রিয়াজুল রিয়াজ, ফরিদপুর : ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের সহকারি অধ্যাপক ডা. শাহীন জোয়ার্দারকে তাঁর কর্মস্থলে বর্বরোচিত হামলা ও তাঁকে এলোপাতাড়ি মারধরের ঘটনায় কোতয়ালি থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) রুজু হওয়া ওই মামলায় (মামলা নং ৫১) ৫/৬ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামাসহ ৮/১০ জনকে আসামি করে মামলাটি করেছেন, ভুক্তভোগী চিকিৎসক শাহিন জোয়ার্দারের কর্মস্থলের অধিকর্তা ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ, অধ্যাপক ডা. দিলরুবা জেবা।

বুধবার বিকেলে ফরিদপুর কোতয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদ উজ্জামান মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এবিষয়ে কোতয়ালি থানার ওসি আসাদ উজ্জামান 'দৈনিক বাংলা ৭১'কে জানান, 'ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের অর্থোপেডিক্স বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ডা. শাহীন জোয়ার্দারের ওপর হামলা ও তাঁকে মারধরের ঘটনায় কোতয়ালি থানায় একটি মামলা হয়েছে (মামলা নং ৫১, তারিখ: ২৫ ডিসেম্বর)। মামলাটি যথেষ্ট গুরুত্বের সাথেই দেখছে কোতয়ালি থানা পুলিশ'। 'ওই মামলার এজাহার ভুক্ত তিন আসামিকে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে ও তদন্ত সাপেক্ষে বাকী আসামিদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে' বলেও জানান ওই পুলিশ কর্মকর্তা।

এদিকে, বুধবার সন্ধ্যায় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ এর অধ্যক্ষ ও মামলাটির বাদি অধ্যাপক ডা. দিলরুবা জেবা জানান, 'ডা. শাহীন জোয়ার্দার ফরিদপুরের একজন সুনামধন্য অর্থোপেডিক্স চিকিৎসক। তাঁকে প্রকাশ্যে হাসপাতালের ভিতরে জনসম্মুখে নির্মভাবে মারধর করা হয়েছে যা ফরিদপুরের বর্তমান চিকিৎসক সমাজের জন্য আতংক সৃষ্টি, ভয়ের কারণ ও উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। তিনি আরো জানান, 'ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ডা. শাহিনের ওপর বর্বরোচিত ওই হামলার ভিডিও ফুটেজ আপনারা সবাই হয়তো ইতিমধ্যে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখে থাকবেন। আমরা 'ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ' এর পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে এবিষয়ে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। এবং ওই প্রতিষ্ঠানটির প্রিন্সিপাল হিসেবে আমি নিজেই ওই মামলার বাদি হয়েছি। এছাড়া বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে দেখতে এবং একজন সুনামধন্য চিকিৎসকের ওপর বর্বরোচিত হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে, ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি) ও স্বাস্থ্য বিভাগকে একাধিক মাধ্যমে এই বিয়ষয়ে অবগত করেছি। আমরা হামলার ঘটনাটির ন্যায় বিচার আশা করছি কারণ, এই হামলার বিচার না হলে এঅঞ্চলের চিকিৎসকদের মাঝেমধ্যেই এমন অপ্রীতিকর বা অস্বস্তিকর ঘটনার শিকার হতে হবে। বাজে একটা সামাজিক সিস্টেম চালু হওয়ার আশংকা থাকবে, যা অত্র এলাকার সামগ্রিক চিকিৎসাসেবায় নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারে! এছাড়া, ওই ঘটনাটির পর থেকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসকসহ জেলার অন্যান্য চিকিৎসকেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন' বলেও জানান তিনি।

অধ্যাপক ডা. দিলরুবা জেবা আরো জানান, 'গত মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এমন বর্বরোচিত ও নেক্কারজনক ঘটনাটি ঘটে'। তিনি আরো বলেন, 'ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সাধারণত চিকিৎসাসেবার সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নি করার সুযোগ দিয়ে থাকে। তেমনি একজন কোন এক প্রাইভেট নার্সিং ইনস্টিটিউট থেকে আগত শিক্ষার্থী মো. মোত্তাকিম (২১), যার সঙ্গে ডা. শাহিন জোয়ার্দারের কথা কাটাকাটি হয়েছিলো ওই দিন সকাল ১০ টায়। চিকিৎসক শাহিনের সামনেই ওই নার্সিং শিক্ষার্থী এক রোগীর সঙ্গে অপেশাদার ও অসৌজন্যমূলক আচরণ করে। তা দেখে ডা. শাহিন ওই শিক্ষার্থীকে একটা ধমক দেন এবং ভুল শুধরে হাসপাতালের রোগীদের সাথে ভালো ব্যবহার ও নিজের কাজটি সঠিকভাবে শেখার চেষ্টা করার পরামর্শও দেন ডা. শাহিন। শিক্ষক হিসেবে তিনি তা করতেই পারেন। কিন্তু ওই শিক্ষার্থী তাৎক্ষণিক ডা. শাহিনের ওপর উগ্র আচরণ প্রদর্শন করতে থাকে। পরে অন্যান্য স্টাফ সহকর্মীরা তাকে বলেন, 'তুমি কার সাথে কি ব্যবহার করছো, জানো? তুমি কি ডা. শাহিন স্যারকেও চিনো না? এরপর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে যায়'।

অধ্যক্ষ ডা. দিলরুবা জেবা আরো জানান, 'রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে অনেক সময় আমাদেরকেও রোগীর আত্মীয় স্বজনদের থেকে অনেক অসৌজন্যমূলক আচরণ ও কথাবার্তা শুনতে হয় এবং তা সহ্য করতে হয়। আবার অনেক সময় হাসপাতালের স্টাফ, ইন্টার্নি শিক্ষার্থী ও রোগীদের মধ্যে সুসম্পর্কের পরিবেশ বজায় রাখতে ও হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে গিয়ে অনেক জুনিয়রকে হালকা শাসনও আমাদের করতে হয়। আমরা সবাই এসব সহ্য করে চলতেই অভ্যস্তও বলা যায়। আবার, ওসব আমরা ভুলেও যাই'।।

তিনি আরো জানান, 'ঠিক তেমনি একটি ঘটনাই ঘটেছিলো ওইদিন, যা ওখানেই শেষ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য মঙ্গলবার সকাল ১০ টায় ঘটে যাওয়া ওই ঘটনার জেরে ওই নার্সিং শিক্ষার্থী ছেলেটি বাইরে থেকে আরো ৭/৮ জন লোক নিয়ে আসে হাসপাতালের ভিতরে এবং ঘটনার প্রায় দুই থেকে আড়াই ঘন্টার পর ওই হাসপাতালেই ডা.শাহিন জোয়ার্দারের ওপর অতর্কিত আক্রমন ও হামলা চালিয়ে তাঁকে আহত করে দুর্বৃত্তরা'।

'দুঃখজনক, অনাকাঙ্ক্ষিত, বর্বরোচিত উল্লেখ করে নিজ প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকের ওপর ওই হামলার ঘটনার তীব্র নিন্দা, প্রতিবাদ এবং সন্ত্রাসীদের দ্রুত গ্রেফতার ও ন্যায় বিচার কামনা করছেন ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দিলরুবা জেবা।
হামলাকারীদের মধ্য থেকে তিন জনকে তারাঁ সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন বলেও জানান তিনি।

এদিকে, হামলাকারীদের উপুর্যুপরি মারধরে আহত ওই চিকিৎসকের দু'টি দাঁত ভেঙে গেছে বলে জানা গেছে।

উল্লেখ করা যেতে পারে, মারধরের শিকার ভুক্তভোগী চিকিৎসক শাহীন জোয়ার্দার ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের অর্থোপেডিক্স বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ও ফরিদপুর পৌরসভার স্থানীয় কোমরপুর এলাকার বাসিন্দা।

এবং, ডা. শাহিনের ওপর হামলার নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ উঠা মোত্তাকিম ফরিদপুরের জেড এম প্রাইভেট নার্সিং ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ও শহরের পশ্চিম খাবাসপুর এলাকার মো. আলমগীরের ছেলে বলে জানা যায়। মোত্তাকিম ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নার্সিং এ ইন্টার্নি করতেছিলো বলে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। মোস্তাকিম ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্নি করতে আসা একজন অনিয়মিত, অমনোযোগী, বখাটে ও উগ্র আচরণের নার্সিং শিক্ষার্থী ছিলো বলেও জানান তারা।

অন্যদিকে, চিকিৎসক শাহিন জোয়ার্দারের ওপর বর্বরোচিত ওই সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদে বিক্ষোভ, দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে যেসব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে এখন পর্যন্ত মানববন্ধন হয়েছে তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য- ফরিদপুরবাসী, ফরিদপুরের সর্বস্তরের চিকিৎসকবৃন্দ, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ সরকারি কর্মচারী কল্যাণ সমিতি, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের শিক্ষকবৃন্দ, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীবৃন্দ সহ বেশ কয়েকটি সংগঠন। এছাড়া ফরিদপুরের একাধিক সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসকবৃন্দ, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীবৃন্দ এবং ফরিদপুরের বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দকে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই হামলার ভিডিও ও ছবি শেয়ার করে, তীব্র নিন্দা প্রকাশ ও হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের জোর দাবি জানাতে দেখা গেছে।

(আরআর/এএস/ডিসেম্বর ২৬, ২০২৪)