চা শ্রমিকের দুই সন্তানের পুলিশে চাকরি
মো: আল-আমিন, শ্রীমঙ্গল : বাংলাদেশ পুলিশের ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে মৌলভীবাজার মেধা যোগ্যতায় প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হলো চা শ্রমিকের দুই সন্তান।
গত ৪ ডিসেম্বর রাতে মৌলভীবাজার পুলিশ লাইন্স ড্রিল শেডে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত ৫৬ জনের নাম ঘোষণা করেন নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি এবং মৌলভীবাজার জেলার পুলিশ সুপার এম.কে.এইচ, জাহাঙ্গীর হোসেন।
এই নিয়োগে কোন রকম তদবির, সুপারিশ ছড়া নিরপেক্ষতার সাথে স্বচ্ছ ভাবে প্রাথমিক নির্বাচিত হন ৫৬ জন। এর মধ্যে কমলগঞ্জ উপজেলার আলীনগর চা বাগানের দিলীপ রবি দাসের ছেলে সুজিৎ রবি দাস ও আলীনগরের ফাঁড়ি বাগান সুনছড়ার হরি নারায়ন বিন এর ছেলে সুজিৎ কুমার বিন।
সরেজমিন সুজিৎ রবি দাসের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মাটি দিয়ে তৈরী কাঁচা কুড়ে ঘরে ৫ জন সদস্যের বসবাস। বাবা দিলীপ রবি দাসের আয়ে ৫ জনের সংসার চলে। অপর দিকে আলীনগরের ফাঁড়ি বাগানের সুনছড়ার হরি নারায়ন বিন এর ছেলে সুজিৎ কুমার বিনের টিনের তৈরী হেলে পড়া একটি কুড়ে ঘরে ৬ সদস্যের বসবাস। তারও একমাত্র বাবার আয়ে সংসার চলে। ২ টি অভাব অনটনের পরিবার। চাকুরী পেয়ে তারা আবেগ আপ্লুত। এটা যেন তাদের সোনার হরিণ হাতে পাওয়া।
আলীনগর চা বাগানের সুজিৎ রবি দাস বলেন, আমার বাবা একজন চা শ্রমিক। অনেক কষ্ট করে লেখা পড়া করিয়েছেন। এর পেছনে রয়েছে আমার মেধা। আমি মনে করি এই নিয়োগ শতভাগ স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হয়েছে।
সুজিৎ রবি দাসের বাবা দিলীপ রবি দাস বলেন, আমি একজন চা শ্রমিক। আমার ছেলে মৌলভীবাজার জেলাতে কনেস্টবল নিয়োগে পরীক্ষা দিয়ে ভাল একটা রিজাল্ট করেছে। খুব কষ্ট করে তারে লেখা পড়া করিয়েছি। এটা নিয়ে আমি গর্বিত। বাংলাদেশ পুলিশকে আমি ধন্যবাদ জানাই।
তার মা বলেন, তাকে লেখা পড়া করাতে গিয়ে এমনও দিন গেছে আমি টিফিনের জন্য ১০ টাকা দিতে পারিনি। বেতনের দিন যখন আসতো খুব কষ্ট লাগতো কি ভাবে বেতন দেবো। আমি ছাগল পালন করে বেতন দিতাম। ঠিক মতো পাইভেট পড়াতে পারতামনা। আমি বাংলাদেশ পুলিশ কর্তৃপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
আলীনগরের ফাঁড়ি বাগান সুনছড়ার সুজিৎ কুমার বিন বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ কন্টেবলে চাকুরী পেয়েছি সম্পূর্ন মেধার ভিক্তিতে। আমি আমার কষ্টের ফলাফল পেয়েছি। মা বাবার ইচ্ছে ছিল নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারি। বাংলাদেশ পুলিশকে ধন্যবাদ জানাই আমাকে তাদের একজন সদস্য করার জন্য। আমি সর্বাত্নক চেষ্টা করবো দেশের সেবায় কাজ করার। সুজিৎ কুমার বিনের মা বলেন, আমি ও আমার স্বামী মিলে অনেক কষ্টে ছেলেকে লেখা পড়া করিয়েছি। আমার ছেলে চাকুরী পেয়েছে এটি আমার খুশীর খবর।
আলীনগর চা বাগানের প্রতিবেশীরা জানান, রবি দাসের পরিবার ঘরে খরচ করে লেখা পড়া করিয়েছে। সেও অনেক পরিশ্রম করেছে। রবি দাস আমাদের প্রতিবেশী। তার ছেলের চাকুরী হয়েছে আমাদের খুব ভাল লেগেছে। বাংলাদেশ পুলিশ কন্টেবল পদে সে চাকুরী পেয়েছে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষকতার কারনে। তার মা বাবা অনেক কষ্ট করেছে লেখা পড়ার পেছনে। সে তার মেধাকে কাজে লাগিয়েছে।
আলীনগরের সুনছড়া ফাঁড়ি বাগানের প্রতিবেশী জানান, সুজিৎ কুমার বিন খুব কষ্ট করে লেখা পড়া চালিয়েছে। সবজি চাষ করে বিক্রি করে লেখা পড়ার খরচ চালিয়েছে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে অনেক প্ররিশ্রম করেছে। সে আমাদের চা বাগানের গর্ব। তাকে আমরা আশির্বাদ করি। সে যেন তার দায়ীত্ব ভাল ভাবে পালন করতে পারে। আলীনগর চা বাগানের পঞ্চয়েত সভাপতি গনেশ পাত্র বলেন, আমাদের চা বাগানের ২ চা শ্রমিকের ছেলের চাকুরী হয়েছে। আমরা তাদেরে নিয়ে গর্বিত। নিরীহ অসহায় চা শ্রমিকের ছেলে চাকুরী পাওয়াতে চা বাগানের সবাই খুশী। এবার ব্যতিক্রম দেখা গেছে। স্বচ্ছতা হয়েছে এবং বৈষম্য বিহীন যে চাকুরী নিয়োগ হয়েছে তা আনন্দের বিষয়।
মৌলভীবাজার জেলার পুলিশ সুপার এম.কে.এইচ, জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, সত্যি আমি খুশী মৌলভীবাজারে সম্পূর্ন মেধা যোগ্যতার ভিক্তিতে নিয়োগ হয়েছে। এখানে আমাদের কোন কৃর্তৃত্ব নেই। এই জায়গায় কোন নেতা, কোন সিনিয়র কর্মকর্তা এই নিয়োগে কোন প্রভাবিত করেননি। যারা নিয়োগ পেয়েছেন তারাও সু-ভাগ্যবান।
উল্লেখ্য, অনলাইনে আবেদনকারী ১৫০২ জনের মধ্যে গত ৪ নভেম্বর নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপে ১২১৯ জন প্রার্থী শারীরিক মাপ ও কাগজপত্র যাচাইয়ের দিন উপস্থিত হন। সেখান থেকে প্রাথমিক বাছাইয়ের দ্বিতীয় ধাপে শারীরিক সক্ষমতা পরীক্ষার জন্য ৮২০ জনকে বাছাই করা হয়। এরপর গত ৫ নভেম্বর শারীরিক সহনশীলতা পরীক্ষা শেষে ৬৮২ জন এবং তৃতীয় ধাপে গত ৬ নভেম্বর লিখিত পরীক্ষার জন্য ৪৭৫ জন প্রার্থীকে নির্বাচিত করা হয়।তিন ধাপে শারীরিক সক্ষমতা যাচাই-বাছাই শেষে ৪৭৫ জন প্রার্থী গত ২৭ নভেম্বর ২০২৪ তারিখ লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৯১ জন প্রার্থী আজ ৪ ডিসেম্বর মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। ০৪ ডিসেম্বর রাতে মৌলভীবাজার পুলিশ লাইন্স ড্রিল শেডে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত ৫৬ জনের নাম ঘোষণা করেন
(এএ/এসপি/ডিসেম্বর ০৯, ২০২৪)