বাইক্কা বিলে বেড়েছে রেকর্ড সংখ্যক পরিযায়ী পাখি, নতুন অতিথি পেরিগ্রিন ফ্যালকন
মো: আব্দুল কাইয়ুম, মৌলভীবাজার : নানা প্রজাতির জীববৈচিত্র আর হাজার হাজার অথিতি পাখি সমৃদ্ধ হাইল হাওরে ১২০ একর জায়গা নিয়ে বাইক্কা বিলের অবস্থান। ২০০৩ সালে সরকার এই বিলকে মিঠাপানির মাছের অভয়াশ্রম ঘোষণা করে। এর পর নয়নাভিরাম এই বিলকে কেন্দ্র করে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আনাগুনা বাড়তে শুরু করে। বর্ষায় দিগন্তজুড়ে অথৈই পানিতে বিল আর হাওরের এক রূপ থাকলেও গীষ্মে ভিন্ন রূপে ধরা দেয় এখানকার মুগ্ধতা ছড়ানো প্রকৃতি। পানিয়ে শুকিয়ে জেগে ওঠে বিলের পাশের সারিসারি হিজল-তমাল। বিলের চারিদিকে জলকেলিতে মত্ত থাকে বিচিত্র নাম আর রঙের হাজারও পরিযায়ী পাখি। তাদের সাথে যুক্ত হয় সাদা বক সহ দেশীয় প্রজাতির পাখিও। যা পর্যটকদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে।
শীতকালে বাইক্কা বিলে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখিরা আসত। দলবেঁধে এখনো আসছে পাখিরা। তবে পাখি যে কমছে তা এখানে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের কাছেও স্পষ্ট। সাধারণত আফরিকা সাইবেরিয়া সহ পৃথিবীর শীত প্রধান দেশগুলো থেকে নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখিরা নিরাপদ আবাস্থল ভেবে অতিথি হয়ে এখানে আসে। নভেম্বর থেকে পাখি আসা শুরু হয়ে মার্চ পর্যন্ত প্রায় পাঁচমাস সময়টাতে বিলের চারপাশে থাকে তাদের অবাধ বিচরণ আর বিলের আকাশে উড়াউড়ি। এবছর পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে পেরিগ্রিন ফ্যালকন নামে বিরল প্রজাতির নতুন এক অতিথির আগমন ঘটেছে বাইক্কা বিলে। এই পাখিটি এশিয়াতে প্রথম দেখা গেছে বলে জানা গেছে পাখি শুমারির তথ্যে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব এর সহায়তায় বাইক্কা বিলের জলচর পাখিদের নিয়ে শুমারি সম্পন্ন করে সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্টাডি (সিএনআরএফ) নামে একটি সংস্থা। শুমারি অনুযায়ী এ বছর পাখির সংখ্যা বেড়েছে বলে জানা গেছে। ওয়াইল্ডলাইফ কনজারবেশন সোসাইটির প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর সামিউল মোহসেনিন ও পাখি বিশেষজ্ঞ ড. পল থমসন এর তত্বাবধানে সম্পন্ন হয় ওই শুমারি। শুমারিতে বিলে ২০২৫ সালে জলচর পাখি গণনায় ৩৮ প্রজাতির ৭ হাজার ৮শত ৭০ জলচর পাখি, ২০২৪ সালে ৩৩ প্রজাতির ৪ হাজার ৬শত ১৫ জলচর পাখি দেখা গিয়েছে। এ বছর উল্লেখযোগ্য ৭শত ৫০ মেটে মাথা টিটি (গ্রে-হেডেড ল্যাপউইং) এবং সর্বোচ্চ সংখ্যক কাস্তেচরা- ৬শত ৩৯ রঙ্গিলা কাস্তেচরা (গ্লসি আইবিস) এবং ১০০ কালা মাথা কাস্তেচরা (ব্ল্যাক-হেডেড আইবিস) দেখা গিয়েছে। ২০০৮-১০ এবং ২০১৪-১৯ সালে প্রতি শীতকালে গড়ে ৯হাজার জলচর পাখি ছিল। সাধারণত পরিযায়ী পাখির সংখ্যা নির্ভর করে জলস্তর, আগের মৌসুমের পরিস্থিতি এবং পরিযায়ন পথের উপর। এই বিলে গড়ে ৫৯ শতাংশ পাখির সংখ্যাই হল পরিযায়ী।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বিলের সামনের দিকে ও ডান পাশে পরিযায়ী পাখিরা অবস্থান করলেও বাম পাশের জায়গাটিতে কোন পাখির দেখা মিলেনি। বিল এবং হাওরের চারপাশে অসংখ্য বাণিজ্যিক ফিসারী গড়ে উঠা সহ শিকারির ভয়ে পাখিদের অবস্থান এমন এলোমেলো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর দর্শনার্থী সহ পর্যটক উপস্থিতিও আগের যেকোন সময়ের তোলনায় অনেকটা কম। তবে সাপ্তাহে শুক্র ও শনিবার বন্ধের দিন হওয়ায় ওই দুদিন দর্শনার্থী সহ পর্যটক উপস্থিতি বেড়ে যায়।
ঢাকা থেকে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা ব্যাংক কর্মকর্তা মো: মাকসুদুর রহমান বলেন, আগে থেকে শুনেছি এখানে প্রচুর অতিথি পাখি আসে সেটার জন্য আসা। এসে দেখলাম পাখি আছে তবে সংখ্যাটা অনেক কম। তার কারনটা বুঝতেছিনা। মানুষ কী আসলে পাখি শিকার করে কী না জানি না। সেটার কারণে পাখি কম হতে পারে। ঝাঁকেঝাঁকে পাখি থাকার কথা এখানে। আমাদের দেশে এখন কম পাখি আসছে এটা আশঙ্কাজনক। পাখিরা তো আগে একটু আরাম পাওয়ার জন্য আমাদের দেশে আসত, এখন হয়তো আমরা তাদের জন্য হুমকি হয়ে গেছি এ জন্য হয়তো তারা কম আসছে। আমাদের পাখিদের উপর সদয় হওয়া উচিৎ যেভাবে মানুষের উপর সদয় হবো। কারণ অন্য দেশ থেকে যখন আমাদের দেশে পাখিরা আসে নিরাপদ ভেবেই আসে। কিন্তু আমরা তাদের সেভাবে নিরাপত্তা দিতে পারছিনা।
নাসরিন আক্তার নামে এক দর্শনার্থী বলেন, শুনেছি এখানে বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক অতিথি পাখি আসে। এ জন্য আসা। এসে ভাল লাগলেও পাখির সংখ্যা কম, তার পর ভাল লেগেছে এখানকার প্রকৃতি। তবে বাচ্চাদের বসার ব্যবস্থা থাকলে আরও ভাল লাগত।
আল আমীন নামে এক দর্শনার্থী বলেন, আগে যেভাবে পাখি দেখতাম সেভাবে দেখতে পারছিনা। এখনো নানা জাতের পাখি আছে তবে কম। আগে বাইক্কা বিল দেখার জন্য মানুষ লাইন ধরতো সে তোলনায় এখন দর্শনার্থীও এখন কম।
বাইক্কা বিল ব্যবস্থাপনার দ্বায়িত্বে থাকা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘বড় গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠন’ এর সাংগঠনিক সম্পাদক মো: খিজির মিয়া পরিযায়ী পাখি কমার বিষয়টি অস্বীকার বলেন, গত বছরের চেয়ে এ বছর পাখি বেড়েছে। পাখি শিকারের বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন আমরা এখন পর্যন্ত শিকারিদের দেখা পাইনি।
খুলনা ও সিলেট অঞ্চলের জীববৈচিত্র নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন সিএনআরএফ এর প্রতিবেশ প্রকল্প সাইট অফিসার মো: মনিরুজ্জামান চৌধুরী জানান, পাখি শুমারিতে গত বছরের তোলনায় এবছর সর্বোচ্চ রেকর্ড সংখ্যক পাখি এসেছে বাইক্কা বিলে। দর্শনার্থী বলছে পাখি কম এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, পাখি কম আর বেশি গবেষণার বিষয়, স্টাডির বিষয় এটা কয়জন স্টাডি করছে। আর পাখি তাঁর নিরাপদ আবাস্থল নে নিজেই খুঁজে নিবে। অনেক সময় দর্শনার্থী থাকলে পাখি থাকেনা, চলে যায় নিরাপদ স্থানে।
(একে/এসপি/জানুয়ারি ২২, ২০২৫)