কবি সুমন রায়হানের কবিতার বই 'নদীও জলে নামে'
সোহরাব পাশা
শুরু থেকেই সুমন রায়হানের কবিতায় তার কণ্ঠস্বর আন্তরিক, নিজস্ব এবং বহু বর্ণিল চিত্রময়। বলা যায়, কবি পরিচিতির শুরুতেই তিনি তার সৃজন প্রতিভার যে স্বাক্ষর রেখেছেন, তা স্বকীয় স্বরে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধিলাভ করছে বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে।
যাপিতজীবনের পরিবেশ-প্রতিবেশ থেকেই কবিতার রসদ তুলে এনেছেন এই কবি। ঘাস, ফুল, নদী, প্রেম- প্রকৃতি তার কবিতার মূল অনুষঙ্গ। অত্যন্ত সংযম ও পরিমিতির সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন কবিতার শব্দাবলি। সবচেয়ে ভালো লাগার দিকটি হচ্ছে প্রতিটি কবিতার ভেতরের গল্প। যেমন- 'তার চেয়ে ভালো চলো, চুল খুলে কীর্তনখোলা নামি.../বৃষ্টি বন্দনায় হই সুনীল আকাশ, পদ্মপুকুরে জলের সাঁতার... চলো লাটিম-সুতোর ঘূর্ণিতে তুলে আনি ত্রিতাল শৈশব' (নস্টালজিয়া)। কিংবা 'মানুষ মেঘের আলিঙ্গন ভুলতে পারে না বলেই/আকাশ পাঠ করে, পাঠ করে নদী/যদি পায় খোলা প্রান্তর-/খলের মধ্যে ভরে নেয় ভোরের ঘাসফুল/পুড়োলে ভুলের বাগান ফুরিয়ে যায় কার্তিকের আয়ু' (একটি বিধ্বস্ত সময়ের গল্প)। কবি সুমন রায়হান প্রেমকে চিত্রিত করেছেন সৌন্দর্যের নিবিড় আড়ালে। তিনি ফুলকে পর্যবেক্ষণ করেছেন পাতার জানালা দিয়ে। স্পর্শহীন ভালোবাসায় আছে স্বাপ্নিক মুগ্ধতা- 'স্বপ্নের কোনো নিজস্ব রঙ নেই/সোনাঝরা বিকেল বহুদিন বৃষ্টি নেই/কতোকাল এ দৃষ্টিতে তোমার দৃষ্টি নেই' (স্বপ্নের কোনো নিজস্ব রঙ নেই)। অথব্য উদাহরণ দেওয়া যায়- 'ভালোবাসা পেলে নারী, ভালোবেসে যেতে পারি... কাছে এসো না, কাছে এসে যতোটা পাবে-তারও ঢের বেশিই হারাবে' (শৈল্পিক অনুরোধ)।
আবহমান বাংলার সব কবির কবিতায় আলো পড়ে চারপাশের মায়াময়- ছায়াময় নান্দনিক প্রকৃতির। ছায়া পড়ে বিভিন্ন ঋতুর নানাবিধ বৈশিষ্ট্যের। কবি সুমন রায়হানের কবিতাতেও ফুটে উঠেছে সেসব অপরূপ সৌন্দর্যের নিপুণ ছবি। দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক- 'নদীর ভেতর নদী:/সমুদ্র বিলায় জল, আকাশ টলমল/পাখির কলতান, মায়ায় মারে টান/হেমন্ত দিন, মাঠের পরে মাঠ, পাকা ধানের ঘ্রাণ/শীতের সকালবেলা, খেজুর রসের হাঁড়ি নাড়া পোড়ার গন্ধ, ধোয়া উড়ে যায়.../ওই যে দূরের গাঁয়' (মায়া)। আমি আলোচনার গল্প বেছে নিয়েছি সুমন রায়হানের 'নদীও জলে নামে' কবিতার বইটির, যা গত একুশের বইমেলায় প্রকাশ করেছেন জামাল উদ্দিন আহমেদ দি রয়েল পাবলিশার্স থেকে। এর আগে কবির আরও তিনটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে 'হৃদয়ে যে গান আসে' (২০১২), 'যেতে যেতে সমুদ্র' (২০১৪) এবং 'নক্ষত্রের আড়াল' (২০১৬)। সব গ্রন্থের নান্দনিক প্রচ্ছদ করেছেন খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী রাজিব রায়।
'নদীও জলে নামে' কাব্যের ফ্ল্যাপে কয়েকটি পক্তি এ রকম- সুমন রায়হান কবিতার শরীর নির্মাণে তৎসম শব্দের ব্যবহার, অতিকথন, দুর্বোধ্যতার কোনো প্রশ্রয় দেননি। তার কবিতার মূল সুর মাটির ঘ্রাণ আর স্বপ্নব্যাকুল হৃদয়ের অশেষ গান। শ্রমজীবী দুঃখী মানুষ অবাধে ঢুকে পড়েছে সুমনের কবিতার খোলা দরজায়। ভাষা ও মুক্তিযুদ্ধ, নানাভাবে আলো-ছায়া ফেলেছে তার কবিতায়। ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন বিলি করার কোনো চাতুর্য নেই সুমনের কবিতায়। তিনি মানুষকে ভালোবেসে জাগিয়ে তোলেন নান্দনিক ভালোবাসার ভেতর। কবি সুমন রায়হান কবিতার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফুলভারে সজ্জিত বাগান ও খোলা আকাশ দেখতে ভালোবাসেন। পাখি তাকে ডেকে নিয়ে যায় নারী, নদী ও সমুদ্রের কাছে। কবির প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই নিজেকে নতুন করে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। ১৯৮৪ সালের ৪ ডিসেম্বর বরিশালের লক্ষ্মণকাঠিতে জন্ম নেওয়া কবি সুমন রায়হান নিরন্তর হেঁটে চলেছেন কবিতার দূর দিগন্তের আশ্রমে। তারুণ্যোদীপ্ত কবির জন্মদিনে অশেষ শুভেচ্ছা।