শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর : নির্ধারিত দামের চেয়ে দ্বিগুণ দাম দিয়েও দিনাজপুরে মিলছেনা আলু বীজ। বীজের অভাবে জেলায় অসংখ্য চাষি আলু আবাদ করতে না পেরে  ভুট্টা ও গম আবাদে ঝুকছে। বিএডিসি'র কতিপয় কর্মকর্তা ও ডিলার এবং অসাদু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করছে আলু বীজ। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কর্পোরেশন- বিএডিসি দিনাজপুর অঞ্চলের বীজ বিপণন এর উপপরিচালক কৃষিবিদ মো আব্দুর রশীদ ও  সহকারি প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোছা. মাহবুবা বেগম এবং সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ডিলার অসাদু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সিন্ডিকেট তৈরি করে নেমেছে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন মহোৎসবে। বিএডিসি'র সহকারি প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোছা. মাহবুবা বেগমের কারসাজিতে সৃষ্টি হয়েছে এপরিস্থিতি।

মাহবুবা বেগম ক্ষমতাসীন দল নেতাদের প্রভাব খাটিয়ে কম্পিউটার অপারেটর থেকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়েছে বিএডিসি-দিনাজপুর অঞ্চলের বীজ বিপণন দপ্তর। ২০০৬ সালে চাকুরির শুরু থেকে একই দপ্তরে দেড় যুগ (১৮ বছর) ধরে রয়েছেন। সব কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা তার কাছে জিম্মি। এক প্রকার রাম রাজত্ব করছেন তিনি। নিজের স্বামী, দুইভাই-ভাবিসহ পরিবারের স্বজনদের নামে ১৬ টির অধিক বিএডিসি'র বীজ ডিলারশীপ লাইসেন্স করেছেন। এছাড়াও বিএডিসি বীজ ডিলারশীপ লাইসেন্স ৪৪৫ জন এর মধ্যে তার ঘনিষ্ঠ ও পছন্দের ব্যক্তিদের এক তৃতীয়াংশ লাইসেন্স রয়েছে।

দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলারএক দরিদ্র পরিবারের সন্তান মাহবুবা বেগমের বিয়ে হয়েছে দিনাজপুর উপশহরে। এখন থাকেন শহরের দিনাজপুর ঈদগাহ আবাসিক এলাকায়। অবৈধ উপার্জনে তার এখন শতকোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। বিলাস বহুল বহুতল বাড়ি,গাড়ি, বিপুল ব্যাংক ব্যালেন্সসহ অঢেল সম্পাদের মালিক তিনি। বিলাস বহুল আলিশান বাড়িতে একটি সুপ্রতিষ্ঠিন এনজিও সহ বেশ কয়েকটি ভাড়াটিয়া রয়েছে। যেখান থেকে প্রতিমাসে এখন কমপক্ষে দুই লাখ টাকা ভাড়া পেয়ে থাকেন।

বিএডিসি'তে স্বার স্বামী আব্দুল কুদ্দুস, বড় ভাই মতিউর রহামান, ছোট ভাই মিজানুর রহমান,ভাবি শাহনাজ বেগম, বন্ধু মওদুদ হাসান (লাইসেন্স নং- ১০০২৯) অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন,বন্ধু-বান্ধবের নামে করে দিয়েছেন বিএডিসি'র বীজ ডিলারশীপ লাইসেন্স। প্রভাব খাটিয়ে শুধু লাইসেন্স করে দিয়েই ক্ষান্ত নন তিনি,তার স্বজন ও ঘনিষ্ঠ ডিলারদের ইচ্ছে মাফিক বীজ সরবরাহের বিষয়টিও তিনি দেখভাল করেন। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কারো কথা বলার সাহস নেই। ডিলার এবং অফিসের উবধর্তন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নিন্ম কর্মচারীরা তার কাছে জিম্মি। আওয়ীলীগ শাসনামলে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাতিজা ও আওয়ামী লীগ এর কেন্দ্রীয় নেতা শেখ ফজলে নূর তাপস এর নাম ভাঙ্গিয়ে চলতেন। এছাড়াও দিনাজপুরের সাবেক মন্ত্রী মরহুম এডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, সাবেক হুইপ ইকবালুর রহিম ও পিতালয়ের সাবেক সংসদ সদস্য শিবলী সাদিকের সঙ্গেও ছিলো তার বেশ সখ্যতা। মাহবুবা বেগম এসব নামিদামি ব্যক্তিদের ধরে রাখতে শুধু সব সময় মিষ্টি হাসি দিয়ে বিনয়ের সুরে কথা বলা নয়, তাদের সঙ্গে ছিলো বেশকিছু বিনিময় এমন তথ্য দিয়েছেন তার ঘনিষ্ঠজনেরা।

বাংদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন-বিএডিসি দিনাজপুর অঞ্চলের নিয়োগ প্রাপ্ত কম্পিউটার অপারেটর মাহবুবা বেগম আওয়ীলীগ শাসনামলে একই দপ্তরে চারটি পদ ধরেছিলেন।

কম্পিউটার অপারেটর, সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা, গুদাম রক্ষক ও হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। নীতিমালা উপেক্ষা করে নিয়মববহির্ভূত অসংখ্য স্বনামে-বেনামে বীজ ডিলারশীপ তৈরি তার হাতেই।

অনেক ডিলারদের নেই নিজস্ব গুদাম, নেই দোকান বা যে স্থানের ডিলারশীপ লাইসেন্স আছে সেই স্থানে অস্তিত্ব নেই, আছে অন্য স্থানে দোকান। দিনাজপুর সদর উপজেলার আশরাফুল আলম (লাইসেন্স নং- ১০৬২), চেহেলগাজী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ নেতা জিয়াউর রহমান ওরফে নেতা মুন্না (লাইসেন্স নং-১০৬৬), সুন্দরপুর ইউনিয়নের খলিলুর রহমান (লাইসেন্স নং- ১০৬৯),ছাত্রলীগ নেতা ইফতেখারুল ইসলাম রিয়েল। (লাইসেন্স নং- ১০৬৮), কোতয়ালী যুবলীগের সাবেক সভাপতি আশরাফুল আলম রমজান (লাইসেন্স নং- ১০৬৩), মোঃ আব্দুল কুদ্দুস (লাইসেন্স নং- ১০৬৭) মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন, (লাইসেন্স নং-১০৭১), আব্দুল্লাহ আল আমিন (লাইসেন্স নং- ১০৭৩), এনাম উল্লাহ জ্যামী (লাইসেন্স নং- ১০০৮), ফারুকুজ্জামান চৌধুরী মাইকেল, (লাইসেন্স নং-৯৭৭) নামে ডিলারশীপ লাইসেন্স থাকলেও এদের নেই কোন গুদাম বা দোকান। এমন অভিযোগ খোদ ডিলারদের।

গত বছর (আওয়ামী লীগ শাসনামলে) দিনাজপুরে বীজ ডিলার নিয়োগে অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতির ঘটনাও ঘটেছে। এনিয়ে মামলা হয়েছে। কেউ চাকুরি হারিয়ে জেল-হাজতে রয়েছে।কিন্তু মাহবুবা ধরা-ছোয়ার বাইরে! সে সময় ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলার মেসার্স মিঠুন ট্রেডার্স এর স্বত্তাধিকারি জয়নাল আবেদিনকে বীজের ভুয়া ডিলারশীপ দেয়া হয়। সেই ভুয়া ডিলারশীপ পাশ বই দিয়ে হয়নাল পাঠ বীজও উত্তোলন করেন। কিন্তু, পরে ওই ডিলারশীপ বইটি ভুয়া বলে জানায় বিএডিসি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেই ডিলারশীপে উপপরিচালক আব্দুর রশীদের স্বাক্ষর এবং সই রয়েছে। এ নিয়ে জয়নাল কৃষি মন্ত্রণালয়, বিএডিসি চেয়ারম্যান,দূর্নীতি দমন সহ প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দায়ের করেন। ফলে উদোরপিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে উপপরিচালক রশীদ ও সহকারি প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহবুবা দপ্তরের গাড়ি চালক ফরিদুল ইসলাম এবং অফিস সহায়ক মাসুদ রানার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় ওই দু' জনকে জেল-হাজতে যেতে হয়।

এ দপ্তরের ১১ লাখ টাকা হিসেব গড়মিলে বরখাস্ত স্টোরকিপার হাফিজুর রহমান (৫ নভেম্বর' ২০২২) এর রেল লাইনে রহস্যজনক ভাবে দ্বি-খন্ডিত মরদেহ পাওয়া যায়। হাফিজুর ট্রেনে আত্নহত্যা করেছেন বলে চালিয়ে দেয়া হয়। পরে ধামাচাপা পড়েছে যায়। এর নেপথ্য ঘটনা এখনো অনেকের অজানা রয়েছে।

দপ্তরের ১১ লাখ টাকা আত্মসাৎ এর বিষয়টি মৃত হাফিজুরের উপর চাপিয়ে দেয়া হলেও মূলত: ওই ১১ লাখ টাকার বীজ সংশ্লিষ্ট দুই কর্মকর্তা এবং বীরগঞ্জ ও কাহারোল দুই ডিলারকে বাকিতে দিয়েছিলেন। ওই দুই কর্মকর্তার সঙ্গে আতাঁত করে অবৈধ ভাবে সুবিধা নিয়ে দিনাজপুরে অনেক ডিলার এখন অঢেল অর্থের মালিক। বীরগঞ্জ উপজেলার এক হত দরিদ্র ঘরের সন্তান ডিলারশীপ নিয়ে অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে এখন অর্ধশত কোটি টাকার মালিক। চড়ে বেড়ায় অর্ধকোটি টাকা মূল্যের গাড়িতে। বীজ এবং সার কেলেঙ্কারির ব্যবসায়ীদের হোতা ওই ডিলারকে এবার চলতি মৌসুমে বারাদ্দ পেতে না পেতেই উপপরিচালক আব্দুর রশীদ ও সহকারি প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহবুবা বেগম চাহিদার তুঙ্গে থাকা ১৮ মেট্রিক টন ২৯ জাতের ধানের বীজ সরবরাহ করেছেন।

বেশ কয়েকজন ডিলার এবং কৃষকদের তারা বঞ্চিত করেছে ওই ২৯ জাতের ধানের বীজ থেকে। একই অবস্থা ধান-বীজ -২৮ ধান বীজ-২৬ এর। পছন্দসই ডিলারদের দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু চাহিদা না থাকায় ধানের ৮৯,৯২,৭৪, ব্রি-১০০,বীনা-২৫,ব্রী-৫৮ বীজগুলো অধিকাংশই পড়ে আছে গুদামে।

গত তিন বছর ধরে দিনাজপুরের আলু দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও রিপ্তানী হয়েছে। সেই আলু চাষে খ্যাত দিনাজপুর জেলাতেই আলুচাষ করতে গিয়ে বীজ নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। নির্ধারিত দামের চেয়ে দিগুণ দামে বীজ কিনতে হচ্ছে তাদের। বীজ এবং সারের সংশ্লিষ্ট অসাদু কর্মকর্তা, ডিলার এবং বিক্রয় সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কাছে জিন্মি সাধারণ কৃষক। শুধু আলুই নয়, সারও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এতে আলু উৎপাদনে দ্বিগুণ খরচ হচ্ছে এবার কৃষকের। ফলে আলু চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন তারা। কেউ কেউ আলুর পরিবর্তে ভুট্রা ও গম আবাদে ঝুকলেও চাষির চাষির আলু চাষের জমি অনাদাদি পড়ে আছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে জেলায় ৪৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়। উৎপাদন হয়েছিল ১১ লাখ ৫৯ হাজার ১৭৫ টন। জেলায় মোট আলু উৎপাদনের ১৫ শতাংশ আগাম জাতের। বিএডিসির তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় ব্রিডার (প্রাক-ভিত্তি) দ্বারা উৎপাদিত, আমদানীকৃত বীজ দ্বারা উৎপাদিত, প্রত্যায়িত এবং মানঘোষিত শ্রেণি– এ চারটি ক্যাটেগরিতে আলু বীজ ডিলার এবং কৃষক ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে বিক্রি করা হয়।

উত্তরাঞ্চলের জন্য এ বছরে সরকার সানসাইন, কারেজ ও লেডিরোসেটা জাতের বীজ গ্রেড অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৬৪ এবং সর্বনিম্ন ৫৪ টাকা দরে বিক্রি করবে। সান্তানা, কুইনএনি, সেভেন ফর সেভেন ও মিউজিকা বীজ সর্বোচ্চ ৬১ এবং সর্বনিম্ন ৫০ টাকা কেজি। গ্রানোলা সর্বোচ্চ ৫৬ এবং সর্বনিম্ন ৪৪ টাকা।

কৃষকরা জানিয়েছেন, এসব বীজ তাদের ৬৫ থেকে ৮২ টাকা কেজি দরে কিনতে হচ্ছে।
সদরের উলিপুর এলাকার কৃষক মমিনুল ইসলাম জানান, এবার আগাম আলুবীজ বপন করা করা হয়নি। এরপরও ভালো মানের বীজ সংগ্রহের চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। বিএডিসি এ বিষয়ে সহযোগিতা করেনি। তারা কখন বীজ সরবরাহ করবে সেটি তো বলেই না, যোগাযোগ করলেও সাড়া মেলে না।
কৃষকরা দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্যায় রয়েছেন বলে জানান কৃষক তারানী কান্ত রায়।

কাহারোল উপজেলার কান্তনগর এলাকার আদর্শ কৃষক তারানী কান্ত বলেন, 'বিএডিসির ডিলার ছাড়াও চাষি বা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে বীজ বিক্রির ঘোষণা রয়েছে। তবে বাস্তবে এর সুফল পান না কৃষক। এ ব্যাপারে সরকার পদক্ষেপ নিয়ে কৃষকদের সরাসরি বীজ দিলে সবাই উপকৃত হবে।'

সোমবার (১০ ডিসেম্বর) জেলার বেশ কয়েকটি উওজেলায় সরজমিনে ঘুরে এমনি তথ্য ফুটে উঠেছে।
বীরগঞ্জ কবিরাজ হাট এলাকার কৃষক তোফাজ্জল হোসেন জানালেন, সিজিন আসিতেই বীজ আলুর কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ফেলাইছে আলু বীজ ছার (স্যার) এবং কৃষি ছার, ডিলার ও অসাধু কিছু ব্যবসায়ি। এভাবে কারসাজির মাধ্যমে হামার (আমাদের) কাছ থাকি তারা বেশি টাকা হাতাই নিচ্ছে। ডব্বল টাকা দিয়াও আলু মিলেনা। যোগান থাকিতেও বেশিরভাগ ব্যবসায়ী তাদের দোকান আর গুদামে বীজ আলু রাখছে না। নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ডব্বল টাকা দিলে কোন্ঠে থাকি (অজ্ঞাত স্থান) থাকি আলু বীজ আলু পৌঁছে দিচ্ছে। এইলা কেহ দেখে না। হামাঘরে কেউ খোঁজ রাখেনা। হামর কৃষকের এইবার সারা (শেষ)।

বীরগঞ্জ নীচপাড়া এলাকার কৃষক আলতাফ হোসেন জানালেন, ব্র্যাক কোম্পানির আলু আমাকে কিনতে হইছে সাড়ে ৪ হাজার টাকা করে বস্তা। অথচ কোম্পানির মূল্য ছিল ৩ হাজার ২শ টাকা। ভালো বীজ বিএডিসি'র আলু তো নাইয়ে। ওমরা ( তারা) ডব্বল দামেও দেয় না।

বিরল উপজেলার ধুকুরঝাড়ি এলাকার কৃষক অতুল বর্মন জানালেন, 'বায়ও-- ( বাবা) এইলা কথা আর কহেনা (বলিও না)। আলুর দাম এখন আকাশোত উঠিছে। ৬২ টাকার আলু ১২০/১৩০ টাকা কেজিতে কিনিবা (ক্রয়) হছে। তাহো (তাও) ভালোটা মিলেছে নাই। হামার জমি এলাও ফাকা পড়ি আছে। এখনো আলু ওজিবা (লাগাতে) পারো নাই। এইলা কাথা কহিয়াও লাভ নাই। হামার কৃষকের মরণ।'

বিরল ছেদরা এলাকার কৃষক আব্দুল কুদ্দুস জানালেন, 'আমি এইবার তিন বিঘা মাটিত আলু লাগাতে চাইছিলাম। কিন্তু এখনো এক বিঘাতেই লাগানো শেষ হয় নাই। বাকিটা জমিত আর হয়তো আলু লাগা যাবে নাই। কৃষক টাকা দিয়াও বীজ, সার পায় না। আর কৃষক উৎপাদন করার পরও ভালো দাম পায় না। এইভাবে কী কৃষক বাচতে পারে ? আপনিই আগে বলেন।

আমাদের কৃষকের আর এখন দাম নাই। যেই সরকারই আইসেছে আমাদের জন্যে কিছুই করেনা।'
সদর উপজেলার উনিপুর এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলাম জানালেন, তিনবস্তা বিএডিসি'র আলু বীজ ডব্বল টাকা দিয়ে তাকে কিনতে হয়েছে। এই নিয়ে ডিলারের সঙ্গে একটু কথা কটাকাটি করায় তাকে আর আলু বীজ দিচ্ছেনা। বলছে, তার কাছে আমার আলু বীজ হবে না। অফিস থেকে নিতে হবে। কিন্তু কৃষক কার্ড দেখানোর পরও বিএডিসি'র অফিসে আমাকে বীজ দেয়নি। এক মাসে তিনদিন অফিস গেছি। বলেছে,আলু বীজ নেই। আসলে দিবে।,এভাবে তিনিদিন ঘুরিয়েছে। এখন আলু লাগানোর সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। তারপরও বীজ দিচ্ছেনা কেউ।না দিচ্ছে ডিলার না দিচ্ছে অফিস।'

সদর উপজের কৃষাণ বাজার বীজ ডিলার ও পুলহাট দামুদার এলাকায় বীজ দোকানদার মোস্তাক রুবেল বলেন, চাহিদা অনুযায়ী বীজ আলুর সরবরাহ কম। এ কারণে চাহিদামতো বীজ আলু এবার সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। আমরা যতোটুকু পাই,ততোটুকু চাষিদের দেই। নির্ধারিত টাকায় বীজ দিয়েছি। বেশি নেই নাই। চাষিদের চাহিদা মাফিক দিতে পাই বলে তারা বেশি দাম নেইয়ার অভিযোগ তুলছে। এটা সত্য নয়।

বিএডিসি'র বীজ ডিলার এসোসিয়েশন এর সভাপতি লিয়াকত আলী বেগ লিটন বলেন, কর্মকর্তাদের গাফিলতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে বীজ সরবরাহে কিছুটা অনিয়ম হচ্ছে। কোন কোন ডিলারকে কর্মকর্তারা ইচ্ছা মাফিক বীজ দিয়ে দিচ্ছেন। কেউ আবার পাচ্ছেন না। এবিষয়ে আমরা উবর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আমরা চাই সমবন্টন। এতে ডিলারের পাশাপাশি কৃষক উপকার পাবে। কেউ অবৈধ সুযোগ নিতে পারবে না।'

দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. নুরুজ্জামান আলু বীজ সংকটের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, 'দিনাজপুর জেলায় এবার ৪৭ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এজন্য ৭৭ হাজার মেট্রিক টন বীজ আলুর প্রয়োজন। কিন্তু, চাষিরা নিজেরা বীজ আলু উৎপাদন না করা এবং বীজ সংরক্ষণে না রাখায় কিছুটা সমস্যায় পড়েছে। এজন্য অনেক কৃষক আলুর পরিবর্তে অন্য ফসল চাষাবাদে ঝুকেছেন। এটাও ভালো লক্ষণ। আলু বীজের অপেক্ষায় না থেকে তারা জমিতে অন্য ফসল লাগাচ্ছেন। বিএডিসি'র যে পরিমাণ বীজ দিয়েছে তা নগণ্য। তাছাড়া বিতরণেও সমস্যা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তা সজাগ নয়।'

দিনাজপুর অঞ্চলে বিএডিসি'র আলু বীজ কেলেঙ্কারি নিয়ে ইতোমধ্যে একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু,তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই খোদ দপ্তরে অভিযোগ রয়েছে। তাকে দিয়ে তদন্তের বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। 'যা শেয়াল'কে মুরগি বর্গা দেওয়া' বলেই অনেকে ( কৃষক,ডিলার) অভিযোগ করেছে।

অভিযোগের বিষয়ে বিএডিসি'র সহকারি প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহবুবা বেগম তার স্বামী, দুই ভাই, ভাবির নামে ডিলারশীপ আছে বলে সত্যতা স্বীকার করে হেসে হেসে বলেন, দপ্তর যদি আমাকে না বলদি করে একই স্থানে রাখেন, তাতে কার কি আসে যায়? আমার সঙ্গে কোন দলীয় নেতাদের সম্পর্ক নেই। আমি কখনো অনিয়ম বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নই। আমার উবধর্ত কর্মকর্তার নির্দেশই আমি সব করি। সেটা অনিয়ত না দূর্নীতি আমি বুঝি না। আমাকে দপ্তর সরিয়ে দিলে চলে যাবো। সমস্যা নেই। এর কিছু আমি জানাতে চাই না।'

বিএডিসি'র অভিযুক্ত উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. আব্দুর রশীদ জানান, 'নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কেউ বেশি দামে বিএডিসি'র আলু বীজ কেউ বিক্রি করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা আগে ডিলারদের বীজ দেই। এর পর দেই কৃষকদের।

চলতি আলু মৌসুমে দিনাজপুর অঞ্চলের ৩টি জেলার মধ্যে দিন্সজপুরে ৪৪৫ জন ডিলারের মাঝে ১৫৪৩ মেট্রিক টন, ঠাকুরগাঁয়ে ৮০০ মেট্রিক টন ও পঞ্চগড়ে ৭০০ মেট্রিক টন আলুবীজ দেওয়া হয়েছে। দিনাজপুরে এবার বিভিন্ন জাতের ধানের বীজ ১৩ হাজার ৩৪ মে.টন, গম বীজ ৩ হাজার ৯৪ মে.টন. সরিষা বীজ ৫৩ মে.টন ও মসুর ডাল বীজ ১৮ মে. টন বরাদ্দ রয়েছে। নীতিমান মেনেই আমরা বীজ বিররণ করে আসছি ‘

বীরগঞ্জ উপজেলায় ডিলার সোহাগকে ধান-২৯ জাতের য ১৮ মে.টন বীজ দেওয়া স্বীকার করে তিনি জানান, 'রাজনৈতিক এক উবধর্তন নেতার নির্দেশে সোহাগকে সেই ধানের বীজ দেওয়া হয়েছে। আমার এখানে করার কিছুই ছিলোনা।

সব ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি জানান, আমার সঙ্গে ডিলারদের সখ্যতা নেই। তাদের কথা মতো চলি না বলেই আমার বিরুদ্ধে এতো অভিযোগ। আমার অফিসের কর্মচারিরা কোন কিছু করলে আমি এজন্য দায়ি নই। যারা অন্যায় জালিয়াতি করেছে,তাদের জেলে যেতে হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা চলমান। কর্মচারি হাফিজুর এর রহস্যজনক মৃত্যু হয়নি তিনি আত্মহত্যা করেছেন। এর বেশি কিছুই আমার জানা নেই।

(এসএস/এসপি/ডিসেম্বর ১০, ২০২৪)