২৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১
'বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশে কোন প্রকার স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি সহ্য করা হবে না'
উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ ডেস্ক : বোম্বাই-এর সাপ্তাহিক ‘ব্লিৎস’ পত্রিকার সম্পাদক আর কে কারানজিয়া পাকিস্তানি ফ্যাসিস্ট বাহিনীকে বাংলাদেশে নরহত্যা ও ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত করে বিচারের জন্য একটি যুদ্ধ অপরাধ কমিশন গঠনের আহ্বান জানান।
ঢাকার বার্তা প্রতিষ্ঠান বি.পি.আই পরিবেশিত খবরে বলা হয়, ‘ব্লিৎস’ পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যায় ‘শয়তানের বীভৎস মুখ দর্শনে’ নামে লিখিত একটি নিবন্ধে কারানজিয়া বলেন, এ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী সম্পর্কে যে তথ্য লাভ করেছেন তাতে এটাই প্রমাণিত হয়, পাকিস্তানি সৈন্যরা যুদ্ধাপরাধী, যুদ্ধবন্দী নয়। নিয়াজী, ফরমান আলী গং জেনেভা কনভেনশন অনুসারে যুদ্ধবন্দীর মর্যাদা পেতে পারে না। তারা খুনী, তারা নারীর মর্যাদা-হরণকারী, তারা সৈনিকের মর্যাদাকে ভ’লুন্ঠিত করেছে।
কারানজিয়া অভিমত প্রকাশ করেন যে, ইয়াহিয়া চক্র অতিরঞ্জিত ও ভাবাবেগ সৃষ্টি করে বাংলাদেশে জাতিসংঘ কিংবা চীন ও মার্কিন হস্তক্ষেপের পথ প্রশস্ত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় নিজেদের একটি পিস্টন ইঞ্জিন বিশিষ্ট বিমান ও দুটি হেলিকপ্টারের সাহায্যে এতিমখানা ও কতিপয় এলাকায় বোমা বর্ষণ করে। তিনি তাঁর নিবন্ধে উল্লেখ করেন, তিনি এমন কয়েকজন সাংবাদিকের সাথে আলাপের সুযোগ লাভ করেছেন, যাঁরা ঢাকায় বিমান ও হেলিকপ্টারকে এতিমখানার ওপর দিয়ে উড়ে যেতে এবং সেখানে বোমা নিক্ষেপ করতে দেখেছেন। এই হামলায় বহু শিশু প্রাণ হারায়। বিদেশী সাংবাদিকরা এই ঘটনাকে দৃষ্টান্তহীন বলে অভিহিত করেছেন। এরাই যুদ্ধবন্দীর মর্যাদার জন্য দাবি করে আর তাদের অপকীর্তিকে ভারতীয় বাহিনীর ওপর চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করেছে।
তিনি আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, কমলাপুরে আহত ৩৬ জন ভারতীয় সৈন্যকে পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসারের নির্দেশে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। ভারতীয় বাহিনীর নিকট এই ঘটনার তথ্য প্রমাণ রয়েছে।
কারানজিয়া বলেন, জেনারেল নিয়াজী এবং তার সহযোগীরা পূর্ব ও পশ্চিম রণাঙ্গনে ভণিতার আশ্রয় গ্রহণ করে। তারা ভারতীয় সৈন্যদের গুপ্তস্থান থেকে বের করার জন্য শ্বেত পতাকা উড়িয়েছে। তিনি প্রশ্ন করেন, সুতরাং পাকিস্তানি সৈন্যরা কিভাবে যুদ্ধবন্দীর সম্মান লাভ করতে পারে ?
ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকশ’ সকালে আলাদাভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্ণেল এম.এ.জি ওসমানীও সে সময় উপস্থিত ছিলেন।
বিবিসি’র এক খবরে বলা হয়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো পিন্ডিতে অন্তরীণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করেন, তবে তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু জানা যায়নি।
পুরানা পল্টনস্থ আওয়ামী লীগ অফিসে স্বাধীনতাউত্তর প্রথম কর্মীসভায় ভাষণদানকালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের জনগণের সাথে এই সরকারের ঘনিষ্ঠ ও নিবিড় সম্পর্ক বজায় থাকবে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার জনগণেরই সরকার। বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণই এই সরকারের কাম্য। তিনি তাঁর মন্ত্রীপরিষদ সদস্য ও নিজকে জনগণের সেবক বলে অভিহিত করেন।
বিকালে বঙ্গভবনে চার জন নতুন মন্ত্রীর শপথ অনুষ্ঠান শেষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম মন্ত্রীপরিষদ সদস্যদেরসহ পুরানা পল্টনস্থ আওয়ামী লীগ অফিসে যান। আওয়ামী লীগ কর্মী ও নেতৃবৃন্দ অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ও তাঁর মন্ত্রীপরিষদ সদস্যদের বিপুল সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ সম্পাদক গাজী গোলাম মোস্তফা কর্মীদের উদ্দেশে ভাষণ দেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম ঘোষণা করেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল সুখী, সুন্দর ও শোষণহীন সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকবো না, মানুষ সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবে এবং সাধারণ মানুষই হবে রাষ্ট্রের ভাগ্য নিয়ন্তা। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদানই এই সরকারের লক্ষ্য। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশে কোন প্রকার স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি সহ্য করা হবে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে কুটনৈতিক পর্যায়ে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। পাকিস্তান জঙ্গীশাহীর পক্ষে একটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতিকে বেশিদিন আটকে রাখা সম্ভব হবে না এবং অচিরেই তাঁকে মুক্ত করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশে দখলদার বর্বর পাকবাহিনীর সাথে সহায়তা করার অভিযোগে আরো কয়েকজন দালালকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হচ্ছে :
১. ড.হাসান জামান, প্রাক্তন পরিচালক, পাকিস্তান বিষয়ক একাডেমী।
২. নাসিরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী,সিলেট, সদস্য নেজামে ইসলামী, প্রাক্তন প্রাদেশিক মন্ত্রী, সম্প্রতি তথাকথিত উপনির্বাচনে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য।
৩. মওলানা আতাহার আলী, কিশোরগঞ্জ শহর।
৪. মওলানা সাঈয়েদুর রহমান , ময়মনসিংহ শহর।
৫. বাহাউদ্দিন আহমদ, প্রাক্তন এডিশনাল এস পি, সিলেট।
৬. মো: এস বি দোজা, সিও (রেভ) কতোয়ালী, ঢাকা।
৭. নূরুল আমীন, সুপারিন্টেনডেন্ট, তেজগাঁও টেলিফোন ওয়ার্কশপ।
৮. শাহাবুদ্দিন, ফোরম্যান, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই।
৯. মওলানা বজলুর রহমান, দয়াপুর, কুমিল্লা।
১০. এস এম মুজতবা খুরশিদ, প্রাক্তন ওসি,লালবাগ থানা, ঢাকা।
১১. এস আই ইউসুফ আলী চৌধুরী, প্রাক্তন ওসি,কালিগঞ্জ থানা, ঢাকা।
১২. এস আই মো: ইসহাক, প্রাক্তন ওসি,মোহাম্মদপুর থানা, ঢাকা।
১৩. হাবিলদার নওয়াব খান,ই পি সি এ এফ।
১৪. শামী, মুজাহিদ কমান্ডার, মিরপুর।
১৫. মো: আকিল (মুজাহিদ), মিরপুর।
১৬. মো: আলী ওরফে মো: আখতার আলী (মুজাহিদ), মিরপুর।
১৭. মান্না ওরফে আবদুল আজিজ (মুজাহিদ), মিরপুর।
১৮. শুর মোহাম্মদ (মুজাহিদ), মিরপুর।
১৯. শাহাবুদ্দীন, শত্রুবাহিনীর এজেন্ট।
২০. আবদুল জহীর (রাজাকার), নোয়াখালী।
২১. আনকা ওহী (রাজাকার), পার্বত্য চট্টগ্রাম।
২২. আবুল বাশার মো: শাহজাহান (আল-বদর), ফেনী, নোয়াখালী।
২৩. সৈয়দ মো: মোহেন কাদের, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
২৪. আনিসুর রহমান,কমান্ডার (আল-বদর)।
২৫. বিলাল হোসেন, কমান্ডার (আল-বদর)।
২৬. এস. এ. সিদ্দিকী, মিরপুর, কমান্ডার (আল-বদর)।
২৭. এ বি এম খালেক মজুমদার (আল-বদর)।
২৮. ওমর হায়াত, মিরপুর।
২৯. সিরাজদ্দীন, সদস্য, শান্তি কমিটি।
৩০. আশরাফ আলী, ‘আল-বদর’ সদস্য,ফরিদাবাদ।
৩১. এস.এম.মুনিবুল হক, আহ্বায়ক, শান্তি কমিটি।
৩২. সৈয়দ এরশাদ হোসেন, তেজগাঁও, ঢাকা।
৩৩. সৈয়দ মো: মহসিন, মোহাম্মদপুর, ‘আল-বদর’ সদস্য।
৩৪. মো: হানিফ, মিরপুর।
তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
(ওএস/এএস/ডিসেম্বর ২৭, ২০২৪)