মীর আব্দুল আলীম


আমাদের দেশে আইন তৈরির একটা চমৎকার প্রক্রিয়া আছে। প্রথমে ঘটে কোনো হৃদয়বিদারক ঘটনা, তারপর তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উত্তাল হয়, এরপর জনগণের চাপের মুখে সরকার বসে যায় চিন্তায়—"উফ! এবার কিছু একটা করতে হবে!" ব্যস, তারপরই আসে এক দারুণ ‘দৃঢ়চেতা’ সিদ্ধান্ত। নতুন আইন তৈরি হয়, সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়, টেলিভিশনের পর্দায় একের পর এক বিশেষজ্ঞের মন্তব্য শুনে মনে হয়, "এইবার বোধহয় সব ঠিকঠাক হয়ে গেল!"

কিন্তু হায়! আমরা বাঙালি! আমাদের আবার নিয়ম মানার কী দরকার? আর আইন প্রয়োগ? সেটাও তো এক বিশাল কর্মযজ্ঞ! ফলে কয়েকদিন না যেতেই শুরু হয় আন্দোলন। তখন সরকারের ভাবনা আবার নতুন মোড় নেয়—"আমরা আইন করেছিলাম ঠিকই, কিন্তু জনগণের সাথে তো সংঘাতে যেতে পারি না!" ফলাফল—একটা হাস্যকর পিছু হটা। আর এভাবেই দেশে আইনের মর্যাদা বজায় রাখা হয় আন্দোলনের সুনিপুণ ব্যবস্থাপনায়!

আইনের জন্মবৃত্তান্ত

বাংলাদেশে আইনের জন্ম খুবই বেদনাদায়ক কিন্তু নাটকীয়। ধরুন, একদিন হুট করে সিদ্ধান্ত হলো, রাস্তায় যেখানে-সেখানে থুতু ফেলা যাবে না, ১০০০ টাকা জরিমানা! খবরটা শুনেই জনগণ উত্তেজিত—“কি? আমার পৈতৃক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে? এইটা মানবাধিকারের পরিপন্থী!” কিছুক্ষণ পরই বিভিন্ন জায়গায় ঠোঁট ব্যাঁকানো মানুষজন দাঁড়িয়ে যায় প্রতিবাদে—“থুতু ফেলা আমাদের ঐতিহ্য! এটা আমাদের সংস্কৃতির অংশ!”

এরপর আসে পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলন, ব্যবসায়ীদের হুমকি, বিরোধী দলের বিবৃতি, ‘জনগণের পক্ষে’ দাঁড়িয়ে কিছু সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্টের তীব্র ক্ষোভ। ফলে সরকার ভাবে, “আমরা কি আসলেই ভুল করেছি?” ব্যস! আইনটি বাতিল! জনগণ বিজয় উল্লাস করে, আবার মুক্তভাবে থুতু ফেলতে থাকে!

বিআরটিএ বনাম সিএনজি চালক: এক মহারণ

সাম্প্রতিক ঘটনাই ধরা যাক। সিএনজি চালকরা দীর্ঘদিন ধরে মিটারের বাইরে যাত্রীদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো ভাড়া নিচ্ছেন। ভাড়া নিয়ে দরদাম করতে করতে মাঝেমধ্যে যাত্রীদের মনে হয়, তারা হয়তো রাজধানীর কোনো আধুনিক বাজারে নিলামে বসে আছেন। ফলে বিআরটিএ ঘোষণা দিলো—"এবার থেকে মিটারের বাইরে ভাড়া নিলে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা!"

এটা শুনে সিএনজি চালকদের অবস্থা দাঁড়াল সেই বিখ্যাত কৌতুকের মতো—

যাত্রী: ভাই, সায়েন্সল্যাব যাবেন?
সিএনজি চালক: যাবো, ৫০০ টাকা লাগবে।
যাত্রী: মিটারে যাবেন না?
সিএনজি চালক: (অবাক হয়ে) ভাই, এইটা কি বাস নাকি?

এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিআরটিএর সিদ্ধান্ত স্বাগত জানানো হলেও, কয়েক ঘণ্টা পার না হতেই সিএনজি চালকদের আন্দোলন শুরু হলো। তারা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করলেন, কিছু জায়গায় সিএনজি চালানো বন্ধ রাখলেন। এমন অবস্থা দেখে সরকার কাঁপাকাঁপি শুরু করল—“বাপরে! জনদুর্ভোগ হয়ে যাবে, আমাদের ভাবমূর্তি খারাপ হয়ে যাবে!”

ফলাফল? জরিমানার সিদ্ধান্ত বাতিল! সিএনজি চালকরা বিজয়ের হাসি হাসলেন, জনগণ আবারও ভাড়া নিয়ে দরদাম শুরু করল, আর সরকার ভাবল—"আহা, এবারও পার পেয়ে গেলাম!"

আইন মানা না-মানার মহোৎসব

বাংলাদেশের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, এখানে আইন মানার চেয়ে না মানার উৎসাহ বেশি। ট্রাফিক আইন যখন কড়াকড়ি হয়, তখনই দেখা যায়, রাস্তার মোড়ে মোড়ে এক বিশাল জটলা—হেলমেটহীন চালকরা পুলিশের সঙ্গে দরদাম করছেন। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ দেখে ভাবে, "নিশ্চয়ই কোনো বড় মেলা বসেছে!"

নতুন কর ব্যবস্থা এলে ব্যবসায়ীরা আন্দোলন করেন, নতুন পরিবহন আইন এলে শ্রমিকরা ধর্মঘট ডাকেন, সড়ক নিরাপদ করতে নতুন বিধি হলে পরিবহন মালিকরা হুমকি দেন—"আমরা রাস্তায় গাড়ি নামাবো না!" সরকার তখন ভাবে, “উফ! দেশের অর্থনীতি তো ক্ষতিগ্রস্ত হবে!” ফলে আইন আবারও শিথিল হয়।

আমাদের দেশে আইন মানার জন্য কেউ নিজে থেকে উদ্যোগ নেয় না, আইন মানতে বাধ্য করলেও সেটা ‘জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে’ চলে যায়!

আইন প্রয়োগে সরকারের দোদুল্যমান নীতি

সরকার সবসময় চায়, “আসলেই তো, আইন করা দরকার!” কিন্তু সেটা কতটা কার্যকর হবে, সেটা নিয়ে সরকার নিজেই সন্দিহান থাকে। ফলে দেখা যায়, আইন করা হয় ঠিকই, কিন্তু প্রয়োগের সময় নানা ‘অবস্থান বিবেচনা’ করে সেটা বাতিল করা হয়।

একটা সময় রাস্তায় ধূমপান নিষিদ্ধ করতে আইন করা হলো। কিছুদিন পুলিশের তৎপরতায় ধূমপায়ীরা ভয় পেলেও পরে পুলিশ নিজেই বশ মানলো—“বেশি কড়াকড়ি করলে জনরোষের মুখে পড়তে হবে।” ব্যস! ধূমপায়ীরা আবারও স্বাধীন হয়ে গেলেন!

তাহলে প্রশ্ন হলো, আইন কি শুধুই লোক দেখানো? সরকার কি শুধু ঘোষণার জন্যই আইন বানায়?

সরকারের ‘নতি স্বীকার’ নীতি

বাংলাদেশে যে কোনো কঠিন সিদ্ধান্তই আন্দোলনের মুখে নরম হয়ে যায়। সরকারের নীতিগত অবস্থান নির্ভর করে জনগণের প্রতিক্রিয়ার ওপর। ফলাফল? জনগণ জানে যে, আন্দোলন করলেই তারা যে কোনো সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য করতে পারে!

কিন্তু এতে আসলে লাভ কার? সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমে না, বরং আরও বেড়ে যায়। কারণ একবার আইন শিথিল হলে, ভবিষ্যতে সেই আইন আর কখনোই কার্যকর হয় না।

আইন থাকবে, বাস্তবায়ন হবে না!

বাংলাদেশে আইন তৈরি হয়, কিছুদিনের জন্য প্রয়োগ হয়, তারপর আন্দোলনের মুখে বাতিল হয়ে যায়। এতে সরকারের মর্যাদা কমে, জনগণের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা কমে, আর যারা আইন মানতে চায়, তারাও ভাবে—"কেউ যখন মানছে না, আমি কেন মানবো?"

এই ‘আইন-আন্দোলন-নতি স্বীকার’ চক্র থেকে বের হওয়া দরকার। সরকারের উচিত কঠোর অবস্থান নেওয়া, নীতির প্রতি স্থির থাকা, এবং আন্দোলনের চাপে পড়ে পিছু না হটা। না হলে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি হবে—"সরকার আইন করল, জনগণ আন্দোলন করল, সরকার আইন তুলে নিল!"

এভাবে চলতে থাকলে একদিন হয়তো ‘সড়কে বেপরোয়া গাড়ি চালানোর অনুমতি’ চেয়ে আন্দোলন হবে, এবং সরকার হয়তো তাতেও নতি স্বীকার করবে!

লেখক: কলামিস্ট, সাংবাদিক ও সমাজ সংস্কৃতি গবেষক।