বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে সমস্যা এবং কিছু কথা
রহিম আব্দুর রহিম
পুরাতন পত্রিকা ঘাটছিলাম, ৭ জানুয়ারি জাতীয় দৈনিক ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকার পেছনের পাতায় গুরুত্বসহকারে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়েছিল, যার শিরোনাম "এখনো থামেনি সীমান্ত হত্যা" আজ থেকে ১৪ বছর আগের ঘটনা। কুড়িগ্রামের অনন্তপুর সীমান্তে বিএসএফ'র গুলিতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় কিশোরী ফেলানী। ঘটনাটি ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি। এই বছর ৭ জানুয়ারি ফেলানি হত্যাকাণ্ডের ১৪ বছর পূর্ণ হয়েছে। প্রতিবেদক তার দায়বদ্ধতা থেকে এই রিপোর্ট করেছেন। এটাই সাংবাদিক এর নৈতিকতা।
নিহত ফেলানীর লাশ দীর্ঘ চার ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলছিল, ভয়াবহ অমানবিক কর্মকান্ড! একজন মানুষের এভাবে মৃত্যু ঘটতে পারে না। ফলে ওই সময় দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকায়, এই নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়, প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠে বিশ্বমানবতা। মামলা চলে ভারতের বিএসএফ গঠিত বিশেষ এক আদালতে। যে আদালতের বিজ্ঞ বিচারক অভিযুক্ত বিএসএফ অমিয় ঘোষকে খালাস দেন।পরে নিহত ফেলানীর বাবা ভারতের সুপ্রিম কোটে বিচার চেয়ে মামলা করে। এখনও মামলাটি বিচারাধীন। বিচারাধীন মামলার রায় না পেয়ে ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম তার ক্ষোভ আক্ষেপ তৎকালীন সরকারের উপর ঝেড়ে বর্তমান সরকারের কাছে বিচার চেয়েছেন।
পৃথিবীর কোন সরকারই অন্য কোন দেশের বিচার বিভাগের উপর খবরধারী করতে পারে না। নুরুল ইসলাম এতটা হয়তোবা বুঝতে না পেরে এমনটি বলেছেন। এ অভিযোগ কথার কথা মাত্র। ফেলানীর বাবার পক্ষে দেশ-বিদেশের মানবাধিকার কর্মীদের যিনি সহযোগিতা করেছেন, ভারতের সুপ্রীম কোর্টে যিনি বাদীর পক্ষে এফিডেভিট ফর্মে স্বাক্ষর করেছেন, তিনি হলেন কুড়িগ্রামের অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন। জগণ্য কায়দায় ফেলানিকে বিএসএফ হত্যা করেছে এটা যেমন সত্য, তেমনি ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম পাসপোর্ট ভিসা ছাড়া ভারতের আসামে চায়ের দোকানদারী করতেন এবং তার কোমলমতি মেয়েকে নিজ দেশে ফেরার জন্য যে অবৈধভাবে কাঁটাতার টপকাতে গিয়ে বিএসএফ'র গুলিতে মারা গেছে এটাও সত্য।
ফেলানী অপরাধ করে থাকলে বিএসএফ তাকে ধরে নিয়ে ভারতের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে পারত; সীমান্ত প্রহরি হিসাবে তাদের এটা করাই উচিত ছিল, তা তাঁরা করেনি। যে কারণে প্রতিটি হত্যাকাণ্ডটির ন্যায়বিচার হওয়া উচিত। না হলে কারণে-অকারণে হত্যাকাণ্ড চলতেই থাকবে যা আমরা কখনো চাই না। সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিস্তারিত লেখতে গেলে এক দু'দিনে শেষ হওয়ার কথা নয়। গত ওয়ান ইলেভেন মুঈন-ফকরুদ্দিনের আমলে পঞ্চগড় তেঁতুলিয়ার এক সীমান্তবর্তী এক গ্রামে বিএসএফ এর সদস্যরা প্রবেশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে এক শিশুসহ দুব্যক্তিকে খুন করেছে। যা বিশ্বমানবতায় হৈ চৈ হলেও শেষমেষ কিছুই হয়নি।
গত ১৩ জানুয়ারি দৈনিক খোলা কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক লীড সংবাদ শিরোনাম ছিলো "সীমান্তে আর ছাড় নয়" সংবাদটির সারাংশ, বাংলাদেশ ভারতের কয়েকটি সীমান্তের শূন্যরেখায় ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী (বিএসএফ)'র কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকে কেন্দ্র করে উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়।বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং স্থানীয় জনগণের প্রতিরোধে বিএসএফ বেড়া নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখে। এই নিয়ে ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করে বাংলাদেশ উদ্বেগ প্রকাশ করে, এ বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, "সম্মান এবং সমতার ভিত্তিতে আমরা সবদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চাই।" স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, "সীমান্তে বেড়া ইস্যুতে অসম সমঝোতা চুক্তিগুলো বাতিল করা হবে।" তাঁদের উভয়ের বক্তব্য গঠনমুলক এবং সঠিক।
১৯৭৫ সালের বাংলাদেশ ভারত যুগ্ম সীমান্তবলি অনুযায়ী উভয় দেশের শূণ্যরেখায় ১৫০ গজের মধ্যে কোন উন্নয়নমূলক কাজ করতে হলে, একে অন্যের সম্মতি নিতে হবে। আর তা যদি না হয়, তবে শুধু উত্তেজনা নয়, দুঃখজনক কিছু ঘটে যাবার সম্ভাবনা থাকে। প্রাসঙ্গিক কিছু ইনফরমেশন তুলে ধরছি।ভারত-বাংলাদেশের মোট সীমান্ত এলাকা ৪১৫৬.৫৬ কিলোমিটার (২৫৮২ মাইল), যা বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘতম ভূমি সীমানা, যার ৩ হাজার ২৭১ কিলোমিটার এলাকায় ভারত কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করছে।বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের মধ্যে আসামে ২৬২ কিলোমিটার, ত্রিপুরায় ৮৫৬ কিলোমিটার, মিজোরামে ১৮০ কিলোমিটার, মেঘালয়ে ৪৪৩ কিলোমিটার, পশ্চিমবঙ্গে ২,২১৭ কিলোমিটার। মিজোরামের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত পরিধি দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত ২৭১ কিলোমিটার প্রসারিত মাত্র।
আমরা জানি, ভারতের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত জেলা ৩০টি। এরমধ্যে ময়মনসিংহ বিভাগের ৪টি জেলা যথাক্রমে জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে ৬টি।এরমধ্যে চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, কুমিল্লা, ফেনী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। রাজশাহী বিভাগের ৬টি জেলা হলো, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, পঞ্চগড় নীলফামারী, ঠাকুরগাঁ, জয়পুরহাট ও দিনাজপুর। খুলনা বিভাগের ৬টি জেলা মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও যশোর। আমাদের এই সীমান্ত অঞ্চলে প্রায়ই উত্তেজনা সৃষ্টি, হত্যার ঘটনা ঘটে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বিএসএফের গুলিতে ও নির্যাতনে অন্তত ৬০৭ জন বাংলাদেশী নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া অধিকার নামের একটি মানবাধিকার সংস্থার মতে ২০০৯ থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বিএসএফ সদস্যদের হাতে ৫৮২ জন নিহত হয়েছে এবং ৭৬১ জন আহত হয়েছে।
ভারতের বিএসএফের এমন কর্মকান্ড চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। তবে যারা মারা গেছেন, তাদের প্রায় ৮০ শতাংশ ভারতের অংশে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছে। এতে বুঝা যায়, হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিট প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কোন সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে। সীমান্ত আইন অনুযায়ী হত্যাকাণ্ড বিএসএফ চালাতে পারে না, বিধি অনুযায়ী অপরাধীকে পুলিশে দিতে হবে। তা তারা করেনি। আমি নিজে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী দেশের উত্তর অঞ্চলের জেলা পঞ্চগড়ে কর্মরত ২৩ বছর ধরে। সীমান্ত হত্যাকান্ডের যে কটি কারণ, তারমধ্যে দু'একটা বর্ণনা করছি।তার একটা হলো ভারতের কাঁটাতারের বেষ্টনীর কেঁটে ভারত চলাফেরা, চোরাই পথে গরু আনা নেওয়া, বর্তমানে এই সীমান্তে চা পাতা চুরির বিষয়টি যুক্ত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী পরস্পরের মধ্যে টাকা পয়সার গড়মিল। পাথর বালি উত্তোলন করতে গিয়ে সীমান্তের নো ম্যান ল্যান্ডস আইন লঙ্ঘন। গবাদি পশু-প্রাণি বাংলাদেশ থেকে ভারতে নিয়ে চরানো, এক্ষেত্রে ভারতের বিএসএফ বাঁধা দিতে গেলে তাদের সাথে তর্কাতর্কি, ধাক্কা-ধাক্কি, হাতাহাতিসহ নানাবিধ বিরোধমূলক কাজে লিপ্ত হওয়া।
২০২৩ সালের ১৭ জুন পঞ্চগড় ১৮ বিজিবি' অধিনায়কের সাথে কথা বলে কিছু তথ্য পেয়েছি, যা অবাক হওয়ার মত, পঞ্চগড় সীমান্তের আটোয়ারি ও তেঁতুলিয়া উপজেলায় বাংলাদেশ ভারতের মোট ১৯১টি সীমান্ত পিলার নিঃচিহৃ হয়েছে নদীর তলদেশ থেকে ড্রিলড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর-বালি উত্তোলনের জন্য। নিঃচিহৃ পিলার গুলো হলো, আটোয়ারি উপজেলার নদীডাঙ্গী ১টি, দারখোর ১৪টি, গিরাগাঁও ১, রমজানপাড়া ১০টি, আমতলা ২টি, বোদাপারা ২টি ও কাকপাড়া ২টি। তেতুলিয়া উপজেলা খেকিপাড়া ৩টি, বকশীগঞ্জ ১৪টি, লালটুগজ ৩টি, ময়নাগুড়ি ৪টি, বালাচন্ডী ২টি, পাঠানপাড়া ৩টি, শেখগঞ্জ ৭টি, খাটিয়াগজ ৩টি, মন্ডলপারা ১৩টি, প্রেমচরণজোত ২৭টি, তেলিপাড়া ২টি, সিদ্দিকনগর ৬টি, ঈদগাঁবস্তি ২টি, ডাকবাংলা ৮টি, বারঘরিয়া ১টি, সরদারপাড়া ৩১টি, উত্তর কাশিমগঞ্জ ৩টি, সন্ন্যাসীপাড়া ১০টি, প্রধানপাড়া ১টি বোগলাহাঁটি ২টি, কৃত্তনপাড়া ১টি।
এটা তো একটি অঞ্চলের, বাকী সীমান্তের কি অবস্থা, বা কি হতে পারে? তার একটা গড় হিসাব মিলালে বুঝা যাবে আমাদের দেশপ্রেমের দূরত্ব! যখন কোন মানুষ নো ম্যান ল্যান্ডস, আইন লংঘন করবে, অবৈধভাবে অন্যদেশে প্রবেশ করে পাসপোর্ট আইন ভঙ্গ করবে, তখন কি হতে পারে?এ বিষয়টি সবার দৃষ্টিগোচর হওয়া জরুরি। সীমান্ত হত্যা নিরসনে সারা বাংলাদেশে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালানো জরুরি এবং সীমান্তের মানুষদের মাঝে নো ম্যান ল্যান্ডস সম্পর্কে ব্যাপক সচেনতা বৃদ্ধি করা ও সীমান্তরক্ষীদের ধারা মানবাধিকার লঙ্ঘিত এমন কাজ থেকে নিবৃত্ত করণে উভয় দেশের যৌথ উদ্যোগে গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবী।
লেখক : নাট্যকার ও গবেষক।