মীর আব্দুল আলীম


বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা নতুন কিছু নয়। ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনের সময় এই ফর্মুলার মাধ্যমে দুই প্রধান রাজনৈতিক নেতা—শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে সরিয়ে নতুন একটি রাজনৈতিক কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমানে আবারও এ ধরনের ষড়যন্ত্রের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। এবার বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের পরিকল্পনার উদ্দেশ্য কী? এর পেছনে কারা রয়েছে? এবং এটি বাস্তবায়িত হলে এর সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে? এক পক্ষ বলছে, দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহল বাংলাদেশের রাজনীতিকে নতুনভাবে সাজানোর চেষ্টা করছে। আরেক পক্ষের দাবি, এটি স্রেফ রাজনৈতিক বিভ্রান্তি তৈরির কৌশল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সত্যিই কি মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা চলছে?

‘মাইনাস টু’ বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া শুধু দলীয় প্রধান নন, তারা দলের মূল চালিকাশক্তিও বটে। শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ কতটা সংগঠিত থাকবে, সে প্রশ্ন যেমন আছে, তেমনি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিলে বিএনপি কতটা টিকে থাকতে পারবে, তাও বিবেচনার বিষয়। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দলকে চাপে ফেলে রাজনীতি থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়।ওয়ান-ইলেভেনের সময় শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরানোর চেষ্টা হয়েছিল। তবে সে প্রচেষ্টা তখনই ভেস্তে যায়, যখন দেখা যায় তাদের অনুপস্থিতিতে দলীয় ঐক্য ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এ ধরনের রাজনৈতিক ইঞ্জিনিয়ারিংকে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে যে অস্থিরতা চলছে, তার পেছনে বহুমুখী স্বার্থ জড়িত। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা এবং বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান একে আরও জটিল করে তুলেছে। ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে গিয়ে সরকার কতটা স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে, সে প্রশ্ন বহুদিন ধরেই আলোচনায় আছে। পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্বের কিছু মহলও রাজনৈতিক ভারসাম্য পরিবর্তনের চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

মাইনাস টু ফর্মুলার পটভূমি ও ব্যর্থতা: ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত সরকার ‘সংস্কারের’ নামে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে বিভাজন তৈরির চেষ্টা করেছিল। দেশকে দুই নেত্রীর প্রভাবমুক্ত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংস্কারপন্থী ও অনুগত নেতাদের সামনে এনে নেতৃত্ব পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু এই প্রকল্প টেকসই হয়নি। গণতন্ত্রপন্থী জনগণের রাজনৈতিক বিশ্বাস, দলীয় কর্মীদের আনুগত্য ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাধার কারণে সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। ফলে মাইনাস টু বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি, বরং দলগুলো আরও সংঘবদ্ধ হয়ে ফিরে আসে।

আরেকটি ১/১১ এর সম্ভাবনা এবং মাইনাস টু বাস্তবতা নাকি কল্পনা? বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে "এক-এগারো" এবং "মাইনাস টু" দুটি অত্যন্ত পরিচিত ও বিতর্কিত শব্দ। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে যে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল, তা "এক-এগারো" নামে পরিচিত। এ সময় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছিল, যার ফলে সামরিক বাহিনীর পরোক্ষ সমর্থনে একটি অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল দুর্নীতি দমন এবং তথাকথিত "মাইনাস টু" ফর্মুলা বাস্তবায়ন, যার মাধ্যমে তৎকালীন প্রধান দুই রাজনৈতিক নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়, তবে এক-এগারোর প্রভাব বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গভীর ছাপ রেখে গেছে। বর্তমান বাস্তবতায় এক-এগারোর পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা কতটা যৌক্তিক? বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, অর্থনৈতিক সংকট এবং স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলের অংশগ্রহণ সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এই পরিস্থিতি অনেকের মনে প্রশ্ন জাগাচ্ছে—দেশ কি আবার এক-এগারোর মতো কোনো পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে?
যারা এই আশঙ্কা করছেন, তাদের যুক্তি হলো-

রাজনৈতিক সংকট: বিরোধী দলগুলোর কার্যত কোণঠাসা অবস্থান, তাদের আন্দোলনে কঠোর দমন-পীড়ন, এবং সরকারের প্রতি ক্রমবর্ধমান জনঅসন্তোষ।

অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ: ডলার সংকট, আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্যহীনতা, ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম এবং দুর্নীতি।

প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা সংকট: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং গণতন্ত্রের সংকীর্ণ পরিসর।

বহির্বিশ্বের চাপ: আন্তর্জাতিক মহলের নির্বাচন ও মানবাধিকার ইস্যুতে অসন্তোষ, বিশেষ করে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও পশ্চিমা দেশগুলোর উদ্বেগ। তবে এক-এগারোর মতো সরাসরি সামরিক সমর্থনপুষ্ট প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের বাস্তবতা এখন অনেকটাই ভিন্ন।

এবারের পরিকল্পনায় দুটি প্রধান দিক রয়েছে: ১. বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করা: খালেদা জিয়ার অসুস্থতা এবং তারেক রহমানের নির্বাসিত অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ২. নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ: কিছু মহল একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে, যারা বর্তমান সরকার ও বিএনপি উভয়ের বিপরীতে থাকবে। এ ধরনের পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্য হলো রাজনীতিকে পুনর্গঠন করা এবং বিদ্যমান দুই নেত্রীর প্রভাব কমানো।

বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে দলীয় রাজনীতির মূল ভিত্তি নেতার প্রতি আনুগত্য। আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে সুসংগঠিত, আর বিএনপির নেতৃত্ব এখনো খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ওপর নির্ভরশীল। ১. শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা: দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির শীর্ষে থাকার ফলে এই দুই নেত্রী তাদের দলের সমর্থকদের মনোভাব গড়ে তুলেছেন। ফলে তাদের সরিয়ে দিলেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে যাবে, এমন ধারণা বাস্তবসম্মত নয়। ২. রাজনৈতিক শূন্যতা: যদি সত্যিই মাইনাস টু বাস্তবায়ন হয়, তাহলে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হবে, যা তৃতীয় পক্ষের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করবে। অতীতে দেখা গেছে, এ ধরনের পরিস্থিতি সামরিক শাসন বা অনির্বাচিত সরকার গঠনের পথ উন্মুক্ত করে। ৩. গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা: আন্তর্জাতিক মহল এখন বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেখতে চায়। অতীতে তারা রাজনৈতিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রতি নীরব সমর্থন দিলেও বর্তমানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী রাখার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে।

‘মাইনাস টু’ হলে সম্ভাব্য প্রভাব: ১. রাজনৈতিক অস্থিরতা- রাজনৈতিক নেতৃত্বকে জোরপূর্বক সরানোর প্রচেষ্টা প্রায়শই অস্থিতিশীলতা তৈরি করে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের পরিবর্তন যদি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় না হয়, তাহলে দলীয় সংঘাত বাড়বে। ২. অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা- বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পছন্দ করেন। যদি শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়, তাহলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ৩. তৃতীয় শক্তির উত্থান- যদি প্রধান দুই দলের নেতৃত্ব দুর্বল হয়, তাহলে কিছু গোষ্ঠী নতুন বিকল্প শক্তি তৈরির চেষ্টা করবে। এতে রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ দেখা দিতে পারে, যা বিদ্যমান দলগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। ৪. আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া-বাংলাদেশের রাজনীতি শুধু অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, আন্তর্জাতিক স্বার্থও এখানে কাজ করে। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো শক্তিগুলো বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা চায়। তারা কোনো অস্থিতিশীল রাজনৈতিক প্রকল্পকে সমর্থন নাও করতে পারে।

বাস্তবসম্মত নাকি রাজনৈতিক প্রচারণা? মাইনাস টু ফর্মুলার আলোচনা সময়-সময়ে সামনে আসে, বিশেষ করে যখন রাজনৈতিক সংকট তীব্র হয়। ২০০৭ সালে এটি ছিল একটি বাস্তব পরিকল্পনা, কিন্তু তা সফল হয়নি। বর্তমানে আবারও কিছু মহল থেকে "মাইনাস টু" নিয়ে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, এটি আসলেই সম্ভাব্য কি না? এর পক্ষে যুক্তি: যদি কোনো মহল মনে করে যে প্রধান দুই রাজনৈতিক নেতৃত্বই সংকটের মূল কারণ, তবে তাদের সরিয়ে একটি "নতুন নেতৃত্ব" প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হতে পারে। রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সংস্কার করার প্রয়াস হিসেবে কেউ কেউ এটি সমর্থন করতে পারেন। যদি অভ্যন্তরীণ বা আন্তর্জাতিক চাপ চরমে পৌঁছে, তাহলে কোনো বিকল্প ব্যবস্থা ভাবার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে।

এর বিপক্ষে যুক্তি: বাংলাদেশের রাজনীতি শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকেন্দ্রিক; তাদের সরিয়ে নেওয়া সহজ নয়। দলীয় সাংগঠনিক কাঠামো এতটাই শক্তিশালী যে, নেতৃত্ব পরিবর্তন করলেও মূল দলগুলোর আদর্শিক অবস্থান বদলাবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সরাসরি এমন কোনো হস্তক্ষেপ সমর্থন করবে না।

কারা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে লিপ্ত: ১. বিএনপি বা আওয়ামী লীগের ভেতরেই কিছু সুবিধাভোগী গোষ্ঠী থাকতে পারে, যারা নতুন নেতৃত্ব আসলে ফায়দা লুটতে পারবে। ২. কিছু রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও আমলাতান্ত্রিক মহল রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য এ ধরনের প্রকল্পে আগ্রহী হতে পারে। ৩. বিদেশি শক্তি হয়তো চায়, বাংলাদেশে একটি নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র থাকুক, যেখানে তাদের স্বার্থ রক্ষা করা সহজ হবে।

সমাধান কী?

১. গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া জোরদার করা: গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে, যেন নেতৃত্ব পরিবর্তন সংবিধান ও রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে হয়। ২. সংলাপ ও সমঝোতা: রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ বাড়াতে হবে, যেন ষড়যন্ত্রের সুযোগ কমে। ৩. আন্তর্জাতিক মহলের সদিচ্ছা: বিদেশি শক্তিগুলোর উচিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখা। ৪. জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি: সাধারণ মানুষকে রাজনৈতিক ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পর্কে সচেতন করতে হবে, যাতে তারা গণতন্ত্রবিরোধী যেকোনো চক্রান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বাস্তবায়ন সম্ভব কি না, তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, জনগণের প্রতিক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক অবস্থানের ওপর। তবে অতীত অভিজ্ঞতা বলে, রাজনৈতিক ইঞ্জিনিয়ারিং দীর্ঘস্থায়ী হয় না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে কোনো সমাধান আসতে পারে না। বরং স্বচ্ছ রাজনৈতিক সংস্কৃতির মাধ্যমে স্থিতিশীলতা অর্জন করাই উত্তম পথ।

লেখক : সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।