আদর্শ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কেউ নেতা নয় সবাই মানবতার সেবায় নিবেদিত প্রাণ
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
৫ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক দিবস ২০২৪। যে কোনো দুর্যোগে মানবিক সহায়তা প্রদানে স্বেচ্ছাসেবকদের সচেতন ও দক্ষ করে তোলার লক্ষে দিবসটি পালিত হয়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৭ তারিখ অনুষ্ঠিত অধিবেশনে প্রতি বছর ৫ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী দিবস পালনের জন্য সরকারগুলোর প্রতি আহবান জানানো হয়।
জীবনের সর্বত্র স্বেচ্ছাসেবীদের অবদান সম্পর্কে জনসচেতনতা এবং ঘরে ও বাইরে স্বেচ্ছাসেবায় অধিক সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণে উৎসাহ প্রদান, আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য। দেশের বিভিন্ন স্থানে দিবসটি উপলক্ষে সভা-সেমিনারসহ নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।
স্বেচ্ছায়-স্বপ্রণোদিত হয়ে আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত হওয়ার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর এটি সমাজের সব বয়সী মানুষের, সকলস্তরের মানুষেরই নৈতিক দায়িত্ব। বিশেষ করে যুবকদের ওপর এই দায়িত্বটি বেশি। দেশের জনশক্তির এক তৃতীয়াংশ যুবক। এদেরকে শক্তিতে পরিণত করার মাধ্যমে প্রত্যেককে একেকজন সেবক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সর্বোপরি দেশের প্রয়োজনে যুবকরা সংগঠিত হয়ে যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পারে।
দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে স্বেচ্ছাসেবক মনোবৃত্তিকে উদ্বুদ্ধ করা এখন সারা বিশ্বেই অত্যন্ত গুরুত্ব পাচ্ছে। সেই লক্ষে গঠিত হয়েছে জাতিসংঘের স্বেচ্ছাসেবক কর্মসূচি ইউএনভি। এটি জার্মান ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের একশ’ ৩০টি দেশে তারা সক্রিয় রয়েছে এবং ৮৬টি দেশে তাদের ফিল্ড ইউনিট রয়েছে। ১৯৭০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপি এর দপ্তরের সাহায্যে তাদের কার্যক্রম প্রচার করে।
প্রকৃত অর্থে মানবিক গুনাবলী সম্পন্ন প্রতিটি মানুষই স্বেচ্ছাসেবক। ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের কল্যাণে নিজের শ্রম, অর্থ, সময় ব্যয় করার মনমানসিকতা পোষণ করা উচিত প্রতিটি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষেরই। আর মানবজাতির মধ্যে এই ধরণের গুণাবলী যাদের আছে তারাই প্রিয় মানুষের কাছে যেমন, সৃষ্টিকর্তার কাছেও তেমনি।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজে প্রকৃত নিঃস্বার্থ স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। মেকি লোক দেখানো পরোপকারীরা সমাজের উন্নতি নয়, বরং সমাজের শান্তি বিঘ্নিত করছে, অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। আজকের এই আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক দিবসে আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে, সবার মেধা শ্রম নিয়োজিত হোক শতভাগ মানব কল্যাণে।
আর আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক দিবসের অর্থ হল স্বেচ্ছাসেবার চেতনা প্রচার করা এবং জনকল্যাণের শক্তি প্রকাশ করা। আধুনিক আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবা কার্যক্রম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শুরু হয়। বিভিন্ন দেশের স্বেচ্ছাসেবকরা স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন এবং বাড়িঘর পুনর্নির্মাণ, অর্থনীতির উন্নয়ন ও সামাজিক সভ্যতার অগ্রগতিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছেন।
সমাজে স্বেচ্ছাসেবকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও উৎসর্গ জোরালোভাবে প্রচার, প্রশংসা ও সমর্থন করার জন্য অনেক দেশের সরকার এই দিনে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা মাঝে মাঝে এক দল দয়ার মানুষ দেখতে পাই। তারা নিজেদের বুদ্ধি দিয়ে অন্যদের অধিকার রক্ষা করে থাকেন, বড় বড় প্রতিযোগিতায় নিজেদের দক্ষতা প্রদর্শন করে থাকেন, এবং গ্রামাঞ্চলের পুনর্জাগরণে নিজেদের ভূমিকা রেখে থাকেন।
আজকাল আরও বেশি সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবী পরিষেবা প্রকল্প সামাজিক চাহিদাগুলোর ওপর ফোকাস করে এবং আরও পেশাদার ও পরিমার্জিত হয়ে ওঠে। নানা কমিউনিটিতে এই এলাকার বয়স্ক এবং একা একা বাস করা বয়স্কদের চাহিদা পূরণ করতে এক একটি জনকল্যাণমূলক স্বেচ্ছাসেবক সেবা প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটি স্বেচ্ছাসেবকদের সেবা দল পেশাদার সমাজকর্মী, স্বেচ্ছাসেবক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে গঠিত। তারা বয়স্কদের ২৪ ঘন্টা জরুরি সহায়তাসহ পরিষেবা দিয়ে থাকে। স্বেচ্ছাসেবকরা বয়স্কদের বৈচিত্র্যময় চাহিদার ওপর ভিত্তি করে একটি পরিষেবা তথ্য ডাটাবেসও প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং সময়মতো বয়স্কদের সমস্যার দ্রুত সমাধান করেন।
তরুণরা মানবতার সেবায় নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছে এটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত আশার দিক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এসব সংগঠনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন বা লক্ষ্য অর্জনের জন্য উপযুক্ত কর্মী বা সদস্য প্রয়োজন। একটি লক্ষ্যে কখনই পৌঁছানো সম্ভব নয়; যতক্ষণ না সে সংগঠনের সদস্যরা উক্ত সংগঠনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিজেকে সম্পূর্ণরূপে দক্ষ ও পরিপূর্ণরূপে নিবেদিত করে। যদিও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা স্বেচ্ছাসেবায় এগিয়ে আসে, তবুও এসব সংগঠনগুলোর সদস্যদের মাঝে কিছু বৈশিষ্ট্য কাম্য। নচেৎ এর উদ্দেশ্য ব্যাহত হয় এবং গতিশীলতা হারিয়ে যায়। কোনো সংগঠনের সদস্যরা যদি উক্ত সংগঠনের গঠনতন্ত্র-নিয়মনীতি মেনে না চলেন, তবে সেই সংগঠন দ্রুতই খেই হারিয়ে ফেলে। পদের প্রতি লোভ হলো যেকোনো সংগঠনে অভ্যন্তরীণ কোন্দল সৃষ্টির অন্যতম ধাপ।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে কেউ নেতা নয়। প্রত্যেকেই মানবতার সেবায় নিবেদিত প্রাণ। মনে রাখতে হবে, কেবল সাংগঠনিক গতিশীলতার জন্যই এসব পদবিন্যাসের সৃষ্টি। একটি সংগঠনের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হওয়ার জন্য স্বজনপ্রীতি বা আঞ্চলিকতা হলো আরেকটি কারণ। নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই গুণটি অনেক সময় অযোগ্য ব্যক্তি নির্বাচিত করে। যার ফলে দলের মধ্যে ভাঙনের সৃষ্টি হয় এবং পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে। আর্থিক সচ্ছতা হলো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সকল প্রকার আয়ের উৎস এবং ব্যয়ের খাতগুলোর পরিপূর্ণ হিসাব রাখা হলো দক্ষ সংগঠকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এখানেই শেষ নয়। আর্থিক প্রতিবেদন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সদস্যদের জানানো উচিত। এতে একে অপরের প্রতি অনাস্থা ও অবিশ্বাস কখনোই সৃষ্টি হবে না। অবিশ্বাস, সন্দেহপ্রবণতা, হিংসা, গিবতের ফলে যেকোনো সংগঠনের মাঝে ভালোবাসার বন্ধন নষ্ট হয়। লোক দেখানো বা পারস্পরিক সহযোগিতার বদলে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের হীন চেষ্টা করলে সংগঠনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
সামাজিক সংগঠনের নেতাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নিজেকে নেতা মনে না করে সদস্যদের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে মনোযোগ দেওয়া উচিত। একজন দক্ষ সংগঠকের তার সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে ব্যক্তিগত এবং সাংগঠনিক সুসম্পর্ক রাখা জরুরি। তবে এই সম্পর্ক যেন সংগঠনে স্বজনপ্রীতির কারণ না হয়ে দাঁড়ায় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। নিজেকে সর্বাভিজ্ঞ ভেবে যেকোনো বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত নেওয়া দুর্বল নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য। জ্ঞানের কোনো সীমা নেই। কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে তা সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে নিলে তাতে ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে খুবই ক্ষীণ।
হুটহাট করে রাগ করা, সহকর্মীরা ভুল করলে চরমমূর্তি ধারণ করা বর্জনীয়। দক্ষ নেতার ধরেই নেবেন, তার সহযোদ্ধারা ভুল করবে। কারণ রাগের মাথায় মানুষ সবচেয়ে বেশি ভুল করে। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মুখ দিয়ে অশালীন কথা বা গালি বের হয়ে যেতে পারে। এতে পরবর্তী সময়ে কোনো ভুল হলে অগ্নিরূপ থেকে রক্ষা পেতে সহকর্মীরা তা গোপন করতে চেষ্টা করবে। ফলে এসব থেকে বৃহত্তর ক্ষতির আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। রাগ দমন করে প্রতিকূল পরিবেশে মেজাজ স্বাভাবিক রেখে ঠাণ্ডা মাথায় তা মোকাবিলা আদর্শ নেতার বৈশিষ্ট্য। সামাজিক সংগঠনের সদস্যদের নেতৃত্বের প্রতি যেমন আনুগত্য প্রদর্শন করতে হবে, তেমনই নেতাদের উচিত সবার সঙ্গে বিনয়ী আচরণ করা। তবেই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জন করে মানবতার সেবা নিশ্চিত সম্ভব হবে।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে নামে-বেনামে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে উঠছে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে বিভিন্ন শাখা। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম বিশেষ করে ফেসবুক ব্যবহার করে গড়ে উঠছে নানাবিধ সংগঠন। ফেসবুকে নিজের প্রোফাইলে পদের নাম উল্লেখ করে অভিনন্দন বার্তা গ্রহণ করেই যেন ঘটে এসব নাম সংগঠনের উদ্দেশ্যের সমাপ্তি। আবার সহযোগিতার নামে অর্থ আদায় এবং আর্থিক অনিয়মসহ নানাবিধ বিষয়ে অভিযোগ প্রায়ই ওঠে আসে কিছু সংগঠনের নামে। ফলে একদিকে যেমন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ নজরদারি প্রয়োজন, তেমনি সামাজিক সংগঠনগুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়ায়ও আনা প্রয়োজন। তবে এটিও উল্লেখ প্রয়োজন যেন নজরদারির নামে সংগঠনগুলোর কর্মপরিধি সীমিত করে তোলা না হয়।
আর আশা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে নানান স্বেচ্ছাসেবা প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আরও তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের আকৃষ্ট করা যাবে। বয়স্কদের সাহায্য করা, প্রতিবন্ধীদের সাহায্য করা, পরিবেশ সুরক্ষা করা, এবং আবর্জনা শ্রেণীবিভাগসহ স্বেচ্ছাসেবক পরিষেবার ক্ষেত্রগুলোর ওপর মনোযোগ বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে আমরা স্বেচ্ছাসেবক পরিষেবাগুলোর বিকাশের জন্য আরও ভালো নীতিসহায়তা এবং একটি ভালো প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ প্রদানের আশা করি, যাতে স্বেচ্ছাসেবক পরিষেবাগুলো দেশের ভবিষ্যত উন্নয়ন এবং চাহিদায় আরও পরিবেশন করতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, সমাজে বেঁচে থাকার জন্য মানুষের একে অপরের সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন। মানুষ সর্বদা অন্যকে সহযোগিতা করতে চায়। এটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। তবে একা সহযোগিতা করার চেয়ে কয়েকজন সমমনা ব্যক্তি একত্রিত হয়ে যখন কোনো কাজ করে তখন তা অতীব সহজ হয়ে যায়। আর স্বেচ্ছায় আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত হওয়ার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর এটি সমাজের সব বয়সী মানুষের, সকলস্তরের মানুষেরই নৈতিক দায়িত্ব। বিশেষ করে যুবকদের ওপর এই দায়িত্বটি বেশি। সর্বোপরি দেশের প্রয়োজনে যুবকরা সংগঠিত হয়ে যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পারে। তাই প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশে কিছু দিবস পালিত হয়। ঐ নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সব দিবস পালিত হয়। পালনীয় সেই সব দিবসগুলোর মধ্যে একটি হলো আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক দিবস।
লেখক : সংগঠক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।