উদ্ধারকৃত সাড়ে ১৩ লাখ টাকা পুলিশের পকেটে!
সাতক্ষীরার আলীপুরে ব্যবসায়ী আমীর হামজার ২৩ লাখ টাকা ছিনতাই
রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরা-ভোমরা মহাসড়কের আলীপুর ঢালীপাড়ায় ভোমরার ব্যবসায়ী জিএম আমীর হামজার ২৩ লক্ষাধিক টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত তিন আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত এক আসামি ইসতিহাক আহম্মেদ ওরফে আরাফাত হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমলী প্রথম আদালতের বিচারক নয়ন কুমার বড়াল আজ বৃহস্পতিবার শুনানি শেষে দুই দিনের রিমাণ্ড মঞ্জুর করেছেন।
এদিকে গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের স্বজনদের অভিযোগ, মামলা থেকে স্বজনদের বাঁচানোর জন্য ছিনতাইয়ের সাড়ে ১৩ লাখ টাকা সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থেকে পুলিশ সুপার পদে পদায়নকৃত ও সদ্য সিলেটে পোষ্টিং দেওয়া সজীব খানের কাছে জমা দেওয়া হয়। ওই টাকা মামলার বাদিকে দিয়ে মামলা তুলে নেওয়ার কথা থাকলেও ভাগবাটোয়ারা হয়ে পুলিশের পকেটে চলে গেছে। উপরন্তু রফিকুজ্জামানসহ আসামিদের ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তি করিয়ে চরম ক্ষতি করেছেন।
মামলা ও ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ভোমরা বন্দরের “মা ট্রেডার্সের” স্বত্বাধিকারী জিএম আমির হামজার কর্মচারী (ভাড়ায় চালিত মটর সাইকেল চালক) শওকত আলী ও ওবায়দুল্লাহ ব্যবসায়ীক কাজে গত ১৯ ডিসেম্বর বিকেলে সাতক্ষীরার দুটি ব্যাংক থেকে উত্তোলনকৃত ও তিনজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে আদায়কৃত বকেয়াসহ মোট ২৩ লাখ ৩৮ হাজার ৫০০ টাকা নিয়ে মটর সাইকেলে ভোমরায় ফিরছিলেন। একপর্যাযায়ে বিকাল ৪টা ৫০ মিনিটে আলিপুর ঢালীপাড়া বিদ্যুৎ অফিসের সামনে এলাকায় পৌঁছালে দুটি মটর সাইকেলে পাঁচজন ছিনতাইকারি শওকত হোসেনের মটর সাইকেলের গতিরোধ করে। পরে শওকতের মটর সাইকেলের হ্যা-েলে লোহার রড দিয়ে বাড়ি মেরে ও ওবায়দুল্লাহর মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে। শওকত এবং ওবায়দুল্লাহ রাস্তার উপর পড়ে যায়। এসময় ছিনতাইকারীরা ওবায়দুল্লার কাছে থাকা টাকার ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় সদর উপজেলার নলকুড়া গ্রামের আতাউরের ছেলে মেহেদী হাসান মুন্না নামের একজন ছিনতাইকারীকে আটক করে জনতা পুলিশে সোপর্দ করে। বাকি ৪ ছিনতাইকারী টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় আমীর হামজা বাদি হয়ে কলেজ ছাত্র মেহেদী হাসান মুন্না, এজাজুল ইসলাম, আরাফাত হোসেন ও নয়নকে আসামি করে সাতক্ষীরা সদর থানায় মামলা (থানা মামলা নং-৩৪, জিআর-৫৫৯/২৪ সদর) দায়ের করেন। রফিকুজ্জামানকে এজাহারে নাম দিতে বাধা দেন সদর থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা। তবে সাতক্ষীরা সিটি কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র মেহেদী হাসান মুন্না ২০ ডিসেম্বর বিচারিক হাকিম সুজাতা আমিনের খাস কামরায় ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে নিজে ও রফিকুজ্জামানসহ এজাহারভুক্ত পাঁচজন ছিনতাইয়ে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে।
নলকুড়া গ্রামের এজাজুল হক বাড়িতে ছিনতাইয়ের এক লাখ টাকা রেখে পালিয়ে গেলেও তার বাবা গ্রাম পুলিশ সাঈদুল হক জানতে পেরে মিষ্টি মেম্বরকে সাথে নিয়ে ২৪ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মামলার প্রথম তদন্তকারি কর্মকর্তা সদর থানার উপপরিদর্শক মেহেদী হাসানের কাছে থানায় যেয়ে জমা দেন। ২৫ ডিসেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান সাঈদুল হক।
এদিকে শহরের রসুলপুরের বাস চালক শাজাহান সরদারের দ্বিতীয় স্ত্রী শাহীদা আক্তার ময়না জানান (অডিও ধারণকৃত), রফিকুজ্জামান তার সতীন হামিদা খাতুনের ছেলে। সে স্বেচ্ছাসেবক দল করতো। আলীপুর ঢালীপাড়ায় টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় তার ছেলে রফিকুজ্জামান জড়িত বলে জানতে পারার পর পুলিশ ও তাদের বাড়িতে আসে। তিনি সাতক্ষীরা পুলিশের পদোন্নতিপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সজীব খান ও মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক আহম্মদ কবীরের শরনাপন্ন হন। তাদের কথামত তিনি ও তার স্বামী শাহজাহান সরদার আত্মগোপন করে সিলেটের জাফলং এ থাকা রফিকুজ্জামানের সাথে কথা বলেন। কথা হয় আরাফাত ও নয়নসহ অন্য আসামীদের স্বজনদের সাথে। একপর্যায়ে তিনি রফিকুজ্জামানসহ আসামীদের স্বজনদের মাধ্যমে যোগাড় করা ছিনতাইয়ের ১০ লাখ টাকা স্বামী শাহজাহান সরদারকে সাথে নিয়ে ২৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে যেয়ে সজীব খানের হাতে তুলে দেন। সেখানে গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিজামউদ্দিন, মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা উপপরিদর্শক আহম্মদ কবীর, গোয়েন্দা পুলিশের সদস্য মিঠু চৌধুরীসহ পুলিশের আরো একজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
২৬ ডিসেম্বর একই সময়ে তিনি আড়াই লাখ টাকা নিয়ে একই স্থানে পুলিশ কর্মকর্তা সজীব খানের হাতে তুলে দেন। সজীব খান ও আহম্মদ কবীর টাকা পাওয়ার পর বাদিকে টাকা দিয়ে রফিকুজ্জামানসহ আসামিদের সমঝোতার মাধ্যমে মামলা প্রত্যাহার করে নেবেন বলে আশ্বস্ত করেন। একপর্যায়ে রফিকুজ্জামানকে বাড়িতে আনার ব্যাপারে পরামর্শ নিলে সজীব খান বলেন যে, সে যেনো শহরে না ওঠে। এমনই এক পরিস্থিতিতে পুলিশ রফিকুজ্জামানকে ১৯ জানুয়ারি রাতে কাশেমপুর মালীপাড়ার খোকন মালীর তৃতীয় স্ত্রী সাথী খাতুনের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। খবর পেয়ে স্বামীকে নিয়ে সেখানে যেয়ে পুলিশের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন তারা। ফোন দিলে সজীব খান বলেন, তিনি বিষয়টি দেখবেন। তিনি সিলেটে বদলী হচ্ছেন, দেশের বাইরে তো আর নয়। ১৯ জানুয়ারি রাতে বাড়ি থেকে লক্ষীদাঁড়ি গ্রামের আলিমউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন ২০ জানুয়ারি পুলিশ সুপার তার কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিং শেষে আলিমউদ্দিন ও রফিকুজ্জামানকে আদালতে পাঠান। প্রেস ব্রিফিংএ রফিকুজ্জামানের কাছ থেকে তিন লাখ ৯৩ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে মর্মে বলা হয়েছে। ওই দিন পুলিশের কথামত রফিকুজ্জামান বিচারিক হাাকিম সালাউদ্দিনের কাছে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
জবানবন্দিতে কলারোয়া পৌরসভার মধ্যে জনৈক মুরাদ ও লক্ষীদাঁড়ির আলিমউদ্দিনের নির্দেশনা অনুযায়ি আলীপুর ঢালীপাড়া বিদ্যুৎ অফিসের সামেন শওকতের মটর সাইকেলে রড দিয়ে বাড়ি, ওবায়দুল্লাহকে পিছন দিক থেকে আঘাত করে টাকার ব্যাগ ছিনতাই, ছিনতাইয়ের টাকার মধ্যে ৫ লাখ টাকা ভাগে পাওয়া, গ্রেপ্তারের সময় তার কাছে ৩ লাখ ৯৩ হাজার টাকা থাকা ও এক লাখ টাকা খরচ হয়ে যাওয়াসহ আমীর হামজার টাকা ছিনতইয়ের বিস্তারিত কথা স্বীকার করে। তবে রফিকুজ্জামনকে আদালতের পাঠানোর কিছুক্ষণ পর পুলিশ লাইনে যেয়ে সজীব খানের সঙ্গে দেখা করেও তিনি ছেলেকে বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলে জানান ময়না ও শাহজাহান। ২১ জানুয়ারি দুপুর আড়াইটার দিকে মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা উপপরিদর্শক আহম্মদ কবীরের সাথে টাকা দেওয়ার পরও কেন রফিকুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হলো তা নিয়ে এ প্রতিবেদকের সামনে কথা বলেন ময়না। ২০ জানুয়ারি সাত দিনের রিমাণ্ড আবেদন শুনানি শেষে আদালত দুই দিনের রিমাণ্ড মঞ্জুর করা আলিমউদ্দিনকে তদন্তকারি কর্মকর্তা আহম্মদ কবীর আদালত থেকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে যান। রিমা- শেষে আলিমউদ্দিনকে ২২ জানুয়ারি বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আমলী আদালত-৩ এর বিচারক রাফিয়া সুলতানার কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। বৃহষ্পতিবার দুই দিনের রিমা- মঞ্জুর শেষে আলিমউদ্দিনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি শেষে বুধবার বিকেল ৫টার দিকে কারাগারে পাঠানোর সময় আদালত চত্বরে আলিমউদ্দিন এ প্রতিবেদককে জানান, তিনি ছিনতাইয়ের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও রফিকুজ্জামানসহ কয়েকজন তার নাম অহেতুক জড়িয়েছে। বাধ্য হয়েই তিনি নিজেসহ গ্রেপ্তারকৃত ও পলাতক আসামীদের নাম উল্লেখ করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার রিমা- শুনানী শেষে আরাফাত হোসেন তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার না করেই বলেন, এখন কি আর করার বলেন। টাকা ফেরৎ দিয়ে পুলিশের পরামর্শে ১৯ জানুয়ারি আদালতে আত্মসমর্পণ করেও রেহাই মিলল না।
মামলার বাদি জিএম আমীর হামজা বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া ১২টায় এ প্রতিবেদককে বলেন, রফিকুজ্জামানের কাছ থেকে তিন লাখ ৯৩ হাজার টাকা ও এজাজুলের বাবার কাছ থেকে এক লাখ টাকা উদ্ধারের কথা তিনি জেনেছেন। তবে রফিকুজ্জামানের বিমাতা ময়না খাতুন তার সাথে মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটার দিকে মোবাইলের কথা বলার সময় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সজীব খানের কাছে ঘটনার কয়েকদিন পর সাড়ে ১২ লাখ টাকা দিয়েছেন মর্মে জানিয়েছেন। তার টাকা পাওয়ার বিষয়টি পুলিশের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করছে বলে তিনি মনে করেন।
এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা আহম্মদ কবীরের সাথে বৃহষ্পতিবার দুপুর ১২টা ৩৭ মিনিটে তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তিনি তা রিসিভ করেননি।
সাতক্ষীরা পুলিশের পদায়নকৃত পুলিশ সুপার সজীব খান বলেন, তিনি বদলী হলেও এখনো সাতক্ষীরাতে অবস্থান করছেন। এ পর্যন্ত আমীর হামজার ছিনতাই মামলায় তিন লাখ ৯৩ হাজার টাকা জব্দ করা হয়েছে। রফিকুজ্জামানের বিমাতা ময়না খাতুন তার কাছে কয়েকজন আসামীর কাছ থেকে সংগৃহীত সাড়ে ১২ লাখ টাকা তার (সজীব খান) কাছে দিলেও তা জব্দ দেখানো বা বাদিকে দেওয়া হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বিষয়টি অস্বীকার না করেই বলেন, ময়না কেন এমন কথা বললো তা তিনি তার সাথে কথা বলবেন।
সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলামের সঙ্গে ১২টা ৪১ মিনিটে তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
(আরকে/এসপি/জানুয়ারি ২৩, ২০২৫)