রম্য
দুর্নীতি সূচকের মহাকাব্য: এক ধাপ এগিয়ে, দুই ধাপ পিছিয়ে
-1.jpg)
মীর আব্দুল আলীম
ডেনমার্ক যখন দুর্নীতিমুক্ত হওয়ার আনন্দে কেক কাটছে, আমরা তখন দুর্নীতির তালিকায় চার ধাপ "উন্নতি" করায় মিষ্টির হাঁড়ি খুলছি! বাংলাদেশ দুর্নীতির সূচকে আবারও এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে! আহা, কী আনন্দ! টিআইবির তথ্য মতে, দুর্নীতির ধারণা সূচকে দুই ধাপ পিছিয়ে ২০২৪ সালে বিশ্বে ১৫১তম অবস্থান দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের। ২০২৩ সালে এ সূচকে বাংলাদেশ ১৪৯তম অবস্থানে ছিল। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)২০২৩ সালে ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৪, গত বছর পেয়েছে ২৩। মানে হলো, দুর্নীতি বাড়ায় বাংলাদেশের স্কোর ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে এক কমেছে। কিন্তু অন্য দেশ আরও খারাপ করায় সূচকে চার ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। দুর্নীতিতে আরও দক্ষতা অর্জন করে আমরা উঠে গেলাম এক অনন্য উচ্চতায়!
আমরা দেখছি পরীক্ষায় ফেল করেও পাশ করার আনন্দ! পাশের ছাত্ররা এতটাই খারাপ ফল করেছে যে, আমাদের খারাপ রেজাল্টও তাদের তুলনায় ভালো মনে হচ্ছে। কী দারুণ! এই যে আমরা ২০২৩ সালে ২৪ নম্বরে ছিলাম, আর ২০২৪-এ এসে তা ২৩ হয়ে গেছে অথচ আমাদের তো কমের কথা ছিল, কিন্তু কেন যেন আরো এক ধাপ নামলাম না! অদ্ভুত না? সত্যি বলতে, আমরা তো একটা ঘুরে ফিরে একই গর্তে পড়ে আছি, কেবল আমাদের তালিকায় কিছু ওঠানামা হয়েছে—এটা কি উন্নতি, নাকি আরও গভীর গর্তে পড়ে যাওয়ার হাতছানি?
এটা কি কোনো ভাল লক্ষণ? কিংবা পৃথিবীর যে কোন দেশের জন্য কি এটি সত্যিই স্বস্তির বিষয়? যা আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাতে বুঝা যাচ্ছে যে, দেশ যখন দুর্নীতির জালে আটকে যায়, তখন তার অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কাঠামো একেবারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু আমাদের দেশের কি কোন ভাবেই এমন ক্ষতি হচ্ছে? না, আমাদের দেশের জনগণ এখন নিজের চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছে একটি অন্ধকার যুগের উদয়, বিগত ১৬ বছর ছিলো আরো অন্ধকারে। যেখানে ন্যায়বিচার, আইন এবং শাসন শুধুমাত্র একটি পরিসংখ্যান হয়ে উঠেছে।
আইনের শাসন যখন দুর্নীতির পাহাড়ে আটকা থাকে, তখন দুর্নীতি কমবে কীভাবে? শাস্তি যারা দেবেন, তাদের নিজের পকেটে যদি দুর্নীতি লুকানো থাকে, তাহলে অপরাধীকে গ্রেফতার করার দায়িত্ব কীভাবে পালন করবেন? আমাদের দেশে দুর্নীতি মানেই যেন "সবাই তো করছে, আমরাও করি না কেন?" দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই চলচে। নীতির কথা? হ্যাঁ, সেগুলো এখন তো মিউজিয়ামের পুরোনো মূল্যবোধ, যেগুলো হাতে ধরলেই কেবল সেগুলি মৃদু মৃদু ঝাঁকুনি দেয়। ৫ াাগষ্টের পর ভালো কিছুর প্রত্যাশা ছিলো দেশবাসীর। কিন্তু না চাদাবাজী, লুটপাট, ভাংচর সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বন্ধ হয়নি এখনো। সড়ক বিভাগ থেকে শুরু করে সব জায়গাতেই ‘নতুন বোতলে পুরোন মদ’। আগের লোকজন ঘুরে ফিরে ঠিকাদারী মাতব্বরী করছে। তাহলে দুর্নীতি কমবে কি করে। ওরাতো দুর্নীতির এ পেশায় বেশ পারঙ্গম। তারাই এখন নতুনদের পদ দেকিয়ে সামনে হাঁটছে।
এবার রাজনৈতিক নেতাদের শাসনকাল যোগ করি, তাহলে তো দুর্নীতির পুরো অবস্থা একেবারে পরিষ্কার হয়ে যায়। আমরা দেখি, ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা যখন দুর্নীতির সাথে হাত মেলাচ্ছেন, তখন তাদের বিরুদ্ধে কোনো তদন্তের ভয়ও নেই, কিছুই ঘটবে না। যতই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকুক, তা কখনোই সুষ্ঠুভাবে তদন্ত হয় না—এটা তো পুরো পরিস্থিতিকে একদম অসহনীয় করে তোলে। এখন যখন জনগণ মুখ খুলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে, তখন সরকারের প্রতিনিধিরা কিছু সুন্দর ভাষণে নিশ্চয়তা দেন যে, তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু বাস্তবে সেটা কি হয়? সব কিছু কয়েকটা ফাইলের মধ্যে আটকা পড়ে, আর কিছু মিথ্যে রিপোর্টের মাধ্যমে দায়ভার কাটিয়ে ফেলা হয়, এবং তারপর চা-পান খাওয়ার পর সবাই আবার তাদের পুরানো কাজের দিকে চলে যায়। কী দুর্দশা!
এমন একটা পরিস্থিতি আমাদের কী শিক্ষা দেয়? আইনের প্রয়োগ কোথায়? যখন আইন প্রয়োগকারী সত্ত্বারাই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে, তখন বিচার আসবে কোথা থেকে? আমাদের দেশে তো দুর্নীতি রোধে কোনো কার্যকর আইন ও শাসন সিস্টেম গড়ে ওঠেনি। প্রশাসন ও বিচার বিভাগ একে অপরের সাহায্য ছাড়া কিছুই করতে পারে না, এবং এটা দেশের অবস্থা আরও খারাপ করে তুলছে। তাহলে, প্রশ্নটা হলো, যেখানে আইনের শাসন নেই, সেখানে সমাজ কীভাবে এগিয়ে যাবে? আমাদের দেশের সৎ, শিক্ষিত, নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ লোকেরা যেভাবে অবমূল্যায়িত হচ্ছেন, সেখানে সাধারণ জনগণের পক্ষে কি একে পাল্টানো সম্ভব? সম্ভবত না, যদি না জনগণ একসাথে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ না হয়। এই পরিবর্তন আনতে হলে, আমাদের সকলকে নিজেদের দায়িত্ব নিতে হবে—নীতির প্রতি দায়বদ্ধতা, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং সত্যের পক্ষে কথা বলা, এগুলোই সমাজের উন্নতির মূল চাবিকাঠি। যদি আমরা এগুলোর প্রতি ভালোভাবে দৃষ্টি দিই, তবে হয়তো একদিন আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো ‘সত্যিকারের অর্জন’ দেখতে পাবো।
সত্যিই কি দুর্নীতি রোধ হবে, না আবারও সরকারের মিটিংয়ে চা-সিঙ্গারা চলবে? সব সরকারের সরকারি ভাষ্য মতে, "আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর কিন্তু বাস্তবতা হলো, দুর্নীতি আমাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর! এখন যদি এভাবেই এগোতে থাকি, আগামী বছর হয়তো দুর্নীতির অলিম্পিকে পদক জয়ের উৎসব করতে হবে! ড. ইউনুস সরকারের উচিৎ সবার আগে দুর্নীতির সংস্কার। সম্মিলিত উদ্যোগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই। নয়তো, এই কু-চক্রের বেড়াজাল একদিন আমাদের সবাইকে ঘিরে ফেলবে।
হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। যদি সত্যিই পরিবর্তন আনতে চাই, তাহলে সারাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। দুর্নীতিবাজদের মুখোশ খুলে দিতে হবে। মঞ্চের বক্তৃতা আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে আদর্শ কপচানো নয়, বাস্তবে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। একদিন যদি আমরা তালিকায় ১ নম্বরে চলে আসি, তখন আমাদের কেউ সরাতে পারবে না। এটা আর এক দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়াবে।
লেখক : সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।