল ফোটে, এরমধ্যে ভাটি ফুল অন্যতম। ভাটি ফুলের অপার সৌন্দর্য শুধু মানুষকে আকৃষ্ট করে না, ভাটি ফুল নিয়ে কবি ও লেখকদের সাহিত্য চর্চারও কমতি নেই।’

লক্ষ্মীপাশা সংগীত একাডেমির সভাপতি ও লেখক লিয়াকত বিশ্বাস বলেন, 'ভাটি ফুল সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষের মনের খোরাক জোগায়। রাস্তার পাশে, পরিত্যক্ত জমিতে অনাদর অবহেলায় বেড়ে ওঠা ভাট গাছের ফুল বসন্তে প্রাকৃতিক সৈন্দর্যে যোগ করে বাড়তি মাত্রা। পথচারীরা উপভোগ করেন আবহমান বাংলার আদি বুনো ফুলের অপরূপ সৌন্দর্য।

(আরএম/এসপি/মার্চ ০১, ২০২৫)