উজ্জ্বল হোসাইন, চাঁদপুর : নাম গোপন রেখে জাহাজে চাকরি নেয়ার কারন নৌ পুলিশকে জানালেন ইরফান (২৬)। এরমধ্যে তদন্তে তার এলাকার জীবনের পেছনের নানান বিতর্কিত কর্মকান্ড উঠে এসেছে।

২৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে সাংবাদিককে এ তথ্য জানিয়েছেন চাঁদপুর নৌ পুলিশ সুপার কার্যালয়ের উপ-পরিদর্শক শেখ আব্দুস সবুর।

তিনি বলেন, রিমান্ডে ইরফান জানিয়েছে সে ভৈরবে নৌযানে কাজ করাকালীন ওখানে কলেমা পড়ে মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। মূলত তার পেছনের জীবনের ছোটখাটো অপরাধমূলক কাজকে আড়ালে রেখে ভালো ছেলে হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতেই ইরফান নাম দিয়ে জাহাজে খালাসী পদে চাকরী নেয়। তবে তার আইডি কার্ডে এখনো আকাশ মন্ডল নামটিই রয়েছে।

কুমিল্লার র‍্যাব-১১ এর উপ-পরিদর্শক মোঃ তারেক জানান, ইরফানকে আমরা বাগেরহাটের চিলমারি থেকে গ্রেফতার করি। সেখানেই সে আত্মগোপনে ছিলো। সে জানিয়েছিলো বেতনভাতা ও রাগ ক্ষোভের থেকেই একাই সে এই ৭টি খুন করে ফেলেছে। সবাইকে ঘুমের ঔষুধ রাতের খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়ায়। এরপর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী জাহাজের মাস্টারকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার নৃশংস পরিকল্পনা। পরে ধরা পড়ার ভয়ে একে একে আরও ছয়জনকে সে হত্যা করে ফেলেন। আরেকজনকে একই কায়দায় আঘাত করলেও ওই সময় মৃত্যু নিশ্চিত হবার মত বড় আঘাত না হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান জুয়েল। তার শনাক্তের কারণেই চাঞ্চল্যকর সাত খুনের রহস্য উন্মোচিত এবং খুনি চিহ্নিত হয়েছে।

যদিও কার্গো জাহাজ এম ডি আল বাখেরার মালিক মাহবুব মোর্শেদ ডাবলু বলেন, ইরফান নাম দিয়ে আমার জাহাজে সে খালাসির পদে চাকরি নিয়েছিলো। তাকে বেতনভাতাসহ অন্য সুবিধা দেয়া হতোনা এমন অভিযোগ বানোয়াট। আমি ৭ খুনের ঘটনায় ৮-১০জনকে অজ্ঞাত দেখিয়ে ইতিমধ্যেই হাইমচর থানায় মামলা করেছি।

থানা পুলিশ ও স্থানীয়দের থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে জানা যায়, ইরফান তার নিজ এলাকা বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর গ্রামেও আকাশ মন্ডল নামেই পরিচিত। তার পিতা জগদীশ মণ্ডল মারা যাওয়ার পরই তারসহ পুরো পরিবারের অধপতন শুরু হয়। তার মা অভাব অনটন সহ্য করতে না পেরে তাদের দুই ভাইকে ফেলে মুসলিম যুবকের সাথে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করে বিয়ে করে চলে যান। পরে নানা নানীর কাছে সে থাকা শুরু করার এক পর্যায়ে কিছুদিনের ব্যবধানে তারাও মারা যান। এরপর তার একমাত্র আপন বড় ভাই বিধান মন্ডলও মুসলিম মেয়ের সাথে প্রেম করে ইসলাম ধর্মে গ্রহণ করে আবির হোসেন নাম নিয়ে সেও আলাদা থাকতে শুরু করে।

ইরফানদের প্রতিবেশী জিহাদুল ইসলাম ও মোঃ জুয়েল বলেন, আকাশ নামে ছেলেটি ২০১৮ সালের দিকে একটি মুসলিম মেয়ের সাথে প্রেমে জড়িয়ে এলাকা ছাড়া হয়। এরপর ২০২২ সালের দিকে পুনরায় এলাকায় এসে তার ভাইয়ের সাথে বাকবিতন্ডা হওয়ায় আবার নিরুদ্দেশ হয়। এখন ফেসবুকে দেখে জানলাম সে জাহাজে ৭ জনকে খুন করেছে। তবে আকাশ অভাবের তাড়নায় এলাকায় মানুষের ক্ষেত ও পুকুরে শাক ও মাছ চুরির অপরাধে জড়িয়েছিলো। তবে কাউকে মারধর করা কিংবা আঘাত করার মতো দুঃসাহস কখনো দেখায়নি।

আকাশের বড় ভাই আবির হোসেন বলেন, আমার নানা নানী থাকতো সরকারি জায়গায় ঝুপড়ী ঘরে। তাদের মৃত্যুর পর আমিও সেখানেই থাকি। আমাদের পৈতৃক নিবাস মোল্লাহাট উপজেলার কোদালিয়া গ্রামে হলেও ছোটবেলায় বাবার মৃত্যুর পর মা ধর্মান্তরিত হয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ায় আমরা দু ভাই নানা নানীর কাছেই বেড়ে উঠি। আমি ফলতিতা বাজারে সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রির একটা ছোট দোকান দিয়েছিলাম। সেখানে কাজের সময় আকাশ একটি নারীর সাথে প্রেমঘটিত ঘটনায় এলাকা ছাড়ে। এরপর আর ওই দোকান সেখানে বেশি দিন টেকেনি। গেলো শীতে এক দিনের জন্য সে বাড়িতে আসলে তাকে বকাঝকা করে তাড়িয়ে দেই। এরপর থেকেই সে জাহাজে জাহাজে কাজ করে এবং আমার সাথে আর কোন যোগাযোগ নেই। তবে এলাকায় থাকাকালীন সে বিয়ে করেনি এবং মাছ ধরা ও দিনজমুরি কাজ করতো।

এদিকে চিকিৎসাধীন জুয়েল নৌ পুলিশকে জানিয়েছে এই ছেলেই ছিলো সেই ঘাতক এবং সেই ছিলো জাহাজের নিখোঁজ নবম ব্যাক্তি। বিষয়টি নিশ্চিত করে জেলা প্রশাসকের ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটির সদস্য চাঁদপুর নৌ পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, গলায় অসুস্থতায় কথা বলতে না পারলেও কাগজে ৯ জনের নাম লিখেছিলো। সেখানে হতাহতের ৮ জন বাদে অন্য নামটি মূলত ইরফানই ছিলো ওই ব্যাক্তি যে তাকে গলায় জখম চালিয়েছে।

তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে জানান, জাহাজটিতে কোন সিসি ক্যামেরা ছিলোনা। সবাই ঘুমন্ত ছিলো এবং ওইদিন সবাই কক্ষের দরজা খোলা রেখেছিলো অর্থাৎ দরজা টানা ছিলো তবে ছিটকারি আটকানো ছিলোনা। দরজা ভাঙ্গা না থাকায় বিষয়টি সহজভাবে বুজা গেছে এবং জুয়েলের থেকে তথ্যেও এটি নিশ্চিত হয়েছি। তবে জুয়েল ভেতর থেকে দরজা লক করায় মূলত প্রাণে বেঁচে ছিলো। দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার কাজ এগিয়ে নিচ্ছি আমরা।
২৫০ শয্যা বিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের আর এম ও ডা: আসিবুল ইসলাম আসিব বলেন, জাহাজে ৭ খুনের প্রত্যেকটা মরদেহের ময়না তদন্ত আমি করেছি। প্রত্যেককেরই কানের একটু উপরে মাথায় কোপ দিয়ে মারা হয়েছে। যে একজনকে ধরা হয়েছে সে নেশাগ্রস্থ ছিলো কিনা সন্দেহ। তার উগ্র আচরণের বহিঃপ্রকাশেই এমন কান্ড হতে পারে।

একজন সুস্থ্য স্বাভাবিক লোক কি এতো গুলো মানুষকে রক্তাক্ত করে খুন করতে পারে? এ বিষয়ে চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের প্রধান ডা: এ. এম ফরিদুজ্জামান বলেন, ইরফানের মোটিভ কি ছিলো এবং সে কি সাইকোপ্যাথ কিনা সেটি জানা এক্ষেত্রে জরুরী। ২৬/২৭ বয়সের যুবকরা এই ধরনের খুন করার ভালো সম্ভাবনা থাকে। মূলত এই বয়সী যুবকদের যারা ‘এন্টি সোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিজ অর্ডারের মানুষ’ তারা দেশের বা সমাজের আইন কানুন মানতে চায় না। অর্থাৎ কোন নিয়মে আবদ্ধ থাকতে চায় না। রাগ উঠলে এরা মারপিট, ভাঙ্গচুর যেকোন কিছু করতে পারে। পার্সোনালিটি যদি সিডিয়ার হয় সেক্ষেত্রে এই বয়সী যুবকরা একজন সন্ত্রাসীতে পরিণত হতে পারে কিংবা সে একজন সাইকোপ্যাথ হতে পারে। এই বয়সটাতে এদের অপরাধবোধ কাজ করেনা। এরা যে কাজ করে সেটা কেনো করে সেটাও তারা জানেনা বা বুজতে চায় না। এরা খুব ছোটখাটো বিষয়েও ভাঙ্গচুর মারধর পর্যন্ত করতে পারে। তার মারধরের স্বীকার লোকটি মারা গেলো কিনা সেটিও তারা বুজতে চায় না বা তার বিবেককে নিয়ন্ত্রণ করেনা। আবার এ বয়সের ছেলে গুলা অনেক সময় তাদের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। ইউরিন টেষ্ট করলেই সে নেশা করতো কিনা বেরিয়ে আসবে। ওই পার্সোনালিটি যুবকদের ক্রিমিনাল এক্টিভিটি থাকে। সিবিআর হলে মার্ডার করাটা স্বাভাবিক। সে মূলত রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরেই এই হত্যাকান্ডগুলো ঘটাতে পারে এবং এটা সুস্থ্য মস্তিষ্কে ঠান্ডা মাথাতেই করা সম্ভব।

এদিকে চাঁদপুর জেলা জজ কোর্টের এপিপি ও সাংবাদিক অ্যাড. ইয়াসিন আরাফাত জানান, আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফান বিচারককে বলেন, মানুষ ভুল করে। আমিও ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দিন।
এই ৭ খুনের ঘটনায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হরিণা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর মোঃ কালাম খান বলেন, ইরফান আমাদের কাছেই রয়েছে। ৭ দিনের রিমান্ডের ১ম দিনে তার থেকে অনেক তথ্যই পেয়েছি। বাকি দিনগুলোতে পূর্ণাঙ্গ তথ্য বের করবো। আহত জুয়েলের সাথেও আমার যোগাযোগ রয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌযান পরিবহনের চাঁদপুর নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক শ. আ. মাহফুজ উল আলম মোল্লা বলেন, অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত জাহাজটিতে পাইলট ছিলোনা। এমনকি তাতে স্কট, সিসি ক্যামেরা, ভিএইচএফ যন্ত্রপাতিও ছিলোনা। সেক্ষেত্রে জাহাজটি কিভাবে এতোদিন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে নদীতে চলাচল করেছে? সে নিয়েও কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করছি। কেননা অবৈধ রেজিষ্ট্রেশনবিহীন কার্গো জাহাজের বিরুদ্ধে প্রায়ই আমরা জরিমানাসহ আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।

তিনি বলেন, ঘটনার খবর শুনেই ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। পরে দেখলাম জাহাজটি নোঙ্গর করা ছিলোনা বরং চরে আটকে ছিলো। ওটাতে পাইলটও ছিলোনা। যার কারনে নির্দিষ্ট কেনেলের বাইরে দেখতে পাই জাহাজটি। ইরফান যে পদে কাজ করতো তার কাজ হচ্ছে তার নাম হচ্ছে খালাসী। মূলত খালাসীরা সাধারণত লস্করের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। তারা জাহাজের ডেকে মালামাল স্থানান্তর করতো এবং ডেকে বা যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে থাকে। কোনভাবেই মাষ্টারের ভূমিকায় জাহাজ চালানোর কথা না। তবে দেখে দেখে হয়তো জাহাজ কিছু সময় চালাতে পারে তবে দক্ষ চালক বা মাষ্টারের মতো কখনোই চালাতে পারেনা। এজন্যই হয়তো ইরফান যে সময়টুকু জাহাজটি চালিয়েছে সে সময়েই জাহাজটি নির্দিষ্ট ক্যানেলের বাইরে চলে যায় এবং চরে আটকা পড়ে এবং নোঙ্গর করা ছিলোনা।

এ বিষয়ে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন বলেন, ৭শ' ২০ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার ছিলো কার্গো জাহাজটিতে। তা অক্ষত হওয়ায় এবং এগুলো সরকারি সার হওয়ায় দ্রুত তা ওই জাহজ হতে আনলোড করে স্থানান্তরিত করতে অন্য একটি জাহাজ ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। আইনী প্রক্রিয়া শেষে ওই জাহাজ থেকে মাল আনলোডের কাজ শুরু হবে। তদন্ত টিমও তাদের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। এর আগে আমরা আইনী প্রক্রিয়া শেষ করে লাশগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছি এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতের প্রত্যেককে ২০ হাজার এবং নৌ পুলিশের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকার চেক দিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত চাঁদপুরের এই ৭ খুনের ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে এবং রহস্য উন্মোচনে শ্রম মন্ত্রণালয় ৫ সদস্য, জেলা প্রশাসন ৪ সদস্যের এবং জেলা পুলিশ ৩ সদস্যের পৃথক তদন্ত টিম গঠন করেছে। যারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবেন।

উল্লেখ্য, গত ২২ ডিসেম্বর সকাল ৮টা হতে ২৩ ডিসেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টার যেকোন সময়ে চাঁদপুরের হাইমচরের ঈশানবালাস্থ মনিপুর টেক খাল পাড় সংলগ্নে জাহাজে ৭ জন খুনের ঘটনাটি ঘটেছে বলে মামলা হয়। এম.ডি. আল বাখেরা কার্গো জাহাজটি ২২ ডিসেম্বর সকাল ৮ টায় চট্টগ্রাম কাফকো জেটি থেকে ইউরিয়া সার বোঝাই করে চাঁদপুর মেঘনা নদী হয়ে সিরাজগঞ্জ জেলার বাঘাবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। জাহাজটিতে মাষ্টারসহ ৯জন স্টাফ ছিলো। ২৩ ডিসেম্বর সকালে খুনের ওই ঘটনা সামনে আসে। এতে এম.ডি. আল বাখেরা জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়া, গ্রিজার সজিবুল ইসলাম, লস্কর মাজেদুল ইসলাম, শেখ সবুজ, আমিনুর মুন্সী, ইঞ্জিন চালক সালাউদ্দিন ও বাবুর্চি রানা কাজী খুন হন। এ ছাড়া গুরুতর আহত ব্যক্তি হন জাহাজটির সুকানি জুয়েল।

(ইউএইচ/এএস/ডিসেম্বর ২৭, ২০২৪)