ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন লেনদেনের জনপ্রিয়তা ও নির্ভরযোগ্যতা বেড়েছে। একদিকে এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে সহজতর করছে, অন্যদিকে অসাধু ব্যক্তিরা এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে প্রতারণা করছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি ক্ষেত্র হলো "অনলাইনে লোন" বা ঋণ প্রদানের নামে প্রতারণা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। ২০২৪ ও ২০২৫ সালে এই সমস্যা মোকাবিলায় ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং সরকারি পর্যায়ে সচেতনতা ও পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

অনলাইনে লোন প্রতারণার প্রকৃতি ও কার্যপ্রণালী

অনলাইনে লোন প্রতারণার মূল কৌশলগুলো হলো: প্রলোভনমূলক বিজ্ঞাপন: অসাধু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম এবং ওয়েবসাইটে "তৎক্ষণাৎ ঋণ" বা "নিরাপদ অনলাইন লোন" প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়।

সহজ শর্তের প্রতিশ্রুতি: এসব বিজ্ঞাপনে কম সুদে, কোনো জামানত ছাড়াই ঋণ দেওয়ার কথা বলা হয়।

ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ: ঋণের আবেদন করতে গিয়ে ব্যবহারকারীর কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর, মোবাইল নম্বর এবং অন্যান্য সংবেদনশীল তথ্য চাওয়া হয়।

অগ্রিম অর্থ দাবি: লোন প্রক্রিয়াকরণের ফি বা প্রসেসিং চার্জের নামে অগ্রিম অর্থ চাওয়া হয়। টাকা নেওয়ার পর তারা আর সাড়া দেয় না।

ফিশিং ও ডেটা চুরি: অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া ওয়েবসাইট বা অ্যাপ তৈরি করে ব্যবহারকারীর আর্থিক তথ্য চুরি করা হয়।

বাংলাদেশে এর প্রভাব

বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে অনলাইনে লোন প্রতারণার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রতারণার ফলে:

ব্যক্তিগত আর্থিক ক্ষতি: প্রতারিত ব্যক্তি তাদের জমানো টাকা হারাচ্ছেন।

মানসিক চাপ: প্রতারণার শিকার ব্যক্তিরা আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তায় আস্থা হারানো: এমন ঘটনার ফলে সাধারণ মানুষ অনলাইন লেনদেনে আস্থা হারাচ্ছেন।

অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি: এসব প্রতারণার মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ সন্ত্রাস বা অন্যান্য অবৈধ কাজে ব্যবহৃত হতে পারে।

প্রতিরোধে ব্যক্তিগত সতর্কতা

১. বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানের সেবা গ্রহণ: অনলাইন লোন নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটির আইনগত অনুমোদন এবং বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করা উচিত।

২. ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা: অজানা ওয়েবসাইট বা অ্যাপের মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

৩. অগ্রিম অর্থ প্রদানে সতর্কতা: কোনো প্রতিষ্ঠান অগ্রিম অর্থ চাইলে সেটি প্রতারণার একটি লক্ষণ হতে পারে।

৪. প্রলোভন এড়ানো: অত্যধিক সহজ শর্তের ঋণ প্রস্তাবে প্রলুব্ধ হওয়া উচিত নয়।

৫. ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধি: প্রতারণামূলক লিংক, মেসেজ বা ওয়েবসাইট চেনার জন্য ডিজিটাল জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন।

সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি

১. গণমাধ্যমের ভূমিকা: টেলিভিশন, রেডিও, এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে জনগণকে এ ধরনের প্রতারণার ব্যাপারে সচেতন করা জরুরি।

২. সেমিনার ও কর্মশালা আয়োজন: বিভিন্ন পর্যায়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ে সেমিনার এবং কর্মশালা আয়োজন করা যেতে পারে।

৩. প্রশিক্ষণ কর্মসূচি: বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় ডিজিটাল সুরক্ষা নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।

৪. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অন্তর্ভুক্তি: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাইবার নিরাপত্তার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়া উচিত।

সরকারি ও আইনগত পদক্ষেপ

২০২৪ এবং ২০২৫ সালে অনলাইনে লোন প্রতারণা প্রতিরোধে সরকারি উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে কিছু প্রস্তাবনা:

১. সাইবার আইন প্রয়োগ: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।

প্রতারকদের দ্রুত শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া।

২. বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন: অনলাইন প্রতারণা রোধে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে।এটি প্রতিনিয়ত অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর নজরদারি করবে।

৩. লোন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন: সব অনলাইন লোন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে সরকারের কাছে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা। নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা।

৪. জনগণের অভিযোগের প্ল্যাটফর্ম: অনলাইন প্রতারণা সংক্রান্ত অভিযোগের জন্য একটি কেন্দ্রীয় হেল্পলাইন বা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা। দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানোর ব্যবস্থা রাখা।

৫. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: অনলাইনে প্রতারণা প্রায়ই আন্তর্জাতিক চক্রের মাধ্যমে সংঘটিত হয়। তাই অন্যান্য দেশের সাইবার নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা দরকার।

প্রযুক্তিগত সমাধান

১. ফিশিং শনাক্তকরণ প্রযুক্তি: উন্নত ফিশিং শনাক্তকরণ সফটওয়্যার ব্যবহার করা। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) প্রযুক্তি দিয়ে ভুয়া ওয়েবসাইট ও বিজ্ঞাপন চিহ্নিত করা।

২. ব্যাংকিং নিরাপত্তা জোরদার: অনলাইন লেনদেনের জন্য দ্বি-স্তরীয় নিরাপত্তা (Two-Factor Authentication) বাধ্যতামূলক করা। নিয়মিত সিস্টেম আপডেট এবং নিরাপত্তা প্যাচ ব্যবহার।

৩. এডুকেশনাল অ্যাপ্লিকেশন: সাধারণ জনগণের জন্য সহজে বোঝার মতো সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক অ্যাপ তৈরি করা।

পরিশেষ বলতে চাই, ২০২৪ এবং ২০২৫ সালে অনলাইনে লোন প্রতারণা রোধে ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং সরকারি পর্যায়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। প্রযুক্তির সুফল পেতে হলে এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই একমাত্র উপায়। প্রতিটি নাগরিককে সচেতন হতে হবে এবং সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। সমাজের প্রতিটি স্তরে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো গেলে অনলাইনে লোন প্রতারণার মতো অপরাধ রোধ করা সম্ভব হবে। এভাবে আমরা প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে একটি নিরাপদ ডিজিটাল সমাজ গড়ে তুলতে পারব।

লেখক: কলাম ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।