বেওয়ারিশ লাশ অন্তহীন শূন্যতা
![](https://www.u71news.com/article_images/2025/02/06/ALIM--sk-(1).jpg)
মীর আব্দুল আলীম
জীবনের যেমন মূল্য আছে, তেমনি মৃত্যুরও মর্যাদা থাকা উচিত কিন্তু বাংলাদেশে প্রতি মাসেই অসংখ্য লাশ অজ্ঞাত পরিচয়ে হারিয়ে যায়। ৭৮ শতাংশ লাশের কোনো পরিচয়ই শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। পরিচয়হীন এইসব লাশের সঠিক স্বজন খুঁজে পেতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (পিবিআই) নানা উদ্যোগ নিলেও এখনো এটি একটি ভয়ংকর বাস্তবতা। বাংলাদেশে অজ্ঞাত পরিচয়ের লাশ উদ্ধারের ঘটনা ক্রমবর্ধমানভাবে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত ৫৭০টি মরদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে, যা মাসে গড়ে ৪৮টি প্রায়। বিশেষ করে জুলাই মাসে এই সংখ্যা ছিল ৭০, যা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি।
প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে অজস্র অজ্ঞাতনামা লাশ। কখনো দুর্ঘটনায়, কখনো হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে কিংবা নিছক পথের ভিখারির মতো নিঃসঙ্গভাবে পড়ে থাকে তারা। পরিবারের স্নেহ-ভালোবাসার বাইরে, রাষ্ট্রেরও কোনো স্বীকৃতি ছাড়াই, একসময় তারা পরিণত হয় বেওয়ারিশ লাশে। প্রশাসনের দায়বদ্ধতা অনুযায়ী, এসব লাশের নিয়ম মেনে দাফন করা হলেও তাদের পরিচয় জানতে পরিবারের কেউ অপেক্ষা করে থাকে বছরের পর বছর। একটি মৃত্যু কেবল জীবনের সমাপ্তি নয়, এটি অনেক না বলা কাহিনির সমাপ্তি টানে। সেই কাহিনিগুলো যদি অন্তত পরিবারের কাছে পৌঁছানো যেত, তবে হয়তো কোনো মা-বাবা, ভাইবোন বা সন্তান দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটাতে পারত। নিঃসঙ্গ সমাধির আগে একটি পরিচয় পাওয়ার অধিকার প্রতিটি মৃত মানুষের প্রাপ্য।
বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে দুর্ঘটনা, অপরাধ, গুম, আত্মহত্যা কিংবা আর্থসামাজিক বাস্তবতা কাজ করে। কখনো কখনো সমাজের নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ, ভবঘুরে, মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষও মৃত্যুর পর পরিচয়হীন হয়ে যায়। অন্যদিকে, অপরাধের শিকার মানুষদের লাশও গোপনে ফেলে রেখে যায় দুর্বৃত্তরা। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার, যেমন জাতীয় ডাটাবেজ, বায়োমেট্রিক তথ্য ও ডিএনএ ব্যাংক গড়ে তোলা জরুরি। রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু লাশ দাফন করাই নয়, বরং মৃত্যুর আগে এই মানুষগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে একটি শক্তিশালী ডাটাবেজ গড়ে তুলতে পারলে বহু অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি, নিখোঁজদের সন্ধানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আন্তরিকতা ও দ্রুত পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পরিচয়হীন লাশ শনাক্তকরণে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (পিবিআই) সীমিত সক্ষমতার মধ্যেও ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সারাদেশে পিবিআইয়ের ৪৭টি ইউনিট এই কাজে সম্পৃক্ত রয়েছে। তবে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা। বর্তমানে পিবিআইয়ের সব ইউনিট মিলে মাত্র ৬৬টি ডিএনএ ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানিং ডিভাইস রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অধিকাংশ লাশের পরিচয় শনাক্তের জন্য প্রয়োজন আরও উন্নত প্রযুক্তির এবং বৃহৎ ডাটাবেসের। অজ্ঞাত লাশ শনাক্তে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা। নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানে পরিবারগুলোর আরও দ্রুত পুলিশ প্রশাসনের সহায়তা নেওয়া উচিত। একইসঙ্গে, লাশ শনাক্তের জন্য জাতীয় ডাটাবেস শক্তিশালী করা জরুরি। পাশাপাশি, রাষ্ট্রের উচিত প্রতিটি অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্তের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো।
পরিচয়ের অভাবে নিঃসঙ্গ সমাধি : বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রতিদিন, প্রতিমাসে, প্রতিবছর হাজার হাজার লাশ তাদের স্বজনদের কাছে ফেরার সুযোগ পায় না। তারা নিঃসঙ্গভাবে দাফন হয়, কারো অশ্রু ঝরে না, কারো হৃদয় ভাঙে না। অথচ তারা কারো বাবা, কারো সন্তান, কারো স্বামী বা স্ত্রী। দেশের হাসপাতাল, রাস্তা, নদী কিংবা রেলস্টেশনে প্রতিনিয়ত পড়ে থাকে পরিচয়হীন বেওয়ারিশ লাশ। এসব লাশের কেউ নেই, দাবি করার মতো স্বজনও নেই। রাষ্ট্রের নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় তাদের দাফন বা সৎকার করা হয়, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই লাশগুলোর পরিচয় কী? কেন তারা এমন নিঃসঙ্গ মৃত্যুর শিকার?
মানবিক দায়িত্ব ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ: একটি পরিচয়হীন লাশ কেবল সংখ্যা নয়, এটি একটি পরিবারের এক অমূল্য সদস্য, যার অপেক্ষায় কেউ হয়তো পথ চেয়ে আছে। সরকার এবং প্রশাসনের পাশাপাশি সামাজিক সংগঠনগুলোরও এগিয়ে আসা দরকার, যেন অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়। উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও লাশ শনাক্তকরণের জন্য বায়োমেট্রিক তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলা যেতে পারে। আমরা সবাই যদি সচেতন হই, প্রশাসন আরও প্রযুক্তি উন্নয়নে মনোযোগ দেয়, তবে হয়তো অনেক পরিবার তাদের হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনকে ফিরে পাবে, কিংবা অন্তত শেষ বিদায়ের সান্ত¡না খুঁজে পাবে। আমাদের সমাজকে মানবিক ও দায়িত্বশীল করে গড়ে তুলতে হলে বেওয়ারিশ লাশের প্রতি অবহেলা দূর করা জরুরি।
অজ্ঞাত লাশের ব্যাপারে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়- ১. শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ার অভাব: অজ্ঞাত লাশগুলোর অধিকাংশের ক্ষেত্রে পরিচয় শনাক্তকরণে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ বা অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিচয় শনাক্তের প্রচেষ্টা প্রায়ই অনুপস্থিত। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে লাশের ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংরক্ষণ বা ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হলে স্বজনদের খুঁজে পাওয়া সহজ হতো। কিন্তু বাস্তবে, পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এই পদ্ধতি অবলম্বন করে না ২. সরকারি নজরদারির অভাব: অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা বৃদ্ধির পরও সরকার এই বিষয়ে পর্যাপ্ত মনোযোগ দিচ্ছে না বলে মনে হয়। এ ধরনের ঘটনাগুলোর তদন্ত ও প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপের অভাব স্পষ্ট। নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা প্রায়ই পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তেমন কোনো সহায়তা পান না, যা এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে ৩. রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিরোধ: রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিরোধের কারণে অনেকেই হত্যার শিকার হচ্ছেন, এবং তাদের লাশ অজ্ঞাত হিসেবে পড়ে থাকছে। এটি দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ইঙ্গিত বহন করে ৪. মানব পাচার ও গুম: বাংলাদেশে মানব পাচারের একটি বড় চক্র সক্রিয় রয়েছে। অনেক সময় পাচারের শিকার ব্যক্তিরা প্রাণ হারালে তাদের লাশ অজ্ঞাত অবস্থায় ফেলে দেওয়া হয়। এছাড়া গুম হওয়া ব্যক্তিদের অনেকেই হত্যার শিকার হন এবং পরবর্তীতে তাদের লাশ অজ্ঞাত হিসেবে পড়ে থাকে।
পিবিআইয়ের সীমিত সক্ষমতা: পরিচয়হীন লাশ শনাক্তকরণে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (পিবিআই) ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সারাদেশে পিবিআইয়ের ৪৭টি ইউনিট এই কাজে সম্পৃক্ত রয়েছে। তবে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা। বর্তমানে পিবিআইয়ের সব ইউনিট মিলে মাত্র ৬৬টি ডিএনএ ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানিং ডিভাইস রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অধিকাংশ লাশের পরিচয় শনাক্তের জন্য প্রয়োজন আরও উন্নত প্রযুক্তির এবং বৃহৎ ডাটাবেসের।
প্রযুক্তি ও জনসচেতনতা জরুরি : অজ্ঞাত লাশ শনাক্তে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা। নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানে পরিবারগুলোর আরও দ্রুত পুলিশ প্রশাসনের সহায়তা নেওয়া উচিত। একইসঙ্গে, লাশ শনাক্তের জন্য জাতীয় ডাটাবেস শক্তিশালী করা জরুরি। পাশাপাশি, রাষ্ট্রের উচিত প্রতিটি অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্তের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো।
সমাধানের পথে: পরিচয় শনাক্তকরণ: প্রতিটি অজ্ঞাত লাশের ক্ষেত্রে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করা উচিত, যাতে পরবর্তীতে স্বজনদের সাথে মিলিয়ে পরিচয় নিশ্চিত করা যায়। সরকারকে এই বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা হ্রাসে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন, তদন্ত প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে কেউ নিখোঁজ হলে তা দ্রুত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হয় এবং অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্তে সহায়তা করা যায়। নির্জন এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে, নিয়মিত টহল ও সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের মাধ্যমে অপরাধ প্রতিরোধ করা যেতে পারে। অজ্ঞাত লাশের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা আমাদের সমাজের একটি গুরুতর সমস্যা, যা অবিলম্বে সমাধানের প্রয়োজন। সরকার, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
বাংলাদেশে প্রতি মাসেই অসংখ্য লাশ অজ্ঞাত পরিচয়ে হারিয়ে যায়। অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি শুধু আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ইঙ্গিত দেয় না, এটি সামাজিক ও মানবিক সংকটেরও প্রতিফলন। সরকার, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, কার্যকর অনুসন্ধান প্রক্রিয়া, পুলিশি তৎপরতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। যদি এখনই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়, তাহলে এই সংকট আরও গুরুতর আকার ধারণ করবে এবং নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি সাধারণ মানুষের মধ্যে বৃদ্ধি পাবে। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত অতি দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে কেউ আর অজ্ঞাত লাশ হয়ে না পড়ে। আমরা সবাই যদি সচেতন হই, প্রশাসন আরও প্রযুক্তি উন্নয়নে মনোযোগ দেয়, তবে হয়তো অনেক পরিবার তাদের হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনকে ফিরে পাবে, কিংবা অন্তত শেষ বিদায়ের সান্তনা খুঁজে পাবে।
লেখক : সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।