শীতকালে মানসিক রোগীর সমস্যার কারণ রোধে প্রয়োজন সতর্কতা
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
পরিবর্তনশীল ঋতু অনেকের পছন্দ হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা অনেক ঝামেলাও নিয়ে আসে সঙ্গে করে। বিশেষ করে শীতকালে (Winter)। শীতকাল অনেকের পছন্দের ঋতু। শীত এলেই পরিবেশে আর্দ্রতা বাড়তে থাকে। কিন্তু সেই আর্দ্রতায় ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাকের মতো অণুজীবগুলি বৃদ্ধির ভালো সুযোগ পায়। ফলে এই সব জীবাণু মানুষের মধ্যে অনেক রোগের জন্ম দেয়। আবার এর পাশাপাশিই শীতের আগমনে শরীরেও অনেক পরিবর্তন ঘটে। শরীরের প্রয়োজনীয় অঙ্গগুলিকে উষ্ণ রাখতে আরও শক্তির প্রয়োজন হয়। এর জন্য অনেক ধরনের ঘাটতি ও রোগ হতে থাকে এবং আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। তাই শীতে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে বলেন চিকিৎসকরা।
বাংলাদেশে প্রতি আটজনে একজন মানসিক রোগী। প্রাপ্তবয়স্কদের ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং শিশুদের ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। চিকিৎসাসেবায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় মানসিক সমস্যায় ভোগা ৯১ শতাংশই চিকিৎসা পায় না। দেশে নারীদের মধ্যে প্রতি ৫ জনে ১ জন মানসিক সমস্যায় ভুগছেন বেশি মানুষ। অন্যদিকে পুরুষদের মধ্যে মানসিক রোগ নিয়ে বেশি সংস্কার ও নেতিবাচক ধারণা দেখা যায়। এমনকি সমস্যাগ্রস্ত কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবার আওতায় আসার হার ২ শতাংশেরও কম। এছাড়া প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রায় ৮০ লাখ মৃত্যু (১৪.৩ শতাংশ) মানসিক সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত বিশ্বজুড়ে ৯৭ কোটি মানুষ মানসিক অসুস্থতা বা মাদক ব্যবহারজনিত সমস্যায় ভুগছেন। আবার এ খাতে দক্ষ জনবলেরও স্বল্পতা আছে। আর বিষয়টিকে সঠিক গন্তব্যের দিকে নিতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। হতাশার দিক চিহ্নিত করে তারা বলেন, দেশের কত মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে, তার সঠিক তথ্য নেই। জনশুমারিতে এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
কারণ সমূহ
১. জেনেটিক (পিতা-মাতা বা পূর্ব পূরুষদের মস্তিষ্ক বিকৃতি থাকলে অনেক সময় সন্তানদেরও মানসিক রোগ প্রকাশ পায়) ২. শরীরে কোনো কঠিন ব্যাধি ৩. অতিরিক্ত নেশা ৪. মস্তিষ্কে আঘাত লাগালে ৫. হঠাৎ ভয় পেলে ৬. মানসিক উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, অত্যধিক আনন্দ, দুঃখ, নিরাশ। ৭.পরিবেশগতভাবে ৮. নিদ্রাহীনতা ইত্যাদি।
লক্ষণ সমূহ
একজন লোক মানসিকভাবে সুস্থ কিংবা অসুস্থ খুব সহজে বুঝা যায় না। অনেক মৃদু রকমের মানসিক রোগ আছে, যেগুলো খুব সহজে ধরা পড়ে না, যেমন-অ্যাংজাইটি, হালকা বিষণ্ণতা। আমরা যদি লক্ষ করি যে, দৈনন্দিন জীবনের ক্রিয়াকলাপ, আচার-আচরণ এগুলো ক্রমশ পরিবর্তন হচ্ছে। এত সে নিজেও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এবং অন্যের ক্ষতির কারণ হচ্ছে। এটি নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে বেশি দিন থাকছে। তখন মানিক রোগ হয়েছে বলে আমরা মনে করি। যেমন-একটি লোক হয়তো বেশি কথা বলছে, রাগ বেশি করছে, বেশি টাকা খরচ করছে, অন্যের সঙ্গে বেশি খারাপ কাজ করছে। এটা দুই-তিনদিন হয়তো অন্যরা মেনে নিবে, কিন্তু এটি যদি ক্রমাগতভাবে দুই মাস ধরে অব্যাহত থাকে, তখন এটিকে আমরা মানসিক রোগ বলি।’
মানসিক রোগীকে মোটাদাগে দুইভাগে ভাগ করা হয়। যেমন- মৃদু ও মাঝারি বা তীব্র আকারের মানসিক রোগ। মৃদু রোগী হলো-অ্যাংজাইটি, মন খারাপ, নিদ্রার সমস্যা ও কিছুটা বিষণ্ণতা। এতে রোগীর খুব বেশি অসুবিধা হয় না। তীব্র আকার রোগী যারা, তাদের জ্ঞান লোপ পায়, আচরণ অত্যান্ত রুঢ় হয়ে যায়, অনেক সময় ভাঙচুর করে। এ সময় অনেক অভিভাবক রোগীকে চিকিৎসার জন্য না এনে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে। এটি ঠিক নয়।’মানসিক রোগের লক্ষণ হতে পারে:
* হঠাৎ হঠাৎ করে বেশি উত্তেজিত হয়ে ওঠা।
* অনেকদিন ধরে নিজেকে সবার কাছ থেকে সরিয়ে গুটিয়ে রাখা।
* টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে মন খারাপ থাকা।
* অন্যদের সঙ্গে একেবারে কথা বলতে না চাওয়া।
* সবার সাথে ঝগড়া করা।
* গায়েবি আওয়াজ বা কথা শুনতে পাওয়া।
* অন্যদের অকারণে সন্দেহ করতে শুরু করা।
* গোসল বা দাঁত মাজার মতো নিয়মিত প্রাত্যহিক কাজ করা বন্ধ করে নিজের প্রতি যত্ন না নেয়া।
* যেসব কাজে আনন্দ পাওয়া সেসব কাজে নিরানন্দ ও আগ্রহ কমে যাওয়া।
* সামাজিক সম্পর্ক থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া।
* নিজেকে নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা করা বা নিজেকে দায়ী মনে হওয়া সবকিছুতে।
* সিদ্ধান্তহীনতা বা মনোযোগ কমে যাওয়া এবং খুব তীব্র হলে আত্মহত্যার চিন্তা পরিকল্পনা ও চেষ্টা করে।
* অতিরিক্ত শুচিবায়ুগ্রস্থ হয়ে ওঠা।
* ঘুম অস্বাভাবিক কম বা বাড়তে পারে।
* খাবারে অরুচি তৈরি হওয়া বা রুচি বেড়ে যাওয়া।
* বাসার, অফিসের বা পেশাগত কাজের প্রতি অনীহা তৈরি হওয়া বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, এই সমস্যাগুলোর মানেই যে তার মানসিক রোগ হবে, তা নয়। তবে এসব উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা গেলে একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলা উচিত। তারা সেটা বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারবেন যে, এখানে আসলে কোন ব্যবস্থা নেয়া উচিত কিনা।
মানসিক রোগের প্রকারভেদ
মানসিক রোগ কত প্রকার মোটা দাগে ভাগ করলে মানসিক রোগ দুই প্রকার: (১) নিউরোসিস (২) সাইকোসিস
* নিউরোসিস এ রোগটি মৃদু ধরনের মানসিক রোগ, অনেক মানুষের মধ্যে বেশি মাত্রায় থাকতে পারে। রোগীর ব্যবহার ও আচরণ পরিবার বা সমাজের জন্য হুমকির কারণ হয় না। সামান্য ওষুধ চিকিসা ও সাইকোথেরাপির মাধ্যমে প্রতিকার করা যায়। তবে এ রোগ বারবার হওয়ার প্রবণতা বেশি।
* সাইকোসিস এ রোগটি জটিল ধরনের মানসিক রোগ, কম সংখ্যক লোক এ রোগে ভুগে থাকেন। চিকিৎসা মোটামুটিভাবে ফলদায়ক। সাইকোসিস রোগটি বারবার ফিরে আসার প্রবণতা নিউরোসিস রোগের চেয়ে কম। দুশ্চিন্তা, টেনশন, ফোবিয়া, অবসেশন, হিস্টিরিয়া ইত্যাদি নিউরোসিস রোগের উদাহরণ, অপরদিকে বিষণ্নতা ও সিজোফ্রেনিয়া সাইকোসিস রোগের উদাহরণ।
শীত ও মানসিক সমস্যা
শারীরিক অসুখ ছাড়াও ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কিছু মানুষ মানসিক রোগেও মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। আর এই ঘটনা খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়। একে সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার বা সংক্ষেপে এসএডি বলা হয়। বাংলায় মৌসুমী বিষণ্ণতা বলতেই পারেন।
এসএডি কী?
সাধারণত শীতকালে এসএডি রোগ দেখা দেয়। এই রোগের কারণে মানুষ হতাশ বোধ করতে শুরু করে এবং স্বাভাবিক ভাবেই তার হাত ধরে আসতে থাকে বিষণ্ণতা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমেরিকায় ১ কোটির বেশি মানুষ মৌসুমী বিষণ্ণতায় অর্থাৎ এসএডি রোগে ভুগছেন। আবার ২.৫ কোটির বেশি মানুষের মধ্যে মৌসুমী বিষণ্ণতার হালকা লক্ষণগুলি দেখা যায়। তাই সেক্ষেত্রে তাকে এস এ ডি না বলে উইন্টার Blues বলা যেতে পারে।
কী কী কারণে মৌসুমী অবসাদ হয়?
ঋতুগত বিষণ্ণতার কারণ সম্পর্কে সঠিক তথ্য না থাকলেও বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে, ঋতু পরিবর্তনের (Season Change) সঙ্গে সঙ্গে মানুষের শরীরে কিছু হরমোনের তীব্র পরিবর্তন ঘটে যা মেজাজকে প্রভাবিত করে। ফলে সময় বিশেষে মানুষ না চাইলেও বিষণ্ণ বোধ করেন, হতাশায় ভোগেন। আবার কিছু কিছু জায়গায় এমনটাও মনে করা হয়, শীত কালে সূর্যের আলো না থাকায় মস্তিষ্কে সেরোটোনিন রাসায়নিক কম হয়ে যায়, যার কারণে মেজাজ ক্ষিপ্ত বা বিষণ্ণ হতে শুরু করে।
শীতকালে বিষণ্ণতার ফলে কী কী হতে পারে?
১) মৌসুমী বিষণ্ণতার কারণে কোনও ব্যক্তি গভীর বিষণ্ণতায় ডুবে যেতে পারেন।
২) কিছু ক্ষেত্রে মানুষের ওজনও বাড়তে থাকে।
৩) মানুষের মনে দুঃখ, হতাশা এবং বিরক্তি বৃদ্ধি পায়।
৪) মানুষ ক্লান্ত বেশি থাকে।
৫) কিছু মানুষের খিদে বেশি পেতে পারে।
৬) অনেক সময়ে দেখা যায় যে, মানুষ কোনও কিছুতেই মন বসাতে পারছে না।
৭) বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে মানুষ একা থাকতে পছন্দ করে। ছবি সৌজন্যে: পিক্সেলস
ঋতুকালীন অবসাদ মোকাবিলা করা যায় কী ভাবে?
১) ঋতুগত বিষণ্ণতার কারণ শরীরে আলোর অভাব বলে মনে করা হয়। এ জন্য চিকিৎসকরা হালকা থেরাপির পরামর্শ দেন।
২) মেঘ কেটে রোদ বের হলে অবশ্যই হাঁটতে বের হবেন। তেমন বৃষ্টি না হলে বা আকাশ অংশত মেঘলা থাকলেও হাঁটতে বেরোনো উচিত।
৩) অন্তত পক্ষে ১০ থেকে ১৫ মিনিট রোদে বসুন রোজ। নিয়ম করে। এর পর ধীরে ধীরে সেই সময় বাড়িয়ে ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট করার চেষ্টা করুন।
৪) নিয়মিত অন্তত আধ ঘণ্টা করে যে কোনও রকম ব্যায়াম করুন।
৫) নিজেকে যতটা বেশি সম্ভব কাজে মগ্ন রাখুন।
হোমিও সমাধান
মানসিকভাবে সুস্থতার মানে কি আবেগ-অনুভূতির শূণ্যতা ? হ্যানিম্যান প্রমাণ করে গেছেন যে, শারীরিক কোন রোগের কুচিকিৎসাই হলো অধিকাংশ মানসিক রোগের মূল কারণ। মানসিক রোগীর জন্য প্রাথমিক ভাবে যেইসব মেডিসিন লক্ষণের উপর আসতে পারে.নাক্স ভুমিকা, থুজা, সালফার
অরাম মেট, প্লাটিনা, পালসেটিলা, স্ট্র্যামোনিয়াম, ভিরেট্রাম, ইগ্নেসিয়া, নেট্রাম মিউর, এসিড ফস, ল্যাকেসিস, চায়না, বিউফো রানা, ককুলাস ইন্ডিকা, ব্যারাইটা মিউর সহ আরো অনেক মেডিসিন আসতে পারে। তাই ঔষধ নিজে নিজে ব্যবহার না করে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
পরিশেষে বলতে চাই, যেকোনো অসুস্থতা থেকে মুক্তিলাভের জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিকসহ সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। মানসিক অসুস্থতাও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই আমাদের প্রয়োজন মানসিক অসুস্থতা নিয়ে সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণা থেকে বের হয়ে এসে এই সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানলাভ করা এবং সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটানো। আমাদের উচিত মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের সবধরনের সমর্থন দেওয়া। তাদেরকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা না করে সহানুভূতিশীল আচরণ করা এবং তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া।
লেখক : চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।