ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


শুক্রবার ৮ ফাল্গুন ২১ ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০২৫। একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বের মাতৃভাষার জন্য নির্ভয়ে বুকের রক্ত ঢেলে দেয়ার প্রথম ইতিহাস সৃষ্টির দিন। বাঙালির ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় শোকের দিন। আজ সবার সব পথ এসে মিলে যাবে এক অভিন্ন গন্তব্য—শহীদ মিনারে। হাতে হাতে বসন্তে ফোটা ফুলের স্তবক, কণ্ঠে নিয়ে চির অম্লান সেই গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী/ আমি কি ভুলিতে পারি’ ধীর পায়ে এগিয়ে যাবে আবালবৃদ্ধবনিতা। ভাষাশহীদদের প্রতি নিবেদিত শ্রদ্ধার ফুলে ফুলে ঢেকে যাবে শহীদ মিনারের বেদি।বাঙালি জাতির জীবনে আজ এক গৌরবোজ্জ্বল দিন,আজ থেকে ৭৩ বছর আগে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন উৎসর্গ করার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন বাংলা মায়ের অকুতোভয় সন্তানেরা।আর একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনের অবিস্মরণীয় একটি অধ্যায়। এদিন বাঙালি জাতি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। ১৯৫২ সালের এই দিনেই সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকেই আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। তাঁদের এই আত্মত্যাগ শুধু একটি দেশের ইতিহাসে সীমাবদ্ধ নয়; বরং গোটা বিশ্বে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। এটি বাঙালি জাতির অহংকার ও গৌরবের প্রতীক।

একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস ও পটভূমি

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি গড়ে ওঠে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়, যার দুটি অংশ ছিল—পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)। পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বাংলাভাষী হলেও শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষণা করেন, “উর্দু এবং কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।” এই ঘোষণায় বাঙালি জাতির মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হয় এবং বাংলাভাষার পক্ষে ছাত্রসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম ভিত্তি স্থাপিত হয় ১৯৪৮ সালে, যখন তমদ্দুন মজলিসসহ বিভিন্ন সংগঠন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলে। ক্রমে এই আন্দোলন জোরদার হয় এবং ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বিক্ষোভে নামেন। সেদিন পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকেই শহিদ হন। এই পটভূমির কারণেই ভাষা আন্দোলন কেবল একটি ভাষার অধিকারের সংগ্রাম ছিল না, বরং তা বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় ও স্বাধীনতার আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে।

১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি কি ঘটেছিল?

৫২‘র এইদিনে (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮, বৃহস্পতিবার) মাতৃভাষা বাংলাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকায় আন্দোলনরত বাঙালি ছাত্রদের ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি করে। পুলিশের এই গুলিবর্ষণে কয়েকজন তরুণ ছাত্র শহিদ হন। যাঁদের মধ্যে রফিক, জব্বার, শফিউর, সালাম, বরকত এসব নাম উল্লেখযোগ্য এবং এই কারণে এ দিনটি শহিদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে।

ভাষা আন্দোলনের শহিদগণ

শহিদদের নাম ও আত্মত্যাগ: ভাষার দাবিতে জীবন উৎসর্গ করা শহিদগণ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের গৌরবময় অংশ। তাঁদের নাম চিরদিন অমর হয়ে থাকবে। শহিদদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন:

_ আব্দুস সালাম: ভাষা আন্দোলনে প্রথম শহিদদের মধ্যে একজন।

_ আব্দুল বরকত: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন।

_ রফিক উদ্দিন আহমেদ: তরুণ আন্দোলনকারী, যিনি গুলিতে প্রাণ হারান।

_ আবদুল জব্বার: সাধারণ মানুষ যিনি ভাষার জন্য আত্মত্যাগ করেন।

_ শফিউর রহমানসহ আরও অনেক নাম না-জানা বীর শহিদরা তাদের প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন।

শহিদ মিনার নির্মাণ

শহিদদের স্মরণে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে প্রথম শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার তৈরি হয়, যা আজ বাঙালির গৌরবের প্রতীক।

ভাষা শহিদদের প্রতি জাতির শ্রদ্ধা

শহিদদের স্মরণে নির্মিত হয় শহিদ মিনার। প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি, রাত ১২টা ১ মিনিটে জাতি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। লাখো মানুষ খালি পায়ে শহিদ মিনারে গিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী উদযাপন

২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয়, যা ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শনের একটি অনন্য উদাহরণ। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে ঘোষণা করে, আর ২০০০ সাল থেকে সারা বিশ্বে এই দিনটি পালিত হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের নিজস্ব ভাষার গুরুত্ব তুলে ধরতে এই দিনে আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং শিক্ষামূলক কার্যক্রমের আয়োজন করে। এই দিবসটি ভাষার বৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং সব মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়। ভাষা শহিদদের আত্মত্যাগের দিনটি আজ বিশ্বের সকল মানুষের জন্য নিজস্ব ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও গর্ব করার এক বিশেষ উপলক্ষ হয়ে উঠেছে।

৫২’র ভাষা আন্দোলনের প্রভাব

ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি বুঝতে পারে যে, তাদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে হবে। এই চেতনা পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা এনে দেয়।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনই ৭১’র স্বাধীনতা সংগ্রামের অনুপ্রেরণা

ভাষা আন্দোলন ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম ভিত্তি ও অনুপ্রেরণা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাঙালিদের উপর ভাষার অবিচার চাপিয়ে দেওয়া হয়। শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা করলে বাঙালিরা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকেই আত্মত্যাগ করেন, যা বাঙালি জাতিকে অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ করে। এই আন্দোলনই প্রমাণ করে যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করলে বিজয় আসবেই। পরবর্তী সময়ে ভাষা আন্দোলনের চেতনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালিরা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভাষা আন্দোলন আমাদের শিখিয়েছে নিজের অধিকার ও জাতীয় পরিচয় রক্ষার জন্য কখনও পিছপা হওয়া যাবে না। তাই ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথপ্রদর্শক হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

জাতীয় জীবনে একুশের চেতনা

জাতীয় জীবনে একুশের চেতনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং গৌরবের প্রতীক। একুশের চেতনা আমাদের শিখিয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে এবং অধিকার আদায়ে লড়াই করতে। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছিল, তা বাঙালি জাতির জাতীয় চেতনা গঠনে মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। এই চেতনা স্বাধীনতা সংগ্রামসহ সব জাতীয় সংকটে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে উৎসাহিত করেছে। একুশের চেতনা শুধু মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসাই নয়, বরং তা আমাদের নিজের সংস্কৃতি ও পরিচয় রক্ষার দায়িত্বের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। আজকের যুগে নতুন প্রজন্মকে শুদ্ধ ভাষা চর্চা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনে কাজ করতে হবে। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের উচিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একত্রে কাজ করা। এ চেতনা আমাদের দেশপ্রেম ও মানবতাবোধকে জাগ্রত করে, যা একটি সুশৃঙ্খল ও উন্নত জাতি গঠনের জন্য অপরিহার্য। জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সত্য, ন্যায় ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা একুশের আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে পারি। তাই একুশের চেতনাকে ধারণ করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করতে হবে।

ভাষা ও শহিদ দিবসে আমাদের করণীয়

* শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা।

* একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভার আয়োজন করা।

* শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস প্রচার কয়রা।

* রাষ্ট্রের সর্বস্তরে শুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা ও প্রয়োগ করা।

> একুশের শিক্ষা ও নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব

১. একুশের শিক্ষা আমাদের শিখিয়েছে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।

২. নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব হলো ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জন করা এবং তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া।

৩. একুশের চেতনা ধরে রাখতে শুদ্ধ বাংলা চর্চা করা এবং দৈনন্দিন জীবনে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করা নতুন প্রজন্মের কর্তব্য।

৪. মাতৃভাষার পাশাপাশি অন্য ভাষা শেখার গুরুত্ব বুঝতে হবে, তবে নিজের ভাষার প্রতি ভালোবাসা কখনো হারানো যাবে না।

৫. ভাষা শহিদদের আত্মত্যাগকে সম্মান জানিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং তাদের আদর্শকে অনুসরণ করা উচিত।

৬. নতুন প্রজন্মকে বাংলা সাহিত্য, কবিতা ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী হতে হবে এবং এগুলো বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরতে কাজ করতে হবে।

৭. প্রযুক্তির যুগে বাংলার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে অনলাইন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুদ্ধ ভাষা চর্চা করা জরুরি।

৮. একুশের শিক্ষা হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা এবং অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া।

৯. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পাঠদান এবং সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলা উচিত।

১০. ভাষার জন্য আত্মত্যাগের ইতিহাস থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে নতুন প্রজন্মকে নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয় সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে হবে।

১১. ভাষার বিকৃত ব্যবহার রোধ করা এবং মাতৃভাষার সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ রাখা নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব।

১২. একুশের চেতনাকে বুকে ধারণ করে নতুন প্রজন্মকে মানবতা, ঐক্য ও দেশপ্রেমের আদর্শে উজ্জীবিত হতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, ভাষা আন্দোলনের ৭৩বছর এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে এসেও সর্বক্ষেত্রে-সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলার সম্মানজনক প্রতিষ্ঠা করতে না পারাটা সত্যিই বেদনার।আর বাংলা ভাষার প্রতি, ভাষা শহীদদের প্রতি আমাদের অঙ্গীকারগুলো ক্রমেই যেন দূরে সরে যেতে থাকে। ফিকে হয়ে যায় আমাদের চেতনাগুলো। সবকিছু ভুলে ডুবে যাই নৈমিত্তিক কাজে।

ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক পর্যায়ে ও কর্মক্ষেত্রে দৈনন্দিন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় বাংলা ভাষার প্রতি অনেক ক্ষেত্রে যথাযোগ্য সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা তো প্রকাশ পায়ই না,কখনও কখনও অবজ্ঞার ভাবও ফুটে ওঠে। আধুনিক বা অতি আধুনিক হওয়ার জন্য শহরে বসবাসকারী কারও কারও দ্বারা ইদানীং যে বিষয় ও মূল্যবোধগুলো প্রথমেই আক্রান্ত হয়, বাংলা ভাষা সেগুলোর শীর্ষে।

আমাদের সন্তান-সন্ততি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়বে, অনর্গল ইংরেজি বলতে পারবে, এটা তো আমাদের জন্য আনন্দ ও গর্বের বিষয়। তবে তা অবশ্যই বাংলা ভাষাকে অবমূল্যায়ন করে নয়। অনেক অভিভাবককে অহরহ বলতে শুনি- ‘আমার সন্তান, পোষ্য বা অমুক তো বাংলা জানে না।’ এই ‘জানে না’ বলার মধ্যে একধরনের গর্ববোধ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা থাকে। হ্যাঁ, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ঠিকভাবে বাংলা পড়ানো হয় না বলে অনেকেই ভালোভাবে বাংলা লিখতে ও পড়তে পারে না। কিন্তু ‘বাংলা জানে না’- এটার মধ্যে গর্ব করার কিছু নেই। গালভরে বলারও কোনো বিষয় নয় এটি। এই ‘বাংলা জানে না’ বাক্যটি প্রয়োগ করে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়- যেহেতু ‘বাংলা জানে না’, সেহেতু ওরা ‘ইংরেজির পণ্ডিত’। হায়রে আমাদের মানসিকতা!

এ দেশের আলো-বাতাসে বেড়ে উঠে যারা বাংলা লিখতে-পড়তে জানবে না, তারা কিভাবে এ দেশের মা, মাটি মানুষের হৃদয়স্পন্দন অনুভব করবে? কোন যোগ্যতা নিয়ে দেশমাতৃকার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে? কিভাবে দেশের প্রতি তাদের মমত্ববোধ আসবে? বাংলা না জানা ওইসব ছেলেমেয়েকে দোষ দেয়ার কিছু নেই। দোষ তাদের অভিভাবকদের। তারা হলেন হতভাগা। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর বাংলা বিষয়ের পাঠ্যসূচি সরকারি তত্ত্বাবধানে এমনভাবে প্রণয়ন করা উচিত যেন শিক্ষার্থীরা অন্তত বাংলা লেখা ও পড়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। এভাবে হতভাগ্য অভিভাবকের সংখ্যা কমানো যেতে পারে।

এ সমাজের শিক্ষিত লোকজনের মধ্যে কৌলীন্য ধরে রাখার জন্য ইংরেজির প্যাঁচানো ও দুর্বোধ্য অক্ষরে ভাই-বোন, সন্তানের বিয়ের কার্ড তৈরি অনেকটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এই মিথ্যা অহমিকা থেকে আমরা কবে বের হয়ে আসতে পারব? ফেসবুকের কল্যাণে বাংলা ভাষায় অনেকের দুর্বলতার বিষয়টি প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। ভুল বানানে বাংলা লেখা অনেকটা চর্চায় পরিণত হয়েছে আর সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা এবং বাংলা ভাষা চর্চার মাধ্যমে উন্নত জাতি হিসাবে নিজেদের দাঁড় করাতে হবে। তাহলে শহীদদের প্রতি যথার্থ সম্মান জানানো হবে। আর একুশের জন্যই আজ আমরা একটি স্বাধীন জাতি সত্তায় পরিণত হয়েছি। একুশ ভাষার প্রাণ একুশ করেছে দান একুশ মোদের পাথেয় একুশকে করো নাকো হেয়।’

একুশের চেতনায় উচ্চকিত হয়ে বাঙালি জাতি গর্বিত। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে একুশের ভূমিকা অপরিসীম।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।