রিয়াজুল রিয়াজ, বিশেষ প্রতিনিধি : ১৯৭১ সালের ১৬ মে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার দাদপুর ইউনিয়নের রামনগর গ্রামে, পাক বাহিনীর হাতে হত্যার শিকার হওয়া ৯ শহীদদের নাম ফলকসহ একটি শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ রয়েছে। স্থানীয়দের কাছে যা ওই গ্রামের ৯ শহীদের গণকবর হিসেবে খ্যাত। যেখানে বোয়ালমারী উপজেলা আওয়ামী লীগ, এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ব্যানারে একটি মাত্র সংগঠন শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।

'রামনগর শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে কেউ ফুল দেন না' এমন একটি অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে জন্য গত ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৭টায় বোয়ালমারীর রামনগরের সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কুমার নদের তীরে রাস্তার অদুরে বাঁশ ঝোপে ঢাকা ওই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি ময়লা আবর্জনায় নোংরা হয়ে আছে। পাকা করা ওই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের জায়গাটুকু ব্যতীত বাকী জায়গার সবটুকুই পিঁয়াজের চারা রোপন করা একটি ফসলি জমি। স্মৃতিস্তম্ভটির পিছন দিকে বাঁশ ঝোপ, আর সামনে ও দুই পাশের সিঁড়ি ঘেষেই ওই পিঁয়াজ খেতের চারা। ওই চাষী পারলে স্মৃতিস্তম্ভের ইট খুলে জায়গা বের করে বীজ বপন করতেন।

যাহোক, পাশের মেইন রাস্তা থেকে ওই শহীদ বেধিতে আসতে হলে রাস্তার খাড়া ঢাল, শুকনো বালুর স্তুপ ও ঝোপ ঝারের ভিতর দিয়ে চলাচলের অভিজ্ঞতা থাকলে ভালো হবে! যেহেতু কোন সংযোগ রাস্তা বা বিকল্প রাস্তা নেই।

সোমবার (১৬ই ডিসেম্বর) সরেজমিনে ওই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে পৌঁছাই স্থানীয়দের সহযোগিতায়। অপরিস্কার ওই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি স্থানীয় এক বালকের সহযোগিতায় পরিস্কার করি। এরপর কেউ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন কিনা, তা পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। প্রায় তিন ঘন্টা অপেক্ষার পর কাউকে না পেয়ে আমার সাথে থাকা স্থানীয় বালকটির মাধ্যমে দুইটি গেন্দা ফুল সংগ্রহ করে ছেলেটিকে বললাম, 'ভাতিজা তোমাদের এই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ বা গণকবরে হয়তো কেউ শ্রদ্ধা জানাতে আসবেন না। চলো আমরা দু'জন এই ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই; তারপর আমি চলে যাবো। সে বললো, 'আপনারে আমি কইছিলাম কেউ আসে না। আমি মাথা নাড়িয়েই বালকটিকে ইশারা করলাম আগে শ্রদ্ধা জানাতে। এরপর আমি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাঁশ ঝারের ভিতর দিয়ে নদীর তীর ঘেষে মেইন রোডের দিকে যাবো, ঠিক এমন সময় দেখি নদীর ওপারে মেইন রাস্তার নতুন ব্রীজের একটু আগে দুইটি মটর সাইকেল ও বড় একটি মাইক্রোবাস যোগে ১২ থেকে ১৫ লোক এসে নামছেন। তাদের হাতে ফুলের ঢালা দেখে আমার সঙ্গে থাকা ছেলেটার গায়ে হাত লাগিয়ে বললাম, 'ভাতিজা দেখো, কারা যেনো ফুল দিতে আসছে এদিকেই'। আমরা আবার শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে পাশে এসে দাঁড়ালাম। ওরাও তারাহুরো করে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের কাছাকাছি এসে আমাকে দেখেই স্টাচুর মতো দাঁড়িয়ে গেলো। মনে হলো আমাকে তারা আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো মিনিট খানেক। এরপর একজন সাহসী লোক আমার কাছে এগিয়ে এসে বললেন, 'আমার বাড়ি এই এলাকাতেই আমি চিনি না এমন লোক এই নেই। আমার কিছু বলার আগেই তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, আপনি কি প্রশাসনের লোক? কথা বলার সুযোগ পেয়েই জানালাম, 'না ভাই আমি একজন সাংবাদকর্মী। সংবাদের প্রয়োজনে এখানে এসেছি'। লোকটি কি যেনো ইশারা দিতেই তার সাথের একজন বললেন, 'এখানে তারা বোয়ালমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ফুলেল শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা কেউ না থাকলেও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এখানে আছেন বলেও জানানো হয়। তারা বলেন, 'স্থানীয় বিএনপি-জামাত সকাল থেকেই বোয়ালমারী শহরের অবস্থিত শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে আমাদের শ্রদ্ধা জানাতে বাধা দেওয়ার জন্য অবস্থান নিয়েছে। বোয়ালমারীতে ওদের মব সহিংসতার সম্ভাবনা এবং প্রশাসন কর্তৃক গ্রেফতারের ঝুঁকি থাকায় রামনগর শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন বলেও জানান তারা। এছাড়া, দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন ও সফল করার বিষয়টি রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তারা। এক প্রশ্নের জবাবে তারা জানান, 'বোয়ালমারীর অনেকেই জানেন না যে দাদপুর ইউনিয়নের রামনগর গ্রামে সরকারি তালিকাভুক্ত কোন গণকবর বা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ আছে! দুর্গম ও ভিতরের দিকে এর অবস্থান হওয়ায় এখানে তেমন কেউ আসেও না। আমরাও সাময়িক পলিটিক্যাল ক্রাইসিসে না থাকলে এখানে আসতাম না, বোয়ালমারীতেই করতাম'। অতপর, সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে তারা ফুল দিলেন, একটু স্লোগান দিলেন এবং দ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করলেন। মিডিয়ার তাদের ছবি ও নাম পরিচয় প্রকাশ পাবে না এই শর্তে আমি ওই সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের কিছু স্টিল ছবি ও তাদের স্লোগানের ভিডিওটুকু ধারণ করলাম।

আমি আরো কিছুক্ষণ সময় ওখানে অবস্থান করে আস্তে আস্তে মেইন রাস্তার ব্রীজে আসলাম। দেখলাম, স্থানীয় কয়েকজন গৃহিণী ওই ব্রীজটির ওপরে খেজুরপাতার তৈরি মাদুর বিছিয়ে ধান শুকাতে দিয়েছেন। আমি এক গৃহিণীকে সালাম দিয়ে তার কাছে ওই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ সম্পর্কে কিছু তথ্য নিতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনি তাঁর শাড়ীর আচল দিয়ে লম্বা করে মুখ ঢেকে দূরে সরে গেলেন। বুঝলাম ভদ্রমহিলা কথা বলতে আগ্রহী নন। আরেকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ৭১ এ পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে খুন হওয়া এই শহীদদের প্রতি কি স্থানীয়রা কেউ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন না? তিনি জানালেন, বোয়ালমারীতে জানায়, এখানে দেখি নাই'। ওই ৯ জন শহীদের পরিবারেরও কেউ আসেন না এখানে? তিনি প্রায় একই ধরণের উত্তর দিলেন। আমি তাঁকে আর কোন প্রশ্ন না করে আরেকটু সামনে এগিয়ে এসে দেখলাম স্কুল পড়ুয়া তিন জন সাত-আট বছরের মেয়ে, বেশ সাজুগুজু করা এবং সবার হাতেই একটি করে ছোট্ট জাতীয় পতাকা। দেখে বুঝলাম স্কুলে পড়ে। জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় গিয়েছিলে তোমরা? চটপটে উত্তর দিলো- 'স্কুলে শহীদ মিনারে ফুল দিতে আর মিছিল (বিজয় শোভাযাত্রা) করতে।' আমি হাতের আঙুল দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভের দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করলাম, ওইখানে ওই বাঁশ ঝারের আড়ালে ৭১ এর শহীদদের একটা শহীদ মিনার আছে জানো কি? ওইখানেও তো তোমরা বিজয় দিবসের শ্রদ্ধা জানাতে পারো? ওরা হাসি দিয়ে বললো, 'হ' আপনারে কইছে ওইটা শহীদ মিনার? আমি বললাম কি তাহলে? একজন বললো, ওইটা তো গণকবর। যুদ্ধের সময় আমাগো গ্রামের হিন্দুগো পাকিস্তানিরা ওইখানে ধইয়া আইনা মাইরা মাটিতে পুঁতে রাইখা গেছিলো'। তুমি কেমনে জানলে? -'আমারে আমার দাদা কইছে'। কয়জনকে মারছিলো এইটা বলেন নাই দাদা? -'কইছিলো মনে নাই। বাড়ি যাবো, খিদে লাগছে'। আমি বললাম, আচ্ছা যাও! আর শুনো দাদার কাছে জেনে নিবে কয়জন, কিভাবে মারা গিয়েছিলেন? সম্ভব হলে তাদের নামগুলে মুখস্থ রেখো!' ওরা চলতে চলতে আমার কথায় মনোযোগী ছিলো কিনা জানিনা, তবে 'আচ্ছা' বলাতেই আমিও সামনের দিকে হাটতে শুরু করলাম। ওইখান থেকে ফেরার পথে সারাটা রাস্তায় কয়েকটা কথা খুব ঘুরপাক খাচ্ছিলো আমার মাথায়-- 'আজ যাদের রক্তে এই দেশ পাকিস্তানীদের শোষণের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে, সেই মানুষগুলোর সবাইকে হয়তো সমানভাবে স্বরণ করা বা শ্রদ্ধা জানানো হয় না! রামনগর শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ বা গণকবরটিতে হয়তো আমি না আসলে আজ কেউ সেটি পরিস্কারও করতে আসতেন না। আবার বোয়ালমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েকটি সহযোগী সংগঠনের ১২ থেকে ১৫ জন লোকও হয়তো দল বিপদে না পড়লে এই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিতে আসতেন না। এমনকি আমারও ওই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি কোনদিন দেখাই হতোনা, যদি আমার এক বদ্ধু আমাকে না জানাইতো ওই গ্রামের কথা, ওই গণকবরের কথা বা ওই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের কথা, অথবা 'যেখানে কেউ ফুল দিতে আসেনা' এমন কোন কথা। সান্ত্বনা এতোটুকুই, একেবারেই অশ্রদ্ধা বা অবহেলায় এবারের বিজয় দিবসটি কাটেনি ৭১ এ পাকি সেনাদের মে গণহত্যা শিকার হওয়া রামনগর গ্রামের ওই ৯ শহীদের! কেউ তো তাঁদের স্মৃতিস্তম্ভ পরিস্কার করেছে, কোন একটি রাজনৈতিক সংগঠন তো তাঁদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে গেছে!

উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ফরিদপুরের তৎকালীন মুজিব বাহিনীর কমান্ডার শাহ মো. আবু জাফর ও তাঁর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে ১৬ মে ভোরে যশোর সেনানিবাস থেকে মেজর নেওয়াজ-এর নেতৃত্বে তিন শতাধিক পাকিস্তানি হানাদার ঢুকে পড়ে ফরিদপুরের হাসামদিয়া গ্রামে। মুক্তিযোদ্ধা শাহ মো. আবু জাফর ও তাঁর সহযোদ্ধাদের না পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে, তাদের দোসর ও স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় ওই এলাকার ৭/৮ গ্রামে প্রবেশ করে। অতঃপর, শুরু করে নির্বিচারে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নারী ধর্ষণের মতো জঘন্য মানবতাবিরোধী কৃতকর্ম। স্থানীয় রাজাকার, আলবদরদের প্রত্যক্ষ সহায়তায়, পাক হানাদার বাহিনী প্রথমে হাসামদিয়া বাজার আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এরপর তারা ওই রাজাকার ও দোসরদের সাথে নিয়ে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা রাজাপুর ও রামনগর গ্রামে ঢুকে অর্ধশতেরও বেশি হিন্দু নারীকে ধর্ষণ করে। পাকবাহিনী ১৬ মে ফরিদপুরের হাসামদিয়া, রামনগর, রাজাপুর, শ্রীণগর, ময়েনদিয়া, রাজাবেনি, মিঠাপুর পোয়াইল প্রভৃতি গ্রামে ঢুকে বেছে বেছে ৩২ জন হিন্দু ও ১ জন মুসলমান সহ মোট ৩৩ জন পুরুষ মানুষকে কুমার নদের পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়াও আশে-পাশের আরো কয়েকটি গ্রামে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় পাক বাহিনীর সদস্য ও তাদের স্থানীয় দোসরেরা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ফরিদপুরের '১৬ মে গণহত্যা' হিসেবে পরিচিত পাক-বাহিনীর এসব মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গী হিসেবে, একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, সর্বাত্মক পাশে থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছে ওই এলাকারই পাকিস্থানী দোসর, আলবদর ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা। যার ফলে, ১৯৭১ সালের ১৬ মে সংঘটিত পাকিস্তান বাহিনী ওই গণত্যায় শহীদ হয়েছেন- হাসামদিয়া গ্রামের ১৩ জন, রামনগর গ্রামের ৯ জন, শ্রীনগর গ্রামের ৩ জন, রাজাপুর গ্রামের ২ জন, ময়েনদিয়া গ্রামের ২ জন, মিঠাপুর পোয়াইল গ্রামের ৪ জন সহ মোট ৩৩ জন।

(আরআর/এএস/ডিসেম্বর ১৯, ২০২৪)