শীতের আগমনে শীতার্তদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি দেখানো নৈতিক দায়িত্ব
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
সকালের কুয়াশা আর ঠাণ্ডা হাওয়া জানান দিচ্ছে শীত এসে গেছে। শীতের কারণে পাখিরা গাছের ডালে জবুথবু হয়ে বসে থাকে, ঘাসের ওপর শিশির বিন্দু জমে থাকতে দেখা যায়। এসব শীত আগমনের লক্ষণ। প্রতিবছর শীতকাল আমাদের মাঝে আসে, আবার চলেও যায়। কিন্তু কষ্ট হয় অসহায় ও দুঃখী মানুষের। আল্লাহর ইচ্ছায় প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই ঋতুর পালাবদল ঘটে, শীতের আগমন ঘটে। এখানে মানুষের হাত নেই। প্রাকৃতিক পরিবর্তন ও এর বিরূপ প্রভাব মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ এবং এর মাঝে মহান আল্লাহর আনুগত্যের আহ্বান ধ্বনিত হয়। আর শস্য শ্যামলা ও সুজলা-সুফলা আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অশেষ দান। বাংলাদেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলা হয়। ষড়ঋতুর এ দেশের পরিবেশ ও প্রকৃতি প্রতি বছর ছয়বার ভিন্ন ভিন্ন সাজসজ্জার রূপ ধারণ করে। বাংলাদেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলা হলেও আপাতত বাস্তবে দু’টি ঋতু লক্ষ্য করা হয়। শীত ও গ্রীষ্মকাল। পবিত্র কুরআন মাজিদেও আল্লাহ তায়ালা শুধু দুটো ঋতুর কথা উল্লেখ করেছেন। তা হলো- শীত ও গ্রীষ্মকাল। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাদের (কুরাইশ বংশের লোকদের) অভ্যাস ছিল শীত ও গ্রীষ্মকালীন ভ্রমণ’ (সূরা আল-কুরাইশ-০২)আর শীত শুধু প্রাকৃতিক নিয়মই নয়। এর মাঝে লুকায়িত মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ এবং এর মধ্যেও মহান আল্লাহর আনুগত্যের আহ্বান ধ্বনিত হয়। এছাড়াও শীতজনিত কারণে ছড়িয়ে পড়ছে নানা অসুখ-বিসুখ। তীব্র শীতে বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও ছিন্নমূল মানুষের দুর্ভোগ অসহনীয় অবস্থায় পৌঁছে যায়। বেড়ে যায় শীতজনিত রোগের প্রকোপ। বৃদ্ধ ও শিশুদের মধ্যে জ্বর, শ্বাসকষ্ট, সর্দি, কোল্ড ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগ ছড়িয়ে পড়ে। ফুটপাত এবং খোলা আকাশের নিচে বসবাসকারীদের কষ্টের সীমা থাকে না। গরম কাপড় কেনার সামর্থ্য না থাকায় চা শ্রমিকসহ নিম্ন আয়ের মানুষেরা ভীষণ কষ্টে দিনযাপন করে।
বিভিন্ন স্থানে দেখা যাচ্ছে দরিদ্র মানুষেরা খড়কুটা জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। শীত নিবারণের পোশাক এবং কম্বল-কাঁথার অভাবে অভাবী মানুষের কষ্টের যেন শেষ নেই। হাড়কাঁপানো শীত গরিব মানুষের জীবনকে অসহনীয় অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
এই শীতকাল গরিব-দুস্থ মানুষের জন্য ভীষণ কষ্টের। একবার কি আমরা ভেবে দেখেছি এই শীতে অসহায় গরিব বস্ত্রহীন কর্মঅক্ষম মানুষ কীভাবে রাত কাটাচ্ছেন? তাদের আমাদের মতো দামি গরম পোশাক তো দূরে থাক, সামান্য কাপড়টুকু নেই। ছোট ছোট বাচ্চারা এই তীব্র শীতে কত কষ্টে আছে। অনেকে শীতের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে মারাও যাচ্ছেন। তাই শীতের পোশাক ও কম্বল বিতরণের মাধ্যমে অসহায়ের পাশে দাঁড়ানোর সময় এখনই।
আল্লাহর ইচ্ছায় প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে ঋতুর পালাবদল ঘটে। কনকনে হিমেল হাওয়া ও তীব্র শৈত্যপ্রবাহ দরিদ্র জনগোষ্ঠী-অধ্যুষিত অঞ্চলে বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং মানুষের অসহায়ত্বকে প্রকট করে তোলে। তাই শীতার্ত হতদরিদ্র মানুষের প্রতি সমাজের সামর্থ্যবান ও বিত্তশালী ব্যক্তিদের সাহায্য ও সহানুভূতির হাত সম্প্রসারিত করে তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে শীতবস্ত্র বিতরণ করে তাদের পাশে এসে দাঁড়ানো দরকার। নিঃস্বার্থভাবে শীতার্ত মানুষের সাহায্য ও সেবা করাই মানবতার সেবা। এমন মহৎ ও পুণ্যময় কাজই সর্বোত্তম ইবাদত। অসহায় মানুষকে দুর্দিনে সাহায্য, সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মানসিকতা যাদের নেই, তাদের ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না।
সুতরাং নামাজ, রোজার সঙ্গে জনকল্যাণের তথা মানবিকতা ও নৈতিকতার গুণাবলি অর্জন করাও জরুরি।আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশে আবহাওয়ার স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি কিছুটা পাল্টে গেছে। বর্ষাকাল কিংবা শীতকালের সময় এবং ধরন ঠিক আগের মতো হচ্ছে না। তিন মাসের (নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারি) পূর্বাভাসে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, শেষরাত থেকে সকাল পর্যন্ত দেশের উত্তর, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল ও নদ-নদী অববাহিকায় মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। এ ছাড়া দেশের অন্যত্র হালকা থেকে মাঝারি ধরনের কুয়াশা পড়তে পারে। ঘন কুয়াশার কারণে দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে আসতে পারে, এতে শীতের অনুভূতি বাড়তে পারে।
এবারের শীত মৌসুমে দেশে ৮ থেকে ১০টি মৃদু (তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) থেকে মাঝারি (৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। তবে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে ২-৩টি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ (৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস) বয়ে যেতে পারে। ফলে কেমন ভয়াবহতা তৈরি হতে পারে, তার আভাস এখনই পাওয়া যাচ্ছে। ফলে শৈত্যপ্রবাহ আসার পরে অসহায়দের পাশে না দাঁড়িয়ে আগেভাগে প্রস্তুতি নিলে শীতার্তরা স্বস্তিতে থাকতে পারবেন।
আমরা প্রতি বছরই শীত এলে উপলব্ধি করি, ‘ভয়াবহ’ শীত চারদিকে। ভয়াবহ বললাম এ কারণে যে, শীত আর এখন উপভোগ্য নয়। যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শুধু গ্রাম নয়, রাজধানীতেও হানা দেয় দুর্দান্ত প্রতাপে। একটা অসহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় চারদিকে। গত বছর যখন প্রচুর গরম পড়েছিল, তখনই মনে হয়েছিল, শীতও হবে প্রচুর। ফলে এবারও সারা দেশে শীত পরিস্থিতি অস্বাভাবিকভাবে অবনতির দিকে যেতে পারে। তখন কিন্তু জীবনযুদ্ধে হিমশিম খাবে নিম্ন আয়ের মানুষ। ২০২৩ সালের শুরুতেই বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ৬ জানুয়ারি সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল টেকনাফে ২৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় ছিল ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ৭ জানুয়ারির সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় ৮.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায়ও ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে কিছুটা কমে হয়েছিল ১১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একই বছর ৬ জানুয়ারি নওগাঁ, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, যশোর ও চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গিয়েছিল।
তখন আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছিলেন, চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি সকালে ফরিদপুর, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, দিনাজপুর, নীলফামারী, পঞ্চগড়, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা ও বরিশাল জেলাসহ রাজশাহী বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাবে। তা কিছু এলাকায় প্রশমিত হতে পারে। আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ, ৬ থেকে ৮ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বলে। আর তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে তাকে বলে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়। ফলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, রাজধানীসহ সারা দেশে শীতের তীব্রতা বাড়তে পারে। ভোর থেকে ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকতে পারে আকাশ। দিনের তাপমাত্রা ওঠানামা করতে পারে ৮ থেকে ১৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। যে কারণে তীব্র শীতের দাপটে শীতবস্ত্রের চাহিদা তখন তুঙ্গে থাকবে। তবে শিশু ও বৃদ্ধদের শীতের কাপড়ের চাহিদা বেশি থাকে সবসময়। বছরের শেষে বা শুরুতে শীত জেঁকে বসায় গরম কাপড়েরও চাহিদা বেড়ে যাবে। ফলে বিক্রি বাড়ায় খুশি হবেন বিক্রেতারা। কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য তা অসহনীয় হয়ে দেখা দিতে পারে।
আমাদের দেশে তীব্র শীতে দুর্ভোগ পোহায় পথশিশু, ছিন্নমূল এবং নিম্ন আয়ের মানুষ। না আছে তাদের শীতবস্ত্র, না আছে কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থ। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে যেসব শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তাই আহ্বান থাকল, ব্যক্তিগত উদ্যোগেও শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন। অসহায় প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নিতে পারেন। আপনার অব্যবহৃত শীতবস্ত্রটি তাকে দান করতে পারেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। স্থানীয় মসজিদে মুসল্লিদের উদ্যোগে শীতবস্ত্র বিতরণ করা যেতে পারে। একইভাবে মন্দির, গির্জা ও প্যাগোডার ব্যবস্থাপনা কমিটির উদ্যোগে শীতবস্ত্র সংগ্রহ করে অসহায়দের মাঝে বিতরণ করা উচিত।
পরিশেষে বলতে চাই, সব মানুষের উচিত সমগ্র সৃষ্টির প্রতি দয়া-মায়া, অকৃত্রিম ভালোবাসা, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সহানুভূতি বজায় রাখা।শীতার্ত গরিব-দুঃখী মানুষের সামান্য উঞ্চতার ব্যবস্থা করে দিলে আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই এর উপযুক্ত বদলা দেবেন। কারণ বান্দার দুঃখ-দুর্দশায় কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ালে আল্লাহ তার প্রতি করুণার দৃষ্টি দেন।আর শীতের তীব্রতা খুব বেশি বেড়ে গেলে কিংবা টানা শৈত্যপ্রবাহ থাকলে আমরা শীতবস্ত্র বিতরণের প্রয়োজন অনুভব করি। দান করার ইচ্ছা থাকলে শীতের শুরুতেই অসহায়দের শীত উপকরণ পৌঁছে দেওয়া উচিত। এতে শীতার্তদের কষ্ট লাঘব হয়।
তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের পাশে দাঁড়ানোই মানবিক গুণাবলির পরিচায়ক।
লেখক : সংগঠক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।