চৌধুরী আবদুল হান্নান


সমাজে বিদ‍্যমান রেষারেষি, সংঘর্ষ, পরস্পরকে দোষারোপ এবং অসহিষ্ণুতার মাঝে সমকাল পত্রিকায় সম্প্রতি প্রকাশিত একটি খবর প্রীতির বার্তা দিলো। খবরে প্রকাশ, লালমনিরহাট শহরের কালীবাড়ি এলাকায় একই আঙিনায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে মসজিদ ও কালীমন্দির।মসজিদে চলে নামাজ আদায়, মন্দিরে চলে পূজা-অর্চনা। কোনো বিবাদ, মতোবিরোধ ছাড়াই যুগ যুগ ধরে সেখানে ধর্মীয় সহাবস্হান বিরাজ করছে।

মন্দিরের সভাপতি ও পুরোহিত শংকর চক্রবর্তী বলেন, ”নামাজের সময় উলুধ্বনি ও বাদ‍্যযন্ত্র বন্ধ থাকে, অন‍্য সময় স্বাভাবিক নিয়মে ধর্মীয় কাজ করে থাকি। ভোগ অনুষ্ঠানে মসজিদের ইমাম ও এলাকার মুসুল্লিদের নিমন্ত্রণ করা হয়। আমরা দুই সম্প্রদায়ের লোক খুব ভালো আছি।”

মসজিদের ইমাম ক্কারী রফিকুল ইসলাম বলেন, ”যুগ যুগ ধরে বহমান রয়েছে ধর্মীয় এই সম্প্রীতি, এটাই হচ্ছে ইসলামের সৌন্দর্য। আমরা এটাকে ধারণ ও লালন করতে চাই।”

বিবাদ বিসম্বাদ যেখানে আমাদের নিত‍্যসঙ্গী, সেখানে লালমনির হাটের হিন্দু-মুসলিমদের এমন চমৎকার সম্প্রীতি আমাদের যারপরনেই মুগ্ধ করে।

সব ধর্মের মূলবাণী এক, তবু কেন আন্তঃধর্মীয় দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে? প্রতিটি ধর্মের মানুষ যদি নিজ নিজ ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে, ক্ষতি কী? তবে কেবল কর্মের মাধ‍্যমেই অন‍্যদের কাছে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করতে হবে।

বাংলাদেশটার জন্ম হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে। কিন্ত স্বাধীনতা লাভের পরও ধর্মীয় সংখ‍্যালঘু বিশষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি, স্থাপনা আক্রান্ত হতে দেখা গেছে।

শান্তিপ্রিয় হিন্দুদের অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চলে গেছেন, তাদের নীরব দেশত‍্যাগ আজও চলছে।

স্বনামধন‍্য সাংবাদিক প্রয়াত আবদুল গফ্ফার চৌধুরীর একটি লেখা থেকে যানা যায়, ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) হিন্দু জনসংখ‍্যা ছিল ২৮ শতাংশ, বর্তমানে তা ৮ শতাংশের নিচে।সংখ‍্যালঘুদের দেশত‍্যাগের আর একটি বড় কারণ হচ্ছে—হিন্দুদের জায়গাজমি দখল করে নেওয়ার জন‍্য পার্শ্ববর্তী প্রভাবশালীদের অনবরত ভয়ভীতি প্রদর্শন।

অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়তে মূল ও প্রধান ভূমিকা কাদের? বাংলাদেশের সংখ‍্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী, জনসংখ‍্যার ৯০ শতাংশের অধিক। সেক্ষেত্রে সম্প্রীতির দেশ গড়তে মুসলমানদেরই মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে।

ইসলাম ধর্ম কখনই সাম্প্রদায়িকতা শেখায় না, এর মূলবাণী মানবতা ও সমগ্র মানব সভ‍্যতাব জন‍্য প্রযোজ‍্য। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মহানবী (স) চাইলে মক্কা বিজয়ের পর সেখানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করতে পারতেন কিন্ত তিনি তা না করে সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার ও সম্মান নিশ্চিত করেন।

মহানবী (স) এর উদারতা ও মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে যুগে যুগে মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার বহু নজির রয়েছে। ইসলাম ধর্ম প্রচারের সূচনাকালে নবীজীর মদিনায় হিজরতের অব‍্যবহিত পরের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যায়।

একটি নতুন ধর্ম সম্পর্কে কৌতুহলী হয়ে খ্রিস্টান ধর্মের একটি দল ইসলাম ধর্ম ও এর প্রচারক সম্পর্কে জানার জন‍্য মদিনায় এসেছিলেন। তাদের সান্ধ‍্য উপাসনার সময় হলে তারা মদিনা মসজিদেই উপাসনা করার অনুমতি চাইলেন। এদিকে মুসলমানদেরও মাগরিবের নামাজের সময় সমাগত। কাজেই মুসলিম সাহাবাদের অনেকেই খ্রিস্টানদের সেই প্রস্তাবে আপত্তি তুললেন। কিন্ত হযরত মুহাম্মদ (স) সে আপত্তি শুনলেন না; মুসলমানদের পবিত্র মসজিদের ভিতরেই তিনি খ্রিস্টাদের উপাসনা করার অনুমতি দিলেন। খ্রিস্টানরা পূর্বদিকে মুখ করে খ্রিস্টান প্রথায় তাদের উপাসনা করলেন এবং মুসলমানরা কাবার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিজেদের নামাজ আদায় করলেন।

ইসলাম ধর্মের এমন মাহাত্ম‍্য ও অন‍্য ধর্মের মানুষের প্রতি হযরতের এমন শ্রদ্ধাবোধ দেখে খ্রিস্টানগণ একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলেন এবং পরবর্তীতে দলের সবাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এভাবেই মরুর দেশ সৌদি আরবের মক্কা-মদিনা থেকে ইসলাম ধর্মের জ‍্যোতি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে।

কিন্ত আজ আমরা কী দেখছি? যে ধর্ম এমন শান্তি-সম্প্রীতি শেখায় সে ধর্মের কিছু পথভ্রষ্ট মানুষ ভিন্ন মতের এবং ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি বা মুক্তমনা মানুষের প্রতি সহিংস হতে দেখা যায়। মুসলমান বা আরবি নামধারী ব‍্যক্তি মাত্রই টেরোরিস্ট হতে পারে- এমন সন্দেহ এখন আমেরিকা ও ইউরোপে বিরাজমান। ইসলামকে একটি সন্ত্রাসী ধর্ম হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার প্রবণতা রয়েছে।

বাংলাদেশ তাবলীগ জামায়াতের দুটি অংশের মধ‍্যে টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ৪ জন মুসুল্লির প্রাণহানি ও অর্ধশত আহত হওয়ার ঘটনা নিজ ধর্মের মধ‍্যে সহিংস কর্মকান্ডের ঘটনা আরও একটি খারাপ উদাহরণ। সংঘর্ষের ভিডিওতে দেখা গেছে, প্রবীণ মুসুল্লিরা কীভাবে ভয়ঙ্কর মূর্তিতে সর্বশক্তি দিয়ে একে অপরকে আঘাত করছেন।

ইসলামী পোষাক পায়জামা-পানজাবি পরিহিত টুপি-দাড়ির লোক দেখে যদি কেউ প্রাথমিকভাবে তাকে জঙ্গীগোষ্ঠীর লোক মনে করে, তাহলে কি দোষ দেওয়া যাবে ?

প্রশ্ন উঠতেই পারে, যারা নিজ ধর্মের মানুষের মধ‍্যে সৌহার্দ বজায় রাখতে পারেন না, তারা কীভাবে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখতে ভূমিকা রাখবেন?

তা হলে পথ কী? যারা ইসলাম ধর্মের মূল শিক্ষা থেকে পথভ্রষ্ট অথচ ধর্ম বিষয়ে ওয়াজ-মাহফিল নিয়ে অতি ব‍্যস্ত, তাদের চিহ্নিত করে সংশোধনের ব‍্যবস্হা নিতে হবে। ইসলাম ধর্মের নেতৃত্বে থাকবেন তারা যারা প্রকৃত অর্থেই জ্ঞানী, কেবল ধর্ম বিষয়ে জ্ঞানী নন।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব‍্যাংক।