রিপন মারমা, রাঙ্গামাটি : একসময় মুয়াজ্জিনের আজানের সুমধুর সুরের ডানায় ভর করে নেমে এসেছে সকাল। পুবাকাশে উঁকি দেওয়া মিষ্টি লাল সূর্যের আভা গায়ে মেখে, পাহাড়ি জনপদের নিভৃত পল্লির পথে হেঁটে যেতো শতশত শিশু। ঘুমের রেশ ফুটে থাকতো তাদের চোখে-মুখে। গায়ে পাজামা-পাঞ্জাবি, বুকে শ্রদ্ধায় জড়ানো রেহাল-কায়দা নিয়েই প্রবেশ করতো দ্বীনি শিক্ষাকেন্দ্র খ্যাত মক্তবে।

এছাড়া বাংলার পথে-ঘাটে ভোরের পাখিদের সঙ্গে সঙ্গে মক্তবগামী কোরআনের পাখিদের দেখা মিলত। মুসলিম পরিবারে শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষা কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত-সহ ধর্মীয় মাসয়ালা-মাসায়েল শেখার অন্যতম ব্যবস্থা ছিলো এটি।

কিন্তু কালের বিবর্তন, আধুনিকতা ও দ্বীনহীনতার ছোবলে হারিয়ে যাচ্ছে মুসলিম সমাজে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য সকালের মক্তবগুলোতে শিশুদের আরবী শিক্ষা। প্রতিদিন ভোরে কিংবা সকালে শীত অথবা গ্রীষ্মে সূর্য তার আলোক রশ্মি ছড়ানোর আগেই গ্রামাঞ্চলের আঁকাবাঁকা মেঠো পথ দিয়ে আরবী শিক্ষার জন্য ছোট ছোট শিশুরা দল বেঁধে মসজিদ, মাদ্রাসা কিংবা ছোট পরিসরে গড়ে ওঠা মক্তব্যগুলোতে যাওয়ার পরিবেশ নানা কারণে এখন আর চোখে পড়ে না। সবই এখন প্রযুক্তির যুগে অনেকটাই অতীত।

শহর-গ্রাম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মুসলিম শিশুদের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় পাঠশালা মক্তব। বিশ্লেষকরা বলছেন, কালক্রমে মানুষের শিক্ষাচিন্তার পরিবর্তন ঘটেছে। মক্তবে সুপরিকল্পিত পাঠপদ্ধতি না থাকার কারণে অভিভাবকরাও মক্তবমুখী হচ্ছেন না। তারা বাসায় আলাদা শিক্ষক রেখে সন্তানকে আরবি পড়াচ্ছেন। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মক্তব শিক্ষায়। ফলে কোথাও মক্তব উঠেই যাচ্ছে, কোথাও চলছে ছন্দ ছাড়া তালে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এর সমাধান হিসাবে তারা বলছেন, মক্তব শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং আধুনিকীকরণ করতে হবে।

মক্তব একটি আরবী শব্দ এর শাব্দিক অর্থ পাঠশালা। শিশুদের কোরআন শিক্ষা এবং ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করা মুসলিমদের জন্য ফরয। এখানে শিশুরা কোরআন তেলাওয়াতের পাশাপাশি নামাজ, রোযা অন্যান্য মাসালাহ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করবে। বর্তমান প্রজন্মের শিশুদের অভিবাবকদের অবহেলার কারণে মসজিদের ইমামগণ মক্তব শিক্ষায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। যার কারণে এলাকার ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে ইসলামী শিক্ষায়।

পার্বত্য জেলা রাঙামাটির লংগদু উপজেলার কয়েকটি গ্রামের মসজিদ-মাদ্রাসায় খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, আগের মতো করে খুব কম মসজিদ মাদ্রাসায়ই মক্তবে শিক্ষা দেয়া হয়।

সম্প্রতি এ ব্যাপারে কথা হয় লংগদুর মদিনাতুল উলুম হেফজ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা ও পরিচালক মাওলানা মামুনুর রশীদের সাথে। কেন হারিয়ে যাচ্ছে মক্তব এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এলাকার অভিবাবকরা শিশুদেরকে সকালে কোচিং করানোর জন্য এবং মর্নিং শিফটের স্কুল থাকায়ই আজ ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা ফরয থাকা সত্ত্বেও এ প্রজন্ম ইসলামী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘মুসলিম শিশুদের ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের প্রথম পাঠশালা মক্তব। মক্তব হারিয়ে যাওয়া মানে মুসলিম শিশুদের ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের প্রাথমিক ও সহজ পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া। সবাই এগিয়ে এলে আশা করি আবার মক্তব শিক্ষার জাগরণ তৈরি হবে।’

অনিয়ন্ত্রিতকিছু কিন্ডার গার্ডেনের জন্যই শিশুদের মক্তব হারিয়ে যাওয়ার কারণ মনে করেন অনেকে। এলাকার প্রতিটি মসজিদ মাদ্রাসা কমিটি সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিলেই শিশুরা ধর্মীয় শিক্ষায় সুশিক্ষিত হয়ে উঠতে পারবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন সূত্র জানান, শিশুদের জন্য মক্তব শিক্ষাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। বর্তমান সময়ের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা থেকে মক্তব শিক্ষা অনেক কার্যকর। মক্তবে শিশুদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দিয়ে বাচ্চাদের ভিত্তি মজবুত করা হয়।

সূত্র আরও জানায়, তথ্যপ্রযুক্তির অনিরাপদ ব্যবহারের কারণে বাচ্চারা দেরি করে ঘুমায়। মোবাইল গেইম, মর্নিং শিফটে স্কুলের কারণে অনেক শিশু মক্তবে যেতে পারেনা। তবে বর্তমানে মক্তবে দক্ষ প্রশিক্ষক অনেকাংশে না থাকায় এর প্রতি মানুষের একটা অনীহা চলে আসছে।

আবার শিশুদের হাতে উঠুক কায়দা-কুরআন। সকালবেলা তারা ছুটুক মক্তবে। ইমানের প্রথম পাঠ গ্রহণ করুক নিরাপদ আশ্রয়ে। আজকের শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। তাদের হাতেই রচিত হবে নতুন প্রজন্মের ভাগ্য। এমনটাই আশা করছেন সচেতন মহল।

(আরএম/এএস/জানুয়ারি ১৭, ২০২৫)