১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস, ভারতেরও?
চৌধুরী আবদুল হান্নান
এবারের বিজয় দিবসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক বিবৃতিতে ১৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক বিজয়ে অবদান রাখা তাঁদের সাহসী সেনাদের অসাধারণ বীরত্ব ও অদম্য চেতনার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য যে, তাঁর বক্তব্যে কোথাও বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হয়নি। এ কারণে জন্ম নিয়েছে নানা আলোচনা, সমালেচনা। দেশের বিভিন্ন মহলে চলছে ভারতের তীব্র সমালোচনা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন নেতা বলছেন, তাদের (ভারতের) বক্তব্যে বাংলাদেশের অস্তিত্বই উপেক্ষিত, একে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখছেন এবং ভারতের এই হুমকির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
এ বিষয়ে নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যের জবাবে সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “তীব্র প্রতিবাদ করছি। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ছিল বাংলাদেশের বিজয়ের দিন। ভারত ছিল এ বিজয়ের মিত্র, এর বেশি কিছু নয়।”
একটি ভিনদেশী সরকার প্রধানের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রতিক্রিয়া জানানো হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এবং এটাই রীতি। কিন্ত আইন উপদেষ্টা আগ বাড়িয়ে কেন প্রতিক্রিয়া জানাতে গেলেন? এতে কি মনে হবে না, সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম এমন নবীন নেতৃত্বেকে খুশি রাখতে তিনি সক্রিয়? তিনি বরং নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য নিয়ে যারা অপরিপক্ক কথা বলেন, তাদেরকে কোনো সমালোচনামূলক বক্তব্য দেওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিতে পারতেন।
যেখানে উভয় দেশের সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব নিজ নিজ স্বার্থে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী, সেখানে সকল পক্ষ থেকে নেতিবাচক সমালোচনা পরিহার করতে হবে।
পতিত সরকারের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও হাসান মাহমুদের মতো কয়েকজন মন্ত্রী অতি কথা বলার জন্য মানুষের কাছে নিজেদের হাস্যাস্পদ করে তুলেছিলেন। কথা না বলে তারা থাকতেই পারতেন না, এমন কি নিজের মন্ত্রণালয়ের সাথে সম্পৃক্ত নয় এমন বিষয় নিয়েও কথা বলতেন। মূল্যহীন অতি কথনে যখন বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হতো, তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হতো — এটা তার ব্যক্তিগত মত, সরকারের মতামত নয়।
ভারতের বিভিন্ন নেতিবাচক দিক নিয়ে ব্যাপক প্রচারের ফলে জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব সরকার পতনের পর লক্ষণীয় মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর যখন পশ্চিম পাকিস্তানের সেনারা নিদারুণ অত্যাচার চালাচ্ছে, তখন বাকি বিশ্ব শুধু দর্শকের ভূমিকা পালন করলেও ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃতাধীন তৎকালীন ভারত সরকার বাংলাদেশকে রক্ষা করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ঘোর বিপদে যে পাশে এসে দাঁড়ায় সেই তো প্রকৃত বন্ধু।
ভারতের সাথে আমাদের প্রতিবেশীসূলভ সুসম্পর্ক থাকবে, ‘৭১ এর ভূমিকার জন্য কৃতজ্ঞতাও। সব রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল না, পাকিস্তানের পক্ষও সমর্থন করেছিল কোনো কোনো দল। যারা ভারত-বিদ্বেষ ছড়াতে অতি উৎসাহী তারা সে সময়ের চিহ্নিত শক্তি।
এক্ষেত্রে নতজানু নীতির পরিবর্তে নিজ দেশের সম্মান ও স্বার্থ রক্ষার জন্য রাষ্ট্রেরপক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধিদের মেধা, শিক্ষা ও যোগ্যতার বিকল্প নেই। এ কারণেই পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো ফল অর্জনকারীদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়।
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, এই তারিখটি যেমন আমাদের বিজয় দিবস, তেমনি ভারতের শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিত করে দিয়ে ভারতের বিজয় অর্জন করার ঘটনাও একই তারিখে ঘটেছিল। সেই হিসেবে ওই দিন ভারত সরকার বিজয় উৎসবের মাধ্যমে তাদের আত্মত্যাগকারী সেনাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই পারে।তাদের এ উৎসবে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করা বা না করা একান্তই তাদের নিজস্ব ব্যাপার, বুঝতে হবে ভারত একটি ভিন্ন রাষ্ট্র।
ভারতে বিজেপি সরকারের এমন দষ্টান্ত অতীতেও লক্ষ্য করা গেছে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাদের আয়োজিত বিজয়োৎসবে কোথাও ইন্দিরা গান্ধীর নাম উচ্চারণ করেনি কোনো আলোচক। ইন্দিরাকে উহ্য রেখে ভারতের ১৯৭১ সালের যুদ্ধ জয়ের গল্প ইতিহাসকেই অগ্রাহ্য করা নয় কি ? এটাকে রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রসের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রকাশ হতে পারে।
সেক্ষেত্রে ভারতের বিজেপি সরকার প্রধান ১৬ ডিসেম্বর তাদের বিজয়োৎসবে তার বক্তৃতায় বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করবেন — এমন প্রত্যাশা না করাই ভালো।
প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্কের বর্তমান পর্যায়ে কোনো মন্তব্য যাতে নতুন করে অস্বস্তির সৃষ্টি না হয়, সে ব্যাপারে সকলকে সচেষ্ট থাকতে হবে।
আমাদের এ বিজয়ের সাথে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নেরও একটি অসাধারণ কূটনৈতিক বিজয় জড়িয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আক্রমণকারী দেশ পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধকে বাধাগ্রস্ত করতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কয়েকবার প্রস্তাব উপস্থাপন করে কিন্ত যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে মার্কিন বলয়ের বিপরীতে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো প্রয়োগ করে। ফলে বাংলাদেশের জন্ম বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি।
বিজয় দিবসের ভাষণে নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের নাম উচ্চারণ করলে তার মহানুভবতা প্রকাশ পেতো কিন্ত তিনি আমাদের কাছে মহান হতে পারেননি বলে আমরা কেনো মহান হবো না ? প্রকৃত বিজয়ীরা উদার হয়ে থাকেন।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।