মোঃ আব্দুল কাইয়ুম, মৌলভীবাজার : সম্প্রতি মৌলভীবাজারে পুলিশ কনস্টেবল পদে দেড়হাজার আবেদনকারীর মধ্যে উপজাতি কোটায় একজনসহ ৫৬ জন উত্তীর্ণ হন। যার বেশিরভাগই এসেছেন জেলার প্রান্তিক পর্যায় থেকে। এর মধ্যে প্রমিতা দেব (১৯) নামে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কামালপুর ইউনিয়নের আব্দালপুর গ্রামের নি¤œবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা তরুণীও চাকুরী পেয়েছে পুলিশ বাহিনীর কনস্টেবল পদে। অবশ্য এর আগে আওয়ামীলীগ আমলে পরীক্ষা দিয়েও ভাইবাতে সুযোগ হয়নি ওই তরূণীর। জীবনে বহু প্রতিকূলতা এসেছে। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেছেন, তবুও হাল ছাড়েননি। এখন পরিবারের প্রয়োজনে চাকুরীটা তার লাগবেই। অদম্য ও কঠুর প্ররিশ্রমী প্রমিতা ভেঙ্গে না পড়ে একবছর সময়টাতে বেশ প্রস্তুতি নিয়ে ফের কসস্টেবল পরীক্ষায় নাম লেখায়। 

শৈশব থেকে পুলিশ হবার সপ্নে বিভোর প্রমিতার ভাগ্যের চাকা খুলে যায় এবার। কনস্টেবল পদের জন্য সব ধাপ পেড়িয়ে উত্তীর্ণদের তালিকায় তার নামও উঠে আসে। গত ৪ ডিসেম্বর রাতে পুলিশ লাইন্সে নির্বাচিত ৫৬ জনের নাম ঘোষণা করেন পুলিশ সুপার এম, কে, এইচ, জাহাঙ্গীর হোসেন। সেখান থেকে মিলে উত্তীর্ণ তালিকায় যোগ হওয়া আত্মবিশ্বাসী ও কঠুর প্ররিশ্রমী প্রমিতা দেব নামে কলেজ পড়ুয়া ওই তরুণীর খোঁজ। প্রমিতা ছাড়াও জেলায় এবারের কনস্টেবল পদে উত্তীর্ণ হয়েছেন চা শ্রমিকের সন্তানও। তবে প্রমিতার বেড়ে উঠা সহ জীবন-সংগ্রাম আর প্রবল আত্মবিশ্বাসটা চমকে উঠার মতো।

সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, আব্দালপুর গ্রামে সাড়ে ৩শত সনাতন ধর্মালম্বী পরিবারের বসবাস। এদের বেশিরভাগই পেশায় প্রান্তিক কৃষক। এমনই এক কৃষক পরিবারে বেড়ে উঠা প্রমিতাদের। প্রমিতাদের বাড়িতে প্রবেশ করতে চোখে পড়ে পাশের মাঠে টমেটোর চারা গাছে পানি দিচ্ছেন। সাংবাদিক জেনেই ছুটে আসেন আমাদের কাছে। বাড়িতে প্রবেশ করার পর পরিবারের লোকজন সহ আশপাশের প্রতিবেশীরাও ভীড় জমান। প্রমিতার পুলিশে চাকুরী হওয়ায় তাদেরও চোখে-মুখে আনন্দের বার্তা। জানতে চাইলাম, তার বেড়ে উঠা সহ নানা প্রসঙ্গ।

জানা যায়, বাবা লন্টু দেব আর চার বোন নিয়েই তাদের সংসার। প্রমিতার মা দিপালী রাণী দেব ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১৪ সালে মারা যাওয়ার পরের বছর তার বড় বোনের বিয়ে হয়। সেই থেকে ছোট দুই বোন আর অসুস্থ বাবাকে দেখাশুনা, রান্না-বান্নার মতো কঠিন কাজ সামলে নেন শৈশব থেকে। তীব্র অভাব আর টানাপুড়নের সংসার তাদের। অর্থ সঙ্কটে অনেক সময় পরিবারের সবাইকে না খেয়ে থাকতে হয়েছে। তবুও পড়া-লেখার হাল ছাড়েননি অদম্য এই তরুণী। মা ছাড়া পরিবারে নিত্যনতুন সঙ্কট আর অভাব তাঁকে সেই শৈশব থেকে ভাবনায় ফেলে দেয়। পরিবারের আয়ের উৎস বলতে প্রমিতার বাবা সবজির চারা বিক্রি করেন। তাতেই কোনরকম চলে সংসার। বর্তমানে এই তরুণী মৌলভীবাজার মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।

এ পর্যন্ত বেড়ে উঠার নানা স্মৃতি তুলে ধরে প্রমিতা জানান, সপ্ন ছিল পুলিশ হবার। পরিবারের প্রয়োজনে চাকুরীটা আমাকে করতে হবে। আমার বয়সী মেয়েরা প্রতিদিন ৮ থেকে ৯ টার মধ্যে ঘুম থেকে ওঠেনা। অথচ আমাকে প্রতিদিন ৫ টা থেকে ৬টার মধ্যে ঘুম থেকে ওঠতে হয়। রান্না করে তারপর স্কুলে যেতে হতো। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কলেজ পর্যন্ত কোন দিন কোচিং কিংবা প্রাইভেট পড়িনি। যা পড়ার সবই স্কুলে শেষ করে আসতাম। শুধু মাত্র পরীক্ষার সময় সকালে ঘরে পড়া শেষ করে যেতাম। স্কুলের স্যাররাও আমাকে সাহায্য করতেন। পড়াশোনা চালাতে অনেক সময় টাকা থাকতনা, ভর্তির জন্য প্রতিবেশীরা টাকা দিয়ে সহযোগীতা করেছেন।

প্রমিতার কাকি মা রিতা দেব বলেন, ওর ছোটবেলা মা মারা যান। এখন রান্না সহ সবই ওকে করতে হয়। এর ফাঁকে পড়াশোনাও করতে হয়। অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করেছে। এসব করে শেষ পুলিশের চাকুরীর জন্য পরীক্ষা দিতে যায়। যেদিন তার পরীক্ষা সেদিন তার চাচা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। রাতে পড়তে পারেনি। পরদিন কান্না করতে করতে পরীক্ষা দিতে যায়।

প্রমিতার প্রতিবেশী কাকা বানু লাল দেব বলেন, এই মেয়েটা লেখা-পড়া চালাতে গিয়ে অনেক কষ্ট করেছে। হিমশিম খেয়েছে। কোন দিন প্রাইভেট পড়েনি, কোচিং করেনি। অনেক কষ্টের বিনিময়ে সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছে। এখন সে পুলিশে চাকুরী পাওয়ায় আমরা খুশি, সব চেয়ে বেশি খুশি হয়েছি তার চাকুরীর জন্য কোন ঘোষ দিতে হয়নি, টাকাও খরচ করতে হয়নি।

প্রতিবেশী ইলা দেব প্রমিতার চাকুরী হওয়ায় আনন্দে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। বলেন, শৈশবে তাদের মা মারা যান, গোটা পরিবারে অসহায়ত্ব নেমে আসে। স্কুল থেকে ফিরে অনেক সময় আমাদের বাড়িতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করত। ইলা দেব বলেন, আমি জানতাম টাকা ছাড়া পুলিশে চাকুরী হয়না, গত পুলিশে নিয়োগের সময়ও টাকা ছাড়া ওর চাকুরী হয়নি। আমার নিজের মধ্যেও অনেকে বলেছেন টাকা ছাড়া চাকুরী হবেনা। কিন্তু এবার জানতে পারলাম কোন টাকা লাগেনি।

এদিকে প্রমিতার পুলিশে চাকুরী হওয়ায় পরিবার-স্বজন আর বান্ধবীদের পাশাপাশি খুশির বন্যা পাড়া-প্রতিবেশীর মাঝেও। তাই প্রমিতাকে শুভেচ্ছা জানাতে তার বাড়িতে ভীড় লেগেই আছে সারাক্ষণ।

প্রমিতার বাবা লন্টু দেব বলেন, অনেক কষ্ট করে চলে পরিবার। আমার মেয়ে অনেক কষ্ট করে পড়া-লেখা করেছে। মানুষও সাহায্য করে। চাকুরীটা হওয়ায় অনেক খুশি হয়েছি।

এ বিষয়ে পুলিশ সুপার এম, কে, এইচ, জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, কোন রকম তদবির বা সুপারিশ হয়নি। মেধা আর যোগ্যতায় এ নিয়োগ হয়েছে।

(একে/এসপি/ডিসেম্বর ০৯, ২০২৪)