শিক্ষায় সংস্কার আনলেই টেকসই হবে অন্য সংস্কার
নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত শব্দ ও ব্যবস্থার নাম হচ্ছে সংস্কার। সংস্কারকে ঘিরে বর্তমান সরকার তার যাবতীয় কাজকর্ম এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিছু মানুষ এনিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। আশায় রয়েছে সামনে হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তনের সুবাতাস বইবে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন খাতের সংস্কারের জন্য ১১টি সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি কমিটি তাদের রিপোর্ট প্রদান করেছে সরকারের কাছে। কমিটির প্রস্তাবিত বিষয় নিয়ে মানুষের মাঝে চলছে বিশ্লেষণ। বাকি কমিটিগুলো বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সাথে আলাপ আলোচনা করছে এবং দ্রুত সময়ের মধ্যেই হয়তো সংস্কারের জন্য রুপরেখা উপস্থাপন করবেন। আর এই রুপরেখোর ভিত্তিতে সংস্কার করা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো এই যে সংস্কারের কথা আমরা বলছি সে আসলে কী? সংস্কার আমাদের কতটুকু সফলতা এনে দিবে যদি আমরা সংস্কারের পক্ষে অবস্থান না নেই। কারন এখনও আমাদের দেশের ৮০ ভাগ গ্রামীণ মানুষের এ নিয়ে কোন ধ্যান ধারণা নেই বললেই চলে। তারা চায় পেট ভরে খেতে এবং শান্তিতে ঘুমাতে। তথাপি সংস্কারের প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়ার কোন কোন সুযোগ নেই। কারণ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫৩ বছর পূর্বে। এখনও আক্ষেপে বলে থাকি কি পেলাম এ স্বাধীনতায়।
সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া এ বলার অপেক্ষা থাকে না। স্বাধীনতার সময় আমরা যেভাবে আমাদের ভবিষ্যত নিয়ে ভেবেছিলাম তা আজ অনেকাংশেই সরে গেছে। তখনকার সময়ের মানুষের চাহিদা আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে মানুষের চাহিদার মধ্যে ব্যাপক ফারাক। তাই সাধারণ মানুষ যদি এই সংস্কার সমন্ধে ধারণা না পায় তাহলে বর্তমান সরকারের সংস্কারের চিন্তা সাধারণ মানুষের মাঝে প্রভাব ফেলতে পারবে না। রাষ্ট্রের প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও আধুনিকায়নের প্রক্রিয়া হলো সংস্কার। রাষ্ট্রের মাঝে সুশাসন বৃদ্ধিই এর মূল লক্ষ্য। সুশাসর বৃদ্ধি পেলেই কেবল অন্যান্য কাজ সঠিক পথে এগিয়ে যাবে। সুশাসন বৃদ্ধি পেলেই জনকল্যাণ সাধিত হতে পারে এটা সকলের ধারণা। তবে আজকের আলোচনার বিষয়টি সংস্কারের একটি অংশ নিয়ে। আমরা এতসব সংস্কারের কথা বলছি যে, আমরা মনে করছি জাতি হিসেবে আমরা সভ্য হয়ে গেছি। নীতি নৈতিকতায় একেবারে সভ্যতার চরম উচ্চতায় অবস্থান করছি। কিন্তু পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে হলে যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি জরুরি তা হলো শিক্ষা। আর এই সংস্কারকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে হলে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে শিক্ষা।
সকল সংস্কার টেকসই হওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাহন শিক্ষা এটা মনে হয় আজও আমাদের বুঝতে বাকি রয়েছে। যা আমাদের কর্মকান্ড থেকে অনুমান করা যায়। কিন্তু আমরা অনেক হতাশ হয়েছি যে শিক্ষা সংস্কারের বিষয় নিয়ে আজ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোন নির্দেশনা দেয়া হয়নি। এবং শিক্ষায় সংস্কার নিয়ে কোন প্রকার কমিশন গঠিত হবে কি না তাও পরিষ্কার করা হয়নি। ইতোমধ্যে যেসব সংষ্কার কমিশন গঠিত হয়েছে তার প্রত্যেকটিতেই গুণী লোকদের সন্নিবেশন করা হয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষা আজ কোন পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে তা নিয়ে দায়িত্বশীল লোকদের কোন চিন্তা করার সুযোগ নেই বর্তমান পরিস্থিতি দেখে তাই মনে হয়। বিগত ২৫ বছরের মধ্যে শিক্ষা নিয়ে এত ছেলেখেলা করা হয়েছে যে শিক্ষার মূল লাইনটাই হরিয়েছে ফেলেছে বলে মনে হয়। কোন গবেষণা ছাড়াই শিক্ষা পদ্ধতির যেসব পরিবর্তন করা হয়েছে বারবার যার ফলে শিক্ষার বারোটা বাজানো হয়েছে।
রাজনৈতিক কারণে বারবার এ ব্যবস্থার মধ্যে পেরেক মারা হয়েছে। বিভিন্ন সময় এসব পরিবর্তনের নামে লোটপাট করা হয়েছে অর্থ। শিক্ষার অনেক কমিশন গঠিত হলেও এর রিপোর্টের কোন কিছুই বাস্তবায়ন করা হয়নি কখনও। যার যখন যেটুকু প্রয়োজন হয়েছে তাই করেছে। যখন নতুন কোন পদ্ধতি আনা হয় তখন সে পদ্ধতিকে সময় না নিয়েই আবার নতুন ব্যবস্থা আনা হয়েছে। আর যারা এসব ব্যবস্থা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করবেন তাদের কোন প্রশিক্ষণ না দিয়েই এ ব্যবস্থা শিক্ষকদের উপর চাপানো হয়েছে। এছাড়াও শিক্ষকদের জীবনমানের উন্নন না ঘটিয়ে কেবলমাত্র দায়সারা কাজটা করেছে সরকারে থাকা মানুষগুলো। বারবার একটি কথাই বলা হয়েছে সরকারের আর্থিক সীমাবদ্ধতা। সরকার সবসময় শিক্ষা খাতের বরাদ্ধকে ব্যয় হিসেবেই দেখিয়ে আসছে। কখনও চিন্তা করে নাই যে এটা রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। হ্যাঁ এটা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই যে শিক্ষা ব্যবস্থায় অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দালানকোঠা বেড়েছে।
বর্তমান সময়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় কেবলমাত্র শিক্ষার্থী বাড়ানো এবং পাস করিয়ে দেয়ার প্রতি এত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে, তাতে করে জানার জায়গাটা শিক্ষার্থীর কাছে অর্থহীন হয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষা ব্যবস্থায় চাকুরির বাজারে সরকারি চাকুরিকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায় শুরু হয়েছে অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাকে যুগোপোযোগি করার জন্য বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোন প্রকার সঠিক ভূমিকা নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট মানুষের দাবী ছিল শিক্ষায় সংস্কারের। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন প্রকার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি বা সংস্কারের কোন আশাই দেওয়া হয়নি। শিক্ষায় সম্পৃক্ত মানুষের ধারণা এ ক্ষেত্রে হয়তো সহসাই কোন আলোর মুখ দেখা যাবে না। গুরুত্বের বিবেচনায় যতক্ষণ এ সমস্যাটা অগ্রাধিকার দেওয়া যাবে না ততক্ষণ এসব সংস্কার নিয়ে আলোচনা করাই অবান্তর। বর্তমান সরকার এটা বিবেচনায় নিয়ে বাকি সময়ে এব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করবে এটা সকলের প্রত্যাশা।
লেখক :শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক।