অশনিসংকেত দেখছেন ব্যবসায়ীরা
শিল্পে গ্যাসের দাম ১৫২ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব
স্টাফ রিপোর্টার : দিন যত যাচ্ছে, ততই যেন চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি এসে হাজির হচ্ছে দেশের শিল্পোদ্যোক্তাদের সামনে। এমনিতেই ডলার সংকট, আমদানি কড়াকড়ি, উচ্চ সুদহার, ৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, একের পর এক হামলা-মামলার ভয়ে বাজারে বিনিয়োগ থেকে পিছটান দিচ্ছেন বহু ব্যবসায়ী; তারওপর এবার নতুন করে শিল্পক্ষেত্রে গ্যাসের দাম নতুন করে ১৫২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যেখানে আগে থেকেই বাড়তি দর পরিশোধ করেও চাহিদা মোতাবেক গ্যাস পাচ্ছে না শিল্প-কারখানাগুলো, সেখানে আবার নতুন করে জ্বালানিতে আড়াইগুণেরও বেশি খরচ বৃদ্ধির শঙ্কায় ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের মুখ।
সরকারের এ উদ্যোগকে শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রের জন্য অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন অনেকেই। তারা বলছেন, গ্যাসের দামবৃদ্ধির এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে আর কোনো নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে না। মুখ থুবড়ে পড়বে দেশের শিল্প খাত। অদূর ভবিষ্যতে বিনিয়োগের অভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে এ খাতের সব সম্ভাবনা। কর্মসংস্থানের পথ বন্ধ হয়ে প্রকট আকার ধারণ করবে বেকারত্ব।
শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, শিল্প খাতে বিদ্যমান সংকটগুলোর সমাধান না করেই গ্যাসের এমন অস্বাভাবিক দামবৃদ্ধিতে শুধু দেশি উদ্যোক্তারাই নন, নিরুৎসাহী হবেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও। ফলে সঙ্কুচিত হয়ে যাবে শিল্প খাত, যার বড় ধরনের একটা প্রভাব পড়বে রপ্তানিশিল্পে।
এমনিতেই জুলাই বিপ্লবের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা, বাজার অস্থিতিশীলতা, সুদহার বৃদ্ধি, ঋণপত্র না খোলায় কাঁচামালের অপর্যাপ্ততা, শ্রমিক অসন্তোষ ও উৎপাদন অপ্রতুলতায় বন্ধ হয়ে গেছে দেশের বহু কল-কারখানা। যেগুলো টিকে আছে সেগুলোও অস্তিত্ব সংকটে ধুঁকছে। এমন বস্থায় গ্যাসের দাম আড়াই গুণ বৃদ্ধির উদ্যোগ শিল্প খাতকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
গ্যাস সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মূলত ভারী শিল্প। বড় অঙ্কের বিনিয়োগ থাকে এসব শিল্পে। এ খাতে ধস নামলে একদিকে যেমন ঋণখেলাপি হবেন মালিকরা, অন্যদিকে কর্মসংস্থান হারাবেন অসংখ্য লোক।
এরই মধ্যে দেশের শিল্পকারখানাগুলোর বড় একটি অংশের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বহু লোক চাকরি হারানোয় যেমন বেড়েছে বেকারত্ব, তেমনি বেড়েছে অপরাধের মাত্রা। এখন নতুন করে শিল্পের ওপর চাপ এলে, দেশের শিল্প খাতে রীতিমতো ধস নামবে। ভুল বার্তা যাবে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে; অন্য গন্তব্যে চলে যাবেন তারা।
এদিকে এরই মধ্যে গ্যাসের নতুন দরের নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। প্রস্তাবটি এখন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) রয়েছে। প্রস্তাব অনুসারে, নতুন কারখানার জন্য গ্যাসের দাম হবে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি ব্যয়ের সমান। ফলে, নতুন কারখানাগুলোকে বর্তমান দরের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি দামে গ্যাস কিনতে হবে। পুরাতন শিল্প-কারখানাগুলোকেও লোড বাড়াতে চাইলে গুনতে হবে এ আড়াইগুণ মূল্য।
বর্তমানে শিল্প-কারখানার গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাস কিনতে ৩০ টাকা এবং ক্যাপটিভ পাওয়ারে (শিল্পে ব্যবহৃত নিজস্ব বিদ্যুৎ) ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা দিতে হয়। সবশেষ গত ৬ জানুয়ারি বিইআরসিকে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে প্রতি ঘনমিটারে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে পুরো গ্যাস বিল হবে নতুন দামে। পুরনোদের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় থাকছে প্রস্তাবে।
উদ্যোক্তাদের দাবি, নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহের কথা বলে দুই বছর আগে শিল্পের গ্যাসের দাম ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত শিল্পে গ্যাস সংকট কাটেনি; বরং গ্যাস সংকটের কারণে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় গ্যাসের দাম আবার আড়াই গুণ বাড়ানো হলে শিল্পে বিনিয়োগ পুরো বন্ধ হয়ে যাবে।
শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, এসব কর্মকাণ্ড রীতিমতো শিল্প ধ্বংসের লক্ষণ। এর পেছনে কোনো চক্রের ষড়যন্ত্রও থাকতে পারে। এ ধরনের কোনো অপচেষ্টা থাকলে সরকারে উচিত যেকোনো মূল্যে তা থামানো।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, সরকারের এসব সিদ্ধান্ত দেখে মনে হচ্ছে, উদ্যোক্তারা উৎপাদন থেকে সার্ভিস সেক্টরে চলে যাবে। ম্যানুফ্যাকচারিং খাত বাংলাদেশে থাকুক, এই সরকার সেটি চাচ্ছে না। এই দেশে যেহেতু বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যা, তাই ম্যানুফ্যাকচারিং খাত ছাড়া বিকল্প চিন্তা করাটাই ভুল সিদ্ধান্ত আমাদের অর্থনীতির জন্য।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এ প্রস্তাব পাস হলে শিল্পায়ন থমকে যাবে। নতুন করে বিনিয়োগ আসবে না। বর্তমানের দরটাই অনেক বেশি। তার ওপর চাহিদার তুলনায় অনেক কম গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে এখনই আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে কষ্ট হচ্ছে।
এই যখন অবস্থা, তখন ব্যবসায়ীরা আড়াইগুণ বাড়তি দাম পরিশোধ করেও চাহিদা মোতাবেক গ্যাস পাবেন কি না, সে নিশ্চয়তা দিতে পারছে না পেট্রোবাংলা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাসের দাম বাড়লেও সরবরাহ তেমন বাড়বে না। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন ক্রমেই কমছে। এটা শিগগিরই খুব বেশি বাড়ানোর সুযোগ নেই। এলএনজি থেকে সর্বোচ্চ আমদানির সক্ষমতা ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। নতুন এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ না হলে আমদানি আর বাড়ানো যাবে না। আগামী দুই বছরেও নতুন টার্মিনাল চালুর তেমন সম্ভাবনা নেই। টার্মিনাল নির্মাণে কোনো চুক্তি হয়নি। উপর্যুপরি, আওয়ামী লীগ আমলে হওয়া একটি চুক্তি বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গ্যাসের যে উচ্চমূল্য ধরা হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা যদি এই মূল্যে টাকা দেনও, তাও কিন্তু জ্বালানির নিশ্চয়তা দেওয়া এই সরকারের পক্ষে সম্ভব না। কারণ ব্যবসায়ীরা বিল দেবেন টাকায়, সরকারকে জ্বালানি আমদানি করতে হবে ডলারে। সরকারের কাছে ডলারের সংকট রয়েছে।
এদিকে কবে নাগাদ শিল্পক্ষেত্রে গ্যাসের নতুন দাম কার্যকর হতে যাচ্ছে সে ব্যাপারে বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, পেট্রোবাংলার মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবটি এসেছে। নিয়ম অনুযায়ী সেটি পর্যালোচনা করতে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হবে। তারপর শুনানির মাধ্যমে এটি করা হবে।
(ওএস/এসপি/জানুয়ারি ০৮, ২০২৫)