আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থার সংকট: কোন পথে মানবতা?
-1.jpg)
মীর আব্দুল আলীম
সভ্যতার অগ্রযাত্রার প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কিছু দেশ কিছু মানুষ বিলাসিতায় ডুবে আছে, আর অন্যদিকে, কোটি কোটি মানুষ টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত। যুদ্ধ, অভিবাসন সংকট, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক শোষণ, বৈষম্য সংকট সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ দুঃসময়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে সভ্যতা। ধনী দেশগুলোর সম্পদের পাহাড় ক্রমশ উঁচু হচ্ছে, অথচ অনাহারে ধুঁকছে হাজার হাজার শিশু, ভূমিহীন হয়ে ঘুরছে লাখো শরণার্থী। বিশ্বায়নের সুফল যেখানে কিছু নির্দিষ্ট শক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত, সেখানে বিপরীতে যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলোর মানুষ নিরাপত্তাহীন, উদ্বাস্তু আর প্রতিনিয়ত নিপীড়িত। বিশ্বনেতারা বড় বড় সম্মেলন করে, বিবৃতি দেয়, কিন্তু বাস্তবিক কোনো পরিবর্তন আনে না। কারণ, পুঁজির নিয়ন্ত্রকরা চাইলে পৃথিবীর চেহারা বদলে যেতে পারত, কিন্তু তারা সেটা চায় না। যুদ্ধ ও সংকট তাদেরই হাতিয়ার, আর দুর্বল দেশগুলোর জনগণ কেবল তাদের স্বার্থরক্ষার গিনিপিগ। ফলে মানবতার কান্না দিন দিন বেড়েই চলেছে।
এটাই কি সভ্যতার চূড়ান্ত রূপ? নাকি পরিবর্তনের আশায় এখনও কিছু করা সম্ভব? ইতিহাস বলে, সংকটের মাঝেই জন্ম নেয় বিপ্লব। মানুষ জেগে উঠলে, বিশ্ববিবেক যদি একত্রিত হয়, তবে হয়তো নতুন এক মানবিক বিশ্ব গড়ে ওঠা সম্ভব। অন্যথায়, সভ্যতার এই সংকট আরও গভীর হবে, বৈষম্যের দেয়াল আরও উঁচু হবে, আর দুর্ভোগের শেষ কোথায়, তা কেউই জানে না।
"শ্রমের ঘামে সভ্যতা, তবু গরিবের ভাগ্যে বঞ্চনা?" আধুনিক সভ্যতা শ্রমিকের ঘামে গড়ে উঠেছে, কিন্তু তাদের ভাগ্যে কি শুধুই বঞ্চনা? বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে শ্রমজীবী মানুষের ভূমিকা অপরিসীম, অথচ তারা ন্যায্য অধিকার থেকে বারবার বঞ্চিত হচ্ছে। গরিব মানুষগুলোর কঠোর পরিশ্রমের ফল ভোগ করছে ধনী সমাজ, কিন্তু তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না। উন্নয়নশীল দেশগুলোর শ্রমজীবী মানুষের জীবন চরম কষ্টে কাটে। তারা দীর্ঘসময় কাজ করেও ন্যায্য মজুরি পায় না। শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন না থাকায় তারা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে বন্দী থাকে। অথচ এই পরিশ্রমী হাতগুলোর ওপর ভিত্তি করেই বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান, বিলাসবহুল শহর এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটছে।
অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন বেড়ে চলেছে। ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, আর গরিবরা বেঁচে থাকার লড়াই করছে। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থার তথ্যমতে, পৃথিবীর অধিকাংশ সম্পদ মাত্র কয়েক শতাংশ মানুষের হাতে কুক্ষিগত। শ্রমিকরা যাদের জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করে, তারাই তাদের যথাযথ পারিশ্রমিক দিতে কৃপণতা দেখায়। প্রশ্ন হলো, এই বৈষম্যের সমাধান কোথায়? বিশ্বনেতারা কি সত্যিই শ্রমজীবী মানুষের কথা ভাবেন? নাকি তারা কেবল নীতিকথা বলেই দায়িত্ব এড়িয়ে যান? প্রকৃতপক্ষে, শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত না করলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি কখনোই টেকসই হবে না।
শ্রমিকদের প্রাপ্য সম্মান ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রকে কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে হবে। গরিবদের ভাগ্যে শুধুই বঞ্চনা লেখা থাকলে সভ্যতার অগ্রগতি মূল্যহীন হয়ে যাবে। সবার জন্য সমান অধিকার, সুবিচার এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুললেই শ্রমজীবী মানুষ তাদের প্রাপ্য সম্মান পাবে, আর বৈষম্যের শৃঙ্খল ভেঙে সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে।
নতুন বিশ্বব্যবস্থা সম্ভাবনা নাকি পুনরাবৃত্তি এমন প্রশ্ন সামনে আসে। বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনশীল গতিধারা এবং অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের ফলে একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা তীব্র হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিবর্তন কি সত্যিই একটি নতুন ব্যবস্থা আনবে, নাকি আমরা শুধু পুরনো কাঠামোর ভিন্ন রূপ দেখব? বৈশ্বিক শক্তির নতুন বিন্যাস দেখছি আমরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গড়ে ওঠা পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা আজ বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। চীন, রাশিয়া, ভারত, ব্রাজিলের মতো উদীয়মান শক্তিগুলো একক মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প তৈরি করতে চাইছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমছে, ইউরোপ অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত, এবং মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ায় নতুন জোট গঠিত হচ্ছে। এশীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, ব্রিকস (BRICS)জোটের সম্প্রসারণ, এবং ডলার-নির্ভরতা কমানোর প্রবণতা একটি পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে।
প্রশ্ন হলো নতুন বিশ্বব্যবস্থার অন্তরায় কি? বিশ্ব এখনো পুরনো সংকটগুলোর সমাধান পায়নি। জলবায়ু পরিবর্তন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, এবং প্রযুক্তির অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিস্তার নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করছে। অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা ও ধনী-দরিদ্র দেশের বৈষম্য বিশ্বব্যবস্থার নতুন কাঠামো গঠনে অন্তরায় হতে পারে। বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা একটি সম্ভাব্য বিশ্বসংকটের ইঙ্গিত বহন করছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা, মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা—এসব পরিস্থিতি বিশ্বকে নতুন সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে পারে। নতুন বিশ্বব্যবস্থা সম্ভব, তবে তা কোনো স্বতঃসিদ্ধ বাস্তবতা নয়। এটি নির্ভর করবে বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য, প্রযুক্তির ব্যবহার, এবং অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার উপর। বর্তমান সংকট যদি সঠিকভাবে সামলানো না যায়, তবে আমরা পুরনো সমস্যার আধুনিক সংস্করণ নিয়েই এগিয়ে যাব।
অভিবাসন রাজনীতি মানবতা নাকি ক্ষমতার খেলা? বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো অভিবাসন ইস্যুতে দ্বৈত নীতি গ্রহণ করে চলেছে। যখন তাদের প্রয়োজন হয়, তখন তারা শরণার্থীদের স্বাগত জানায়; কিন্তু যখন অভিবাসীদের সংখ্যা বাড়ে বা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চাপ তৈরি হয়, তখন কঠোর সীমান্ত নীতি গ্রহণ করে। এ যেন এক সূক্ষ্ম ক্ষমতার খেলা, যেখানে মানবিকতার চেয়ে রাজনৈতিক স্বার্থই মুখ্য। উন্নত দেশগুলো প্রায়শই মানবাধিকারের কথা বলে, কিন্তু বাস্তবে তাদের কর্মকাণ্ড তার বিপরীত। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা বা ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর সংকট নিরসনে তারা বড় কোনো উদ্যোগ নেয় না, বরং অস্ত্র সরবরাহ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বা সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। ফলশ্রুতিতে, হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় এবং জীবন বাঁচাতে শরণার্থী হয়ে উন্নত দেশগুলোর দিকে পাড়ি জমায়। অথচ এদের বড় অংশই সীমান্তে প্রতিরোধের মুখে পড়ে। অভিবাসীদের ব্যাপারে কঠোর নীতি গ্রহণ করে সরকারগুলো মূলত অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সুবিধা নিতে চায়। জনমনে জাতীয়তাবাদের উগ্রতা উসকে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটে। অথচ, এই অভিবাসীরাই অর্থনীতি, কৃষি, নির্মাণ ও প্রযুক্তি খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সুতরাং, অভিবাসন ইস্যুতে বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণের চেয়ে, বিশ্বনেতাদের উচিত যুদ্ধ, দারিদ্র্য ও বৈষম্যের মূল কারণ দূর করা। নতুবা, অভিবাসন সংকট কমবে না, বরং বৈশ্বিক অস্থিরতা আরও বাড়বে। অভিবাসন নীতি কি মানবিক হবে, নাকি ক্ষমতার হাতিয়ার হয়ে থাকবে—এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার সংকট সংঘাতের ছায়ায় জীবন : মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলো বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ, দারিদ্র্য, স্বৈরাচারী শাসন এবং বিদেশি হস্তক্ষেপের শিকার। সিরিয়া, ইয়েমেন, সুদান ও কঙ্গোর মতো দেশে সংঘাত ও সহিংসতা জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এসব অঞ্চলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিত্যদিনের বাস্তবতা। লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন, শরণার্থী এবং অপুষ্টির শিকার। এই সংকটের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, জাতিগত ও ধর্মীয় সংঘাত, দুর্নীতি, স্বৈরশাসন এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর স্বার্থসংশ্লিষ্ট কার্যকলাপ। মধ্যপ্রাচ্যে তেল ও প্রাকৃতিক সম্পদের দখল নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, আফ্রিকায় খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ এবং রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা সংঘাতকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। বড় রাষ্ট্রগুলোর অস্ত্র বাণিজ্য এই সংকটকে আরও গভীর করছে। পশ্চিমা দেশগুলো এবং কিছু আঞ্চলিক শক্তি যুদ্ধরত গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র ও সামরিক সহায়তা প্রদান করে, যা সংঘাতকে দীর্ঘস্থায়ী করে। সিরিয়া ও ইয়েমেনে বিদেশি শক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পৃক্ততা যুদ্ধের তীব্রতা বাড়িয়েছে। আফ্রিকায় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর অস্ত্র সংগ্রহের সহজলভ্যতা সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে। এছাড়া, সংঘাতপূর্ণ দেশগুলোর শাসকদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বিদেশি শক্তিগুলোর ভূমিকা তাদের জনগণের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে শান্তি স্থাপনের পরিবর্তে সংকট আরও গভীর হচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, অস্ত্র বিক্রিতে নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক ও মানবিক সহায়তা বাড়ানো জরুরি। যুদ্ধ ও সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুবা, এই অঞ্চলগুলোতে মানবিক সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠবে।
চীন বিশ্ব রাজনীতির নতুন কেন্দ্রবিন্দু : বর্তমান যুগে চীন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা শুধু তার আঞ্চলিক সীমার মধ্যে নয়, বরং বৈশ্বিক রাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিক শক্তি এবং প্রযুক্তির দিক থেকেও আধিপত্য বিস্তার করছে। তাদের উন্নয়নশীল কৌশল, বাণিজ্যিক উদ্যোগ এবং আধুনিক সামরিক সক্ষমতা পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে নতুন একটি শক্তির সমীকরণ তৈরি করেছে। চীনের অর্থনীতি বিশ্বব্যাপী এক শক্তিশালী স্থান অধিকার করেছে। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) চীনের অর্থনীতির পরিমাণ বৃদ্ধির দিকে নজর দিয়েছে, যেখানে তাদের 'বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ' (BRI) বৈশ্বিক বাণিজ্যকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে। চীন এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপের বহু দেশে অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে, যা দেশগুলোর সাথে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করছে। এর ফলে, পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষত ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্র, এই নতুন অর্থনৈতিক শক্তি সম্বন্ধে চিন্তিত হচ্ছে, কারণ চীন অন্যান্য দেশের ওপর অর্থনৈতিক প্রভাব তৈরির মাধ্যমে তাদের প্রভাব বিস্তার করছে।
চীন সামরিক ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করছে, যা তাদের শক্তির আধিপত্যকে আরও সুদৃঢ় করছে। দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের সামরিক উপস্থিতি এবং এই অঞ্চলে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা বিশ্ব রাজনীতির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীন তাদের নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং সাইবার যুদ্ধ কৌশলগুলোর মাধ্যমে শীর্ষ পর্যায়ের সামরিক শক্তি হয়ে উঠেছে, যা তাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ। বিশেষ করে, তাইওয়ান ইস্যুতে চীনের অবস্থান পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে বিরোধ তৈরি করছে। চীন প্রযুক্তি খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনছে। হুয়াওয়ের ৫জি প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), এবং মহাকাশ গবেষণায় তাদের সাফল্য বিশ্বব্যাপী এক নতুন প্রযুক্তিগত পরিবেশ সৃষ্টি করছে। চীনের এই প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা তাদের বিশ্বজুড়ে প্রভাব বিস্তার করতে সহায়তা করছে এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের এক নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। চীনের নেটওয়ার্ক, সাইবার নিরাপত্তা এবং উদ্ভাবন এই বিশ্ব ব্যবস্থার নতুন অঙ্গ হয়ে উঠছে, যা ভবিষ্যতের প্রযুক্তি রাজনীতির পথে তাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
পশ্চিমা আধিপত্যের বিপরীতে চীনের উত্থান : চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তির উন্নতি পশ্চিমা আধিপত্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে বাণিজ্য যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক নীতি-নৈতিকতার ক্ষেত্রে চীন যে অবস্থান গ্রহণ করছে তা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য অবরোধ এবং নিষেধাজ্ঞার পরেও চীন তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক পথ এবং কৌশলগত পরিকল্পনায় সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, যা তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে। এভাবে, চীন বর্তমানে বিশ্ব রাজনীতির একটি শক্তিশালী কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে এবং তার অগ্রগতির ফলে ভবিষ্যতে বৈশ্বিক শক্তির তত্ত্ব ও সমীকরণে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে।
ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি : ভারত মহাসাগর আজকের বৈশ্বিক ভূরাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মহাসাগর এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার সংযোগস্থল হিসেবে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য ভারত মহাসাগর শুধু বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্র নয়, বরং নিরাপত্তা ও সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতারও ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এই অঞ্চলে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শক্তির প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা চলছে। চীন তার "বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)" প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিনিয়োগ করছে। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর এবং পাকিস্তানের গদর বন্দরে চীনের উপস্থিতি ভারতের জন্য বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ভারতও "সাগর (SAGAR) উদ্যোগ" ও "অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি" গ্রহণ করে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে চাইছে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগর অঞ্চলে তার সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে এবং "ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল" এর মাধ্যমে ভারতের সাথে সহযোগিতা বাড়িয়েছে। পাশাপাশি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও এ অঞ্চলে তাদের ভূমিকা বৃদ্ধি করছে। ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য যেমন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে, তেমনি নিরাপত্তার ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে, চীন-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত করতে পারে। তাই, আঞ্চলিক দেশগুলোকে নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষার পাশাপাশি কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা এবং সম্ভাবনার সন্ধান: বাংলাদেশ, একটি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে, বৈশ্বিক পরিস্থিতির মধ্যে একদিকে যেমন ক্রমবর্ধমান সংকটের মুখোমুখি, তেমনি অন্যদিকে সম্ভাবনার পথও খুঁজে পাচ্ছে। অভিবাসন সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব—এই সমস্ত চ্যালেঞ্জের মধ্যে বাংলাদেশ নানা ক্ষেত্রে তার উন্নতি অব্যাহত রেখেছে। প্রথমত, বাংলাদেশে অভিবাসন সংকট একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের মানুষ বিদেশে কাজের জন্য যাওয়ার ফলে অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তবে, বিদেশে অভিবাসন থেকে অর্জিত রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। প্রতিনিয়ত এই রেমিট্যান্স প্রবাহ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখছে এবং জাতীয় আয়ে শক্তি যোগাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশকে আরও বেশি দুর্বল করে তুলছে।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে থাকায় ভূমি হারানোর সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবুও, বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে একযোগে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলে টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে কাজ করছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব। যদিও বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, তবে বাংলাদেশ তার নিজস্ব শক্তি ও সম্পদে অনেক ক্ষেত্রেই সফল হয়েছে। দেশের উৎপাদন খাত, কৃষি ও রফতানি খাত এখনও প্রবৃদ্ধির দিকে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের তৈরিকৃত পোশাক শিল্প বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বড় উৎস। বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে। দেশটি এখন দক্ষিণ এশিয়ার একটি শক্তিশালী শক্তি হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের কূটনৈতিক দক্ষতা এবং নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি প্রশংসিত হচ্ছে। এসব বিষয় বাংলাদেশের ভবিষ্যতের সম্ভাবনা উন্নয়নের দিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। সুতরাং, বাংলাদেশের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকলেও সম্ভাবনা রয়েছে বিপুল পরিমাণ। প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দেশটি উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে, যা ভবিষ্যতের এক উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে প্রতিফলিত করে।
বিশ্ব মানবিকতা বনাম স্বার্থপরতা: মানবিকতা বনাম স্বার্থপরতা একটি জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা বিশেষ করে অভিবাসনের প্রেক্ষাপটে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বর্তমান পৃথিবীতে, যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং দারিদ্র্য যেমন বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, তেমনি সেই সমস্যাগুলির শিকার মানুষের জীবনও বিপর্যস্ত হচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ তাদের দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে, তবে উন্নত দেশগুলো তাদেরকে আশ্রয় দিতে অনিচ্ছুক এবং সীমান্তে কঠোর নীতি প্রয়োগ করছে। এই পরিস্থিতি মানবিকতার এক গভীর সংকট সৃষ্টি করছে, যেখানে অনেকেই তাদের দেশীয় মানুষদের সাহায্য করার পরিবর্তে নিজেদের স্বার্থ এবং নিরাপত্তা রক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।
এটি কি মানবিকতার সংকট, না কেবল রাজনৈতিক কৌশল? উন্নত দেশগুলোর দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের সীমান্ত রক্ষার প্রয়াসে কঠোর নীতি একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ হতে পারে, যেখানে তারা অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক সংকট বা সামাজিক অস্থিরতা থেকে সুরক্ষা চায়। তবে, এই নীতি প্রায়ই মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং মানবিক সহানুভূতির অভাব হিসেবে দেখা যায়। অন্যদিকে, স্বার্থপরতা এক্ষেত্রে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর আগ্রহের সাথে সম্পর্কিত। তারা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে না ভেবে, তাদের দেশের সীমান্তে বেশি অভিবাসী আসা আটকানোর চেষ্টা করে। তবে এই ধরনের স্বার্থপরতা দীর্ঘমেয়াদে বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, কারণ এটি গরীব ও সংগ্রামী জাতিগুলোর প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভাব তৈরি করে। এমন পরিস্থিতিতে, মানবিক মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত, যাতে করে অভিবাসী মানুষের জীবন রক্ষা পায় এবং তারা নিজেদের নতুন দেশে সুরক্ষিত জীবন পেতে পারে। এর মাধ্যমে একটি আরও মানবিক, সহানুভূতিশীল এবং আন্তর্জাতিক সমবেদনা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
আজকের বিশ্ব এক দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলমান যুদ্ধ ও সংঘাত কেবলই রাজনৈতিক নয়, এটি মানবিক বিপর্যয়ের জন্ম দিচ্ছে। সিরিয়া থেকে গাজার শিশু, আফ্রিকার শরণার্থী শিবির থেকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা প্রতিটি যুদ্ধ একটি মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে। কিন্তু বিশ্বনেতারা কি এই সংকট সমাধানের উদ্যোগ নিচ্ছেন, নাকি তারা নিজেদের স্বার্থেই এসব পরিস্থিতি বজায় রাখতে চাচ্ছেন? এ অবস্থায় মানবতা বনাম ক্ষমতার লড়াইয়ে মানবতা কি টিকতে পারবে? নাকি এক নিষ্ঠুর বিশ্ব আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে? বিশ্বনেতাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—তারা ইতিহাসে কীভাবে স্মরণীয় হতে চান: ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য, নাকি ক্ষমতার লালসার জন্য?
লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।